বাংলাদেশে শিগগিরই আসছে রাশিয়ার শস্য: রুশ দূত সেমেনোভা
রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে শস্য আমদানির চলমান আলোচনার অগ্রগতির পাশাপাশি আলোচনা সম্পন্ন হওয়ার আভাস দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত একাতেরিনা এ সেমেনোভা।
বুধবার রাজধানীতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অফিসে এক আলোচনায় রাশিয়ার এই দূত বলেন, 'এবিষয়ে এখনও কথা হচ্ছে। আশার বিষয় হলো খুব শিগগিরই তা শেষ হতে চলেছে। প্রায় দুই লাখ টন শস্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে'।
'এটা জিটুজি চুক্তি হলেও বেসরকারি সরবরাহকারীদের জন্যও সুযোগ থাকবে। রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে শস্য পাঠানোর জন্য আমাদের কাছে আসছে,' বলেন তিনি।
'চলতি বছর রাশিয়ায় ব্যাপক ফলন হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হচ্ছে এবার আমরা বিভিন্ন দেশে ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন টন শস্য সরবরাহ করতে পারব,' বলেন তিনি।
বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া থেকে গত ২৩ জুন তিন লাখ টন গম কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দুই লাখ টন গম দুই মাসের মধ্যে এবং বাকি এক লাখ টন আগামী এক মাসের মধ্যে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
তবে রাশিয়ার এই দূত গম আমদানি প্রক্রিয়ায় কিছু টেকনিক্যাল সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার পণ্য আমদানিতে স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার মতো জটিলতা।
'এটি অবাক করার মতোই কারণ কৃষিপণ্যকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে। আর তাই পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই', বলেন সেমেনোভা।
খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখতে জিটুজি চুক্তি ও বেসরকারি সরবরাহকারীদের মাধ্যমে রাশিয়া বাংলাদেশের একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে থাকতে চায় উল্লেখ করে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আমরা আছি এবং আপনাদের হতাশ করব না'।
সুইফটের মাধ্যমে অর্থপ্রদানের চ্যানেল সম্পর্কে তিনি বলেন, 'শুধুমাত্র সাতটি রাশিয়ান ব্যাংককে এই সিস্টেম ব্যবহার করতে বাধা দেওয়া হয়েছে। বাকিরা এটি ব্যবহার করতে পারবে। তারপরও বাংলাদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কিছু শঙ্কা কাজ করে। কিন্তু আমি যেমন বলেছি, কৃষিপণ্যগুলোকে নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, এলসি নিয়ে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়'।
সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া এবং এর সঙ্গে রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নে সেমেনোভা বলেন, "এই সরবরাহ ব্যাঘাতের কারণ হল নিষেধাজ্ঞা। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের রাশিয়ান জাহাজগুলোকে বন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। আমাদের জাহাজ ও সরবরাহের জন্য বীমাও দেওয়া হচ্ছে না। এটা নিষেধাজ্ঞার কারণে ঘটছে। এমন নয় যে আমরা পণ্য সরবরাহে রাজি নই। আমাদের তরফ থেকে আগ্রহে ঘাটতি নেই'।
পুরো বিশ্বকেই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা এই যুদ্ধের ইতি তিনি কীভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে রাশিয়ান এই দূত বলেন, 'তারা (পশ্চিম) যদি চায় আমরা সংঘাতে না জড়াই, তাহলে তাদের উচিত হবে (ইউক্রেনে) অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা। অন্যথায় এটা সম্ভব নয়'।
সেমেনোভা বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তুরস্কে আলোচনাসহ ভার্চুয়াল আলোচনা থেকে সরে এসেছেন কারণ তিনি খুব একটা স্বাধীন নন। ব্রাসেলস ও ওয়াশিংটন থেকে তার পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদের থেকে তিনি নির্দেশনা নেন। আলোচনা চাইলে আমরা তার জন্য প্রস্তুত আছি, কিন্তু বিপরীত পক্ষ থেকে কোনো আগ্রহ দেখি না।"
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে চলমান শঙ্কা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'এ নিয়ে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। সবকিছু নির্ধারিত সময়েই হবে। (বাংলাদেশের) অর্থমন্ত্রী ও আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে। তাই যেকোনো টেকনিক্যাল সমস্যার নিষ্পত্তি হবে।'
'এটি (আমাদের জন্য) একটি বড় প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচিতে বিপর্যয় ঘটার মতো কোনো কিছু আমরা করব না। চলতি বছরের শেষ দিকে এই প্রকল্পের বড় একটি মাইলফলক অর্জিত হবে বলে আশা করছি। দ্বিতীয় চুল্লির প্রেসার ভেসেল এই সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের কোনো এক সময়ে ইনস্টল করা হবে'।
বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি সংকট এবং রাশিয়ার তেল কেনার সম্ভাবনা সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত বলেন, 'তেলের প্রশ্নটি শস্যের চেয়ে বেশি বিতর্কিত। অন্যথায় আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত'।
তিনি আরও বলেন, 'ভারত তার রাশিয়ান তেলের সরবরাহ কয়েকগুণ বাড়িয়েছে। জ্বালানি রপ্তানিতে আমরা প্রস্তুত। বাংলাদেশকে সাহায্য করতেও তৈরি আছি আমরা। খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের বন্ধুরা নিরাপদ থাকুক এটাই চাই'।
'আমাদের প্রধান প্রাকৃতিক গ্যাস প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম ইতোমধ্যেই এখানে রয়েছে। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে কাজ করছে তারা। তাদের কূপ অনুসন্ধান ও খনন চলছে। সম্প্রতি ভোলায় কূপ খননের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখানে প্রচুর গ্যাস মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার মনে হয় এখানে তেল থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে এবং আমাদের তা নিয়েও কাজ করা উচিত।"
ইউক্রেন সংকট নিয়ে পশ্চিমা শক্তি ও রাশিয়ার মধ্যে অবস্থান গ্রহণে বাংলাদেশ যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে, তার প্রশংসা করেন সেরেনোভা। তিনি বলেন, 'জাতিসংঘে রাশিয়া বিষয়ক প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণের জন্য আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। পশ্চিমাদের চাপ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অত্যন্ত সাহসী একটি অবস্থান নিয়েছে'।
'বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানকেই আমরা সবচেয়ে গুরুত্বের চোখে দেখছি। সম্প্রতি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গে একটি জোরালো মন্তব্য করেছেন...আমরা এই দৃঢ় ও সরব সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ। আমি মনে করি এখন সবাই একমত হতে পারে যে সংঘাতে ইতি টানার প্রশ্নে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো আর রাশিয়াকে প্রভাবিত করছে না', বলেন তিনি।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখার কথা জানান সেমেনোভা। 'এখান থেকে শস্য, আম এবং আলু সরবরাহের অনেক সুযোগ রয়েছে। তেল ও গ্যাস সরবরাহের সম্ভাবনাও রয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়েও আগ্রহী আমরা। আমাদের কাছে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা রয়েছে এবং আমরা ভবিষ্যত সম্পর্কে ভীষণ আশাবাদী'।
ভারপ্রাপ্ত এই রাষ্ট্রদূত ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার প্রশংসাও করেন। তৈরি পোশাক ও কৃষিপণ্যের বাইরে এই খাতটি বেশ সম্ভাবনাময় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
'এই বিষয়ে (ফার্মাসিউটিক্যাল) আমরা কেবল আপনাদের হিংসা করতে পারি। আমাদের এই খাত আরও অনুন্নত। আর তাই আমরা বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করতে আগ্রহী,' বলেন তিনি।
এছাড়া রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
'আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে আমরা নতুন আরও রাশিয়ান প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠান দেখতে পাব,' বলেন সেমেনোভা।
আলোচনায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক ইনাম আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার খান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক চৌধুরী খালেদ মাসুদ এবং উপ-সম্পাদক মুবিন এস খান উপস্থিত ছিলেন।