গর্বাচেভ কার ছিলেন? পূর্বের নাকি পশ্চিমের?
"গর্বাচেভ আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটবে এবং একটি নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমাবিশ্বের মধ্যে রোমাঞ্চকর সম্পর্কের সূচনা হবে। কিন্তু আদতে সেই রোমাঞ্চকর মধুচন্দ্রিমার সম্পর্ক বেশিদিন ধোপে টেকেনি,"- উক্তিটি শেষ সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় করা ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভের।
ক্রেমলিন মুখপাত্রের এই মন্তব্যেই বোঝা যায় অনেক কিছু। রাশিয়া বা সোভিয়েত বলয়ে গর্বাচেভকে একভাবে মূল্যায়ন করা হয়, অপরদিকে বাকি বিশ্ব তাকে দেখেন অন্যভাবে। পশ্চিমা উদারপন্থী গণতন্ত্রকামীদের কাছে মিখাইল গর্বাচেভ এমন নেতা ছিলেন, যিনি নিপীড়িত সোভিয়েত জনগণকে মুক্তি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলমান স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছিলেন। অন্যদিকে, রুশ ফেডারেশন ও সারাবিশ্বের সমাজতন্ত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন পুঁজিবাদী বুর্জোয়া গোষ্ঠীর দালাল, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কবর খুঁড়েছেন।
১৯৩১ সালে কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া বিংশ শতাব্দীর এই প্রভাবশালী রাজনীতিক নানান মতের নানান মানুষের কাছে বিভিন্নভাবে আলোচিত-সমালোচিত। কারো কাছে তিনি পূজনীয়, কারো কাছে নিন্দিত। এসব মিশ্র প্রতিক্রিয়ারও রয়েছে বেশ কিছু কারণ।
১৯৮৫ সালের মার্চে মিখাইল গর্বাচেভ যখন সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে সোভিয়েতের দায়িত্ব নেন, তখন খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের বা বহির্বিশ্বের কেউই ভাবতে পারেনি মাত্র ৬ বছরের মধ্যে তিনি স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব রাজনীতির বাঁক বদলাতে যাচ্ছেন, তৈরি করতে যাচ্ছেন নতুন এক ইতিহাস; হোক সে ইতিহাস কারো কাছে নন্দিত, আর কারো কাছে নিন্দিত।
তার শাসনামলের শুরুর দিকে তেলনির্ভর সোভিয়েত অর্থনৈতিক অবস্থা পড়তির দিকে যাচ্ছিল, তেলের মূল্যের অস্বাভাবিক হ্রাসের কারণে অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছিল এই চাপ। আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯৩০ সালের স্থাপিত হওয়া কলকারখানা ১৯৮০'র দশকে এসে সেকেলে ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। সেকেলে কলকারখানায় হ্রাস পেতে থাকে উৎপাদন। ফলে চাহিদা যোগানের সমতায় দেখা দেয় ঘটাতি। এসময় মোট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ সামরিকখাতে ব্যয় হওয়ায় অর্থনীতি বেশ চাপে পড়ে যায়। নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থার চাপ পড়ে জনগণের ঘাড়ে। পার্টির সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই গর্বাচেভ নজর দেন সোভিয়েত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে। প্রথমে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন ও শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন তিনি। চেষ্টা করেন, আমলাতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহনের। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে গর্বাচেভ গ্রহণ করে 'গ্লাস্তনস্ত', যার অর্থ খোলা হাওয়া; মূলত খোলামেলা আলোচনার বিষয়টি বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল।
তিনি অর্থনীতিকে তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রকর্তৃক কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে কিছুক্ষেত্রে মুক্ত বাজারভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তবে এখানে মনে রাখা দরকার, তিনি পূর্ণ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক চীনের মত নিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করে বিপর্যস্ত আর্থিকব্যবস্থায় প্রাণ সঞ্চার করতে। যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে কিছু খাতের বেসরকারিকরণ করা হবে। সে সময়ে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রুগ্ন অর্থনীতি পরিবর্তনের এই ধাক্কা সহ্য করতে পারেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরিণামে সোভিয়েত এলাকাজুড়ে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা।
গর্বাচেভ অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নের উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব দূর করতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। আর সেজন্য তিনি 'পেরেস্ত্রাইকো' বা খোলা নীতি গ্রহণ করেছিলেন। নিজ দলে তিনি গণতন্ত্রের ওপর জোর দিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। তৎকালীন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সোভিয়েত সমাজ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও কথা বলার স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়েছিল। দীর্ঘ সময় স্টালিন-ব্রেজনেভ এর স্বৈরশাসনে জনগণ হতাশ হয়ে পড়েছিল; মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিল তারা। গর্বাচেভের 'গ্লাস্তনস্ত' (কথা বলার স্বাধীনতা) ঘোষণার মধ্য দিয়ে জনগণ যেন পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ! অনেকবছর পর সংবাদপত্র-টেলিভিশন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। সবাই যখন নির্ভয়ে কথা বলা ও লেখার সুযোগ পেল, তখন অতীতের সোনালী অর্জনের চেয়ে ভুল ও ব্যর্থতা নিয়েই বেশি আলোচনা হতে লাগলো।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতারা সবসময় জনগণকে এটিই বুঝিয়ে এসেছিলেন, সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের চেয়ে ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু মুক্ত গণমাধ্যম চালু হওয়ায় জনগণ যখন সংবাদপত্র-টেলিভিশনে পশ্চিমা জনগণের আয়েশি জীবনের খবর পেতে শুরু করলো, তখন তারা সমাজতন্ত্রের দুর্বল দিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল।
এদিকে 'গ্লাস্তনস্ত' ও 'পেরেস্ত্রেইকো' নীতির ফলে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতেই চাঙ্গা হতে থাকলো সোভিয়েত বিরোধী মনোভাব। পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে সোভিয়েত বিরোধী গণআন্দোলন তীব্র হতে থাকলো। আর গর্বাচেভ সরকার সেই আন্দোলন সামাল দিতে হিমশিম খেতে লাগলো। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেওয়াল পতনের মাধ্যমে দুই জার্মানি অনানুষ্ঠানিকভাবে এক হয়ে যায়। সমগ্র সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতে অরাজক পরিবেশ তৈরি হয়। এদিকে, জনগণের দুর্দশাও বাড়তে থাকে। দ্রুত কমতে থাকে গর্ভাচেভের জনপ্রিয়তা। সাধারণ জনগণ দোষারোপ করতে শুরু করে, 'এই লোক' (গর্বাচেভ) সব দুর্দশার কারণ। পার্টিতে তিনি নিজের লোকদের দ্বারাই চাপে পড়ে যান। এরপর বহু ঘটনাপ্রবাহে ১৯৯১ সালে রাশিয়ায় এক অভ্যুত্থান ঘটে; গর্ভাচেভকে করা হয় গৃহবন্দী। কিন্তু তৎকালীন রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের মধ্যস্থতায় তিনি মুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্সি পদ ফিরে পান।
তবে এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গর্বাচেভ পরিণত হন ঠুটো জগন্নাথে। কারণ তখন ক্ষমতার মূল কলকাঠি চলে যায় বরিস ইয়েলৎসিন এর হাতে। একপর্যায়ে ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর গর্ভাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দেন। সেদিন একইসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক পতন হয়। এরমাধ্যমে ইতিহাসের একপর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে, শুরু হয় এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নতুন পর্যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়, আর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিশ্ব ব্যবস্থার একক কর্তৃত্ব চলে যাওয়ায়। এতে নিজ দেশের জনগণের কাছেই 'খলনায়কে' পরিণত হন গর্বাচেভ। বিগত তিন দশক যাবত অধিকাংশ রুশদের কাছ থেকে তিনি এই খেতাবই পেয়েছেন। বর্তমান রাশিয়ার দুর্দশার জন্যও দায়ী করা হয় তাকে।
পুতিনের ভাষায় "সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ছিল বিংশ শতাব্দীর বড় বিপর্যয়"। আর এই পতনের ক্রিড়ানক গর্ভাচেভ ছিলেন বলে মনে করে বর্তমান রুশ ফেডারেশনের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী।
মুদ্রার ওপিঠে পশ্চিমা বিশ্বের চশমায় দেখলে বোঝা যায়, মিখাইল গর্ভাচেভ ছিলেন 'সোভিয়েত কারাগারে বন্দী কোটি কোটি মানুষের মুক্তিদাতা'। ১৯৮৪ সালে যখন তিনি পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য হয়ে লন্ডন সফর করেন তখন তৎকালীন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল "তাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তার সাথে আমরা কাজ করতে পারি"। গর্বাচেভ ১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতিতেও বড় পরিবর্তন আনেন। তিনি পশ্চিম ও প্রাচ্যের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো করার উদ্যোগ নেন। ১৯৮৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের সঙ্গে মাঝারি পাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের চুক্তির মাধ্যমে তৎকালীন চলমান স্নায়ুযুদ্ধের মাত্রা কমানোর আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেন।
তিনি এমন একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, যিনি সোভিয়েত সমাজকে উন্মুক্ত করার কাজে যুক্ত ছিলেন। পূর্ববর্তী শাসকদের মতো জনমতকে দমন করার পরিবর্তে, তিনি আশাবাদ ও সুস্থ বিতর্ককে উৎসাহিত করিছেন। তিনি সংস্কারের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন। গর্বাচেভের এসব উদ্যোগ পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত হয়। অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ ও উত্তেজনা হ্রাসের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বর্পূণ ভুমিকা রাখায় ১৯৯০ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তার প্রয়াণে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, "স্নায়ুযুদ্ধের শান্তিপূর্ণ অবসানে তিনি যে সাহস ও সততা দেখিয়েছেন, তার প্রতি আমরা সর্বদা শ্রদ্ধাশীল।"
এখন দেখা যাক বর্তমান রাশিয়ার তরুণ তরুণীরা গর্বাচেভের রাজনীতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি তারা নিজেদের মর্যাদাহানী বলে মনে করেন। ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া সংকটের সময় এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গর্বাচেভের সিদ্ধান্তের সমালোচনাকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তোলে।
বর্তমান রুশ জনগণ মনে করে, বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলো ও তাদের সামরিক জোট ন্যাটো ইউক্রেনের ওপর ভর করে রাশিয়ার জন্য যে নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করছে, সে ইউক্রেন হাজার বছর ধরে রাশিয়ারই অংশ ছিল। ইউক্রেনসহ অন্যান্য অঞ্চল হারানোর জন্য অনেকে গর্বাচেভকে দায়ী করে থাকেন। তারা মনে, করেন ১৯৯১ সালের গর্বাচেভসহ অন্যান্য নেতাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনই হয়নি, রাশিয়া নিজের ভূমি (ইউক্রেন) ও মর্যাদা হারিয়েছে। আর এসব কারণে রাশিয়ার নতুন প্রজন্ম মনে করে, গর্বাচেভ ছিলেন সিআইএ'র এজেন্ট কিংবা পশ্চিমা প্রেমে মগ্ন।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মত এমন সংকটময় সময়ে গর্বাচেভের মৃত্যু একটি প্রশ্নকে আরও উস্কে দিয়েছে। আর সেটি হলো, গর্বাচেভ আসলে কার ছিলেন? রুশ জনগণের নাকি পশ্চিমাদের? গর্বাচেভ কি স্নায়ুদ্ধের অবসান ও রক্তপাতহীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সংকট সমাধানের জন্য সমাদৃত হবেন নাকি বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রীদের স্বপ্ন ভাঙনের দায়ে নিন্দিত হবেন? গত তিন দশকের মতো এই বিতর্ক হয়তো চলতে থাকবে আরও অনেক বছর ধরে। কারণ আমাদেরকে যা দেখানো হয় আমরা তাই দেখি, তাই বিশ্বাস করি। মূলত এ কারণেই যেই নীতির জন্য গর্বাচেভ পূর্বে নিন্দিত, ঠিক সেই নীতির জন্যেই পশ্চিমে নন্দিত।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।