আরও বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দিতে প্রস্তুত এনবিআর
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত বাণিজ্য সুবিধা ব্যবস্থা অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) পুরোদমে চালু করতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ। এইও সনদ পাওয়ার জন্য ৬৩টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। এ সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বন্দরে দ্রুত কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সুবিধা পেয়ে থাকে।
২০১৯ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানকে লোভনীয় এই মর্যাদা দিয়েছিল। ওই সময় কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তারা এক মাসের মধ্যে টেক্সটাইল, ওষুধ ও চামড়া খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আরও ১০টি প্রতিষ্ঠানকে এইও সনদ দেয়ার জন্য বাছাই করবেন।
এইও মর্যাদা পাওয়া প্রতিষ্ঠান কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই বন্দর থেকে আমদানি পণ্য খালাস করে সরাসরি নিজেদের ওয়্যারহাউসে নিয়ে যেতে পারে। এতে তাদের সময় বাঁচে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সময়সূচি মেনে চলা সহজ হয়।
এইও কার্যকর করার নতুন উদ্যোগ
এনবিআরের শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট এইও সনদ দেওয়ার জন্য ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের আবেদন যাচাই-বাছাই করছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন এর কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক।
চলতি বছরের এপ্রিলে আরও কিছু নতুন প্রতিষ্ঠানকে এইও সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় এনবিআর। তবে কমপ্লায়েন্স শর্ত পূরণ না হওয়ায় এনবিআর এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করেনি।
শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট আশা করছে ১০ থেকে ১৫টি কোম্পানি এনবিআরের শর্ত পূরণ করতে পারবে।
কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক টিবিএসকে বলেন, ভ্যাটের জন্য বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এনবিআরের অনুমোদিত সফটওয়্যার ব্যবহার করছে না। 'প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সফটওয়্যার আছে। তাদের অ্যাকাউন্ট সিস্টেমে কোনো অনিয়ম হলে তাদের কাস্টমাইজড সফটওয়্যার থেকে সেটি খুঁজে বের করা আমাদের জন্য দুরূহ হবে,' তিনি জানান।
তবে অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান এনবিআরের অনুমোদিত ভ্যাট সফটওয়্যার ইনস্টল করার জন্য বিভিন্ন সফটওয়্যার ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তাদেরকে জানিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। 'পারফরম্যান্স রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা তাদেরকে এইও স্বীকৃতি দেব। আশা করা যায়, কাজটি এক মাসের মধ্যে শেষ হবে,' এনামুল হক বলেন।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কমপক্ষে ১২টি টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক আমদানি-রপ্তানির খাতের সঙ্গে যুক্ত। এর বাইরে আবুল খায়ের গ্রুপের ১০টি, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (বিএসআরএম) ৩টি; বেক্সিমকো, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, শাহ সিমেন্ট লিমিটেড, এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড, সিনজেন্টা বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের দুটি কোম্পানি এইও সুবিধার জন্য আবেদন করেছে।
ভ্যাট সফটওয়্যার ব্যবহার করছে না পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেড, তবু প্রতিষ্ঠানটি এইও সনদের জন্য আবেদন করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মেট্রোপলিটন চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের কোম্পানি যেহেতু শতভাগ রপ্তানিমুখী, তাই আমাদের ভ্যাট সফটওয়্যার থাকার কথা না। কারণ রপ্তানিকারকদের ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
'কোনো প্রতিষ্ঠানের যদি অতীতে খারাপ রেকর্ড না থাকে, তাহলে তাদের এইও স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।'
এইও সনদের জন্য আবেদন করা একটি প্রতিষ্ঠান এনভয় টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের কোম্পানিতে একটি ভ্যাট সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এনবিআর আমাদের বলেছে তাদের বাছাই করা সফটওয়্যার ইনস্টল করতে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব নতুন সফটওয়্যার ইনস্টল করার জন্য কাজ করছি।'
থমকে যাওয়া অগ্রগতি
বিশ্ব শুল্ক সংস্থা (ডব্লিউওসি) ২০০৫ সালে পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচলের জন্য এইও কর্মসূচি চালু করে। কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে বিদ্যমান শুল্ক আইন সংশোধন করে।
২০১৮ সালে এনবিআর এইও সুবিধা পাওয়ার মানদণ্ড উল্লেখ করে একটি আদেশ জারি করে। পরের বছর ওষুধ খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এই সুবিধা প্রদান করা হয়।
এরপর থেকেই উদ্যোগটি থমকে রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এনবিআর প্রক্রিয়াটি আরও উন্নত ও জনপ্রিয় করতে না পারায় এইও সনদ দেওয়ার কার্যক্রম ধীর হয়ে পড়েছে।
প্রতিযোগিতা সক্ষমতার জন্য প্রয়োজন এইও
কিন্তু স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন নিশ্চিত করার জন্য নিজস্ব কৌশলের অংশ হিসেবে বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে এইও সুবিধা দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও বাণিজ্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
ডব্লিউসিওর তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে এইও সনদ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১ হাজার ২০টি, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ১৭ হাজার ৮৯৫টি, চীনে ৩ হাজার ২০৩টি, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৮৪৫টি এবং জাপানে ৭০৬টি।
পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ২০১১ সালে এইও সনদ দেওয়া শুরু করে। দেশটি এখন ইউরোপীয় ইউনিয়সহ নতুন প্রজন্মের এফটিএ ও কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা রিজিয়োনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিতে এইও মিউচুয়াল রিকগনিশন অ্যাগ্রিমেন্ট (এইও এমআরএ) স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশের তিনটি প্রতিষ্ঠানের এইও মর্যাদা থাকলেও ডব্লিউওসির এইও কম্পেনডিয়াম-এ তার কোনো উল্লেখ নেই।
অগ্রগতি ধীর হয়ে গেল যে কারণে
২০১৯ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) সুবিধা পরীক্ষামূলকভাবে চালুর অনুমতি পাওয়া তিন প্রতিষ্ঠানের একটি শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস।
কথা ছিল প্রতিষ্ঠান তিনটি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ ও ঢাকা কাস্টম হাউজে দ্রুত ক্লিয়ারেন্স পাবে।
স্কয়ারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই সুবিধা চালুর পরও তাদের কোনো লাভ হয়নি। ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, 'কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে এখনও আগের মতোই ৩-৪ দিন সময় লাগে।'
'আমাদের পক্ষ থেকে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, তবে কাস্টমসে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে,' বলেন তিনি।
তবে এনবিআর বলছে, সনদপ্রাপ্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা বিশেষ ভ্যাট সফটওয়্যার ব্যবহার না করায় এইও সুবিধা পাচ্ছে না ওষুধ কোম্পানিগুলো।
তবে কোম্পানিগুলো মনে করছে, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের মনোভাব পরিবর্তন না করায় এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাস না করায় মূলত এ উদ্যোগ সফল হচ্ছে না।
এইও মর্যাদা পাওয়া কোম্পনিগুলো টিবিএসকে বলেছে, জাহাজ বন্দরে ভেড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের পণ্য খালাসের সুবিধা পাওয়ার কথা।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ২০২০ সালের 'ইজ অভ ডুয়িং বিজনেস' প্রতিবেদনে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম। কাসটমস ও বন্দরে দক্ষতার অভাব বাংলাদেশের এই পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।
এছাড়া বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স (এলপিআই) অনুযায়ী, চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়াসহ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই সূচকেও বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করেছিল।
গত সেপ্টেম্বরে এনবিআর প্রকাশিত টাইম রিলিজ স্টাডির (টিআরএস) তথ্য অনুযায়ী, বন্দরে জাহাজ ভেড়ার পর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ থেকে পণ্যের চালান খালাস করতে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা লাগে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের মাধ্যমেই দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্রকাশিত টিআরএসের তথ্য বিবেচনায়, পণ্য খালাসে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আগে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা এনবিআরের একজন শীর্ষ কাস্টমস কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা এইওতে অভ্যস্ত ছিলেন না। এছাড়া এনবিআরের আদেশেও কিছু অস্পষ্টতা ছিল। তবে এনবিআর এখন এ ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করে তুলতে কাজ করছে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, এটি কার্যকর করার জন্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের এইও মর্যাদা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা রাখতে হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আরও বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে এইও সনদ দেওয়ার উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, এই ইতিবাচক উদ্যোগ বন্দরে জট কমানোর পাশাপাশি ব্যবসায় সময় ও খরচ কমাতে সাহায্য করতে পারে। এটি বাংলাদেশে ব্যবসা সহজ করায়ও ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, 'আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি কার্যকর করতে অনুরোধ জানাচ্ছি।'
এনবিআরের কাস্টমস নীতিমালার সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন অবশ্য বলেন, 'রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ও এনবিআরের সার্বিক পদক্ষেপ ছাড়া এটি পূর্ণাজ্ঞ কার্যকর করা সম্ভব হবে না।'
এইও সুবিধা ও এই সুবিধা পাওয়ার শর্ত
'ফিজিক্যাল কাস্টমস চেক' ছাড়া পণ্য খালাস করার জন্য এইও সনদপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে তাদের কাগজপত্র আগেভাগে পাঠাতে হয়, যাতে পণ্য বন্দরে পৌঁছার আগেই প্রায় সব ধরনের কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলা যায়।
খুব অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা দৈব চয়নের ভিত্তিএ বন্দরে বা পণ্য খালাসের পর সশরীরে পণ্য কাস্টমস চেক করেন। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগ হবে অনলাইনে।
কয়েকটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে এইও সুবিধা দেওয়া হবে। সেসবের মধ্যে রয়েছে—কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর আইনের আওতায় সন্তোষজনক কমপ্লায়েন্স রেকর্ড থাকতে হবে; আবেদনকারীকে আগের তিন বছর অপরাধমুক্ত থাকতে হবে; কোনো রাজস্ব বকেয়া থাকা যাবে না; যেকোনো মামলায় জরিমানার পরিমাণ মোট পণ্য বা সেবামূল্যের ১ শতাংশের বেশি হওয়া যাবে না।
এছাড়া আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন অন্তত ৫ কোটি টাকা হতে হবে। আর বার্ষিক আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ন্যূনতম ৫ কোটি টাকা হতে হবে।