বড় মাছ কি পোনা মাছ: বড় ঋণ খেলাপির মামলা যেভাবে চলতেই থাকে
অগ্রণী ব্যাংকের বাবুবাজার শাখা থেকে ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ব্যবসার জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নেন জুতা-স্যান্ডেলের খুচরা ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ মাহমুদ। এই ঋণের সুদ-আসলের প্রায় দেড় লাখ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হন এই ব্যবসায়ী। ২০১৪ সালে জানুয়ারি মাসে ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৩ এ ব্যাংক তার বিরুদ্ধে মামলা করে।
এই মামলায় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আদালত রায় ঘোষণা করেন। ব্যাংকের কাছে ব্যবসায়ী ইমতিয়াজের বন্ধক রাখা দোকান নিলামে বিক্রয় করে টাকা আদায় করতে ব্যাংকের পক্ষে রায় ঘোষণা করেন আদালত।
পরবর্তীতে এই রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর জজ আদালত-২ এ আপিল দায়ের করেন এই ব্যবসায়ী। এক বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করে অর্থঋণ আদালতের রায় বহাল রাখেন জজ আদালত।
এরপর ইমতিয়াজ ব্যাংকের সাথে আলোচনা করে সুদ-আসল এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ আড়াই লাখ টাকা ব্যাংককে পরিশোধ করেন।
অগ্রণী ব্যাংকের এ্কই শাখা থেকে ২০০৮ সালের জুন মাসে ৮৭ কোটি টাকা ঋণ নেন লঞ্চ ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান। এই ঋণের সুদে আসলে একটি টাকাও পরিশোধ করেননি এই ব্যবসায়ী। পরবর্তীতে ২০১২ সালে ঢাকার একই অর্থঋণ আদালতে সুদ-আসলে ১২৩ কোটি টাকা আদায়ের জন্য মামলা করে ব্যাংক। দশ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত মামলাটির বিচার সম্পন্ন হয়নি। জানা যায়, লঞ্চ ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান এই ব্যাংকের একজন সাবেক পরিচালকের নিকাত্মীয়।
এই দুটি ঘটনা সারা দেশের ঋণ খেলাপি মামলা নিষ্পত্তির সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরছে।
সুপ্রিম কোর্টের সূত্রমতে, সারাদেশের অর্থঋণ আদালতগুলোতে এপর্যন্ত প্রায় ৭২ হাজার খেলাপি ঋণ আদায়ের মামলা চলমান; যার সাথে জড়িত প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ৩,৮০৩টি মামলা রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটির সাথে ১০০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ জড়িত। এই মামলাগুলোর ৫০ শতাংশের বেশি মামলা ৫ বছর আগে দায়ের হওয়া।
অপরদিকে, গত ২ বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭,৫৩২টি মামলা, এরমধ্যে ২,৮৭৭টি মামলায় ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ খেলাপি ছিল। কিছু মামলা রয়েছে যেগুলোর সাথে ৫০ হাজার টাকার কম খেলাপি ঋণ জড়িত।
বড় ঋণ খেলাপির মামলা নিষ্পত্তিতে কচ্ছপ গতির তুলনায়, ৮০ শতাংশ ছোট ঋণ খেলাপির মামলা– যেসবের সাথে ২ লাখ টাকা কম অর্থ আদায় জড়িত– দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৩ এ ২০২১ সালে ৪১৯টি খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যেগুলোর সাথে জড়িত ছিল প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা।
রায়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রায় হওয়া ১৩৪টি মামলার প্রতিটির সাথে জড়িত ছিল প্রায় দুই লাখ টাকা করে; ৭৬টির প্রতিটিতে গড়ে ৫ লাখ টাকা করে; ৫৮টির প্রতিটিতে গড়ে ১০ লাখ টাকা করে; ৪৯টির প্রতিটিতে গড়ে ১৫ লাখ টাকা করে এবং ৪৪টির প্রতিটিতে গড়ে ২০ লাখ টাকা করে।
গত বছর এই আদালত মাত্র ২৮টি এমন মামলা নিষ্পত্তি করেছে যার প্রতিটিতে ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জড়িত ছিল। ১১টি মামলা ছিল যেগুলোতে এক থেকে ৫ কোটি পর্যন্ত জড়িত। ১৯টি মামলা ছিল যেগুলোতে ৫ থেকে দশ কোটি টাকা পর্যন্ত জড়িত।
আদালত সুত্রে জানা যায়, নিষ্পত্তি হওয়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জড়িত মামলাগুলোর মধ্যে ১০৩টি দায়ের হয়েছিল ২০১৮ ও ২০১৯ সালের বিভিন্ন সময়। ৯,৬০৭টি মামলার বিচার এখন পর্যন্ত চলমান। এরমধ্যে ৯৪টি মামলার সাথে ১০০ কোটির বেশি টাকা জড়িত, এসব মামলার প্রায় ৬০ শতাংশ পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে অনিষ্পন্ন রয়েছে।
এই আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ৪৭৫টি মামলার বিচার হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়ে আছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০টির ক্ষেত্রে ১০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ জড়িত। অন্যদিকে, ৮টির প্রতিটির সাথে ৫০ কোটি টাকার বেশি পরিমাণ জড়িত।
মামলা নিষ্পত্তিতে এই অসমতা কেন?
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি টিবিএসকে বলেন, প্রত্যেক অপরাধী আইনের দৃষ্টিতে সমান অপরাধী। কিন্তু বাংলাদেশে এটির বাস্তবতা ভিন্ন।
তিনি বলেন, 'বড় ঋণ খেলাপিরা বরাবরই প্রভাবশালী, ফলে নানান কারণে বরাবরই পার পেয়ে যায়। সেটি যেকোনো উপায়েই হোক না কেন। গত এক দশকে শত কোটি বা তার বেশি টাকার কোনো ঋণ খেলাপি আদালতের রায়ে দন্ডিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।'
ছোট ঋণ খেলাপিরা অপরাধী হলেও, তাদের পার পেয়ে যাওয়ার পথ খুব সহজ নয়। 'ফলে আদালতে বড় মামলাগুলো বছরের পর বছর বিচার চলতেই থাকে আর ছোটগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে'- যোগ করেন এই আইনজীবী।
তার মন্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায়- অগ্রণী ব্যাংকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম কথাতেও। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ১২৩ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিতে অভিযুক্ত লঞ্চ ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান তার পক্ষে মামলা পরিচালনায় বেশ কয়েকজন জেষ্ঠ্য আইনজীবী নিয়োগ দেন। তারা হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আনতে সক্ষম হন, ফলে প্রায় ৮ বছর বিচারকাজের অগ্রগতি বন্ধ ছিল।
আগামী ১০ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য আছে। তবে হাফিজুর রহমানের সিনিয়র আইনজীবীরা বিভিন্ন অযুহাতে শুনানি পেছানোর জন্য আবেদন করছেন। ফলে মামলার বিচার বিলম্ব হচ্ছে।
শামসুল ইসলাম আরও জানান, হাইকোর্ট থেকে আগাম ছয় মাসের জামিন নেন হাফিজুর রহমান। এরপর মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হলে আত্মসমর্পণ করে স্থায়ী জামিন পান। ফলে ১২৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মামলায় তাকে এখন পর্যন্ত জেলে যেতে হয়নি।
অন্যদিকে, খুচরা জুতা ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ মাহমুদকে ব্যাংকের দেড় লাখ টাকা দিতে না পারায় এক মাস জেলে থাকতে হয়েছে।
ইমতিয়াজ টিবিএসকে বলেন, 'ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় ব্যাংকের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হই। ব্যাংক মামলা করলে, সেই মামলা পরিচালনার মতো টাকা আমার ছিল না। এছাড়াও যদি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজস করতে পারতাম, তাহলে এই মামলাও এড়াতে পারতাম। কিন্তু, সেরকম অর্থিক বা যোগাযোগ করার মতো অবস্থা আমার ছিল না'।
তিনি বলেন, 'ভালো আইনজীবীও নিয়োগ দিতে পারিনি অর্থের অভাবে। এই মামলায় এক মাস জেল খাটতে হয়েছে। অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিল হাইকোর্টে আবেদন করতে, টাকার অভাবে সেটিও পারিনি'।
বাংলাদেশে ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম বলেন, 'ছোট মামলাগুলোয় জটিলতা কম থাকে। এসব মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ বা শুনানিতে বেশি সময় প্রয়োজন হয় না। ফলে রায় দ্রুত আসে'।
এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ (রুমী) আলি বলেন, মামলা নিষ্পত্তির বিষয় নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট আদালতের ওপর।
খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী- প্রতিটি জেলায় পৃথক অর্থঋণ আদালত এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দুই-তিন জেলায় পৃথক আদালত রয়েছে। বাকি সব জেলায় অন্যান্য মামলার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ মামলার বিচারকার্য চলে। 'মামলা নিষ্পত্তির বিলম্বের পেছনে এটিও একটি কারণ হতে পারে'।
তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্থবির আর্থিক খাতের বড় কেলেঙ্কারির বিচার
২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়, যা ছিল এককভাবে দেশের সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা।
২০১৫ সালে এই কেলেঙ্কারিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ৫৬টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু, এসব মামলায় ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান বা পরিচালক বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি। ২০১৭ সালে আরও পাঁচটি মামলা করে দুদক।
এসব মামলার বিচার শুরু হওয়ার দূরের কথা, গত সাত বছরে দুদক এখন পর্যন্ত মামলা তদন্ত করে চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তিনবার তলব করলেও, তা কোনো কাজে আসেনি। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে এই মামলার তদন্ত সম্পন্ন করতে তিন মাস সময় দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
রপ্তানি না করেও ভুয়া রপ্তানি বিলের মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৯ সালে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদেরসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এই মামলার তদন্তও এখনো শেষ হয়নি।