রোমাঞ্চ জাগিয়ে হেরে গেল বাংলাদেশ
কিছু রান কম করার আক্ষেপ তো ছিলই। এরচেয়ে বড় আক্ষেপ হয়ে রইলো মুমিনুল হকের ওই ক্যাচ মিস। বাংলাদেশের সাবেক টেস্ট অধিনায়ক যেন রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ক্যাচ ফেলেননি, ম্যাচটাই মুঠো থেকে ফেলে দিয়েছেন। ১ রানে জীবন পেয়ে শ্রেয়াস আইয়ারের সঙ্গে জুটি গড়লেন ভারতের অভিজ্ঞ স্পিনার, যে জুটি আর ভাঙতেই পারলো না বাংলাদেশ। রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে রোমাঞ্চকর জয় তুলে নিলো ভারত।
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ৩ উইকেটে হেরে গেছে বাংলাদেশ। এই হারে দুই ম্যাচের সিরিজে হোয়াইওটয়াশ হলো সাকিব আল হাসানের দল। ভারতের বিপক্ষে খেলা ১৩ টেস্টের ১১টিতেই হারলো বাংলাদেশ। বাকি দুই ম্যাচ ড্র হয়, সেটাও বৃষ্টির কল্যাণে। এবার অবশ্য লড়াকু বাংলাদেশকে দেখা গেল, কিন্তু পরিণতি সেই একই; বিষাদে মোড়ানো।
এই টেস্টে অনেক ভুলই করেছে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে হতশ্রী ব্যাটিংয়ের পর ফিল্ডিং মিসের মহড়া চলে। ক্যাচ মিস, স্টাম্পিং মিসে পিছিয়ে পড়তে হয় প্রথম ইনিংসেই। দ্বিতীয় ইনিংসেও ব্যাট হাতে উজ্জ্বল ছিলো না বাংলাদেশ, তবু মেলে লড়াইয়ের পূঁজি। পরে বল হাতে দারুণ শুরু করে সম্ভাবনা জাগিয়ে তৃতীয় দিনের সমাপ্তি। চতুর্থ দিন সকালেও ছিল বাংলাদেশের দাপট। কিন্তু সব ভুল ছাপিয়ে মুমিনুলের একটি ক্যাচ মিস হয়ে রইলো চরম আক্ষেপের।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ। যার ক্যাচ মিসে হতাশায় ডুবতে হয়েছে দলকে, সেই মুমিনুলই প্রথম ইনিংসে পথ দেখান। যদিও তার ৮৪ রানের পরও ঘরের মাঠের দলটি ২২৭ রানে অলআউট হয়ে যায়। জবাবে প্রথম ইনিংসে ৩১৪ রান তোলে ভারত, এই ইনিংসেই ৮৭ রানে এগিয়ে যায় তারা।
জাকির, লিটন, সোহান, তাসকিনদের ব্যাটে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩১ রান তুললে ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৪৫ রান। ছোট লক্ষ্য হলেও দ্রুত উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে ভারত। চতুর্থ দিন অষ্টম উইকেটে ৭১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছান শ্রেয়াস ও ম্যাচসেরা অশ্বিন। বল হাতে পথ দেখানোর পর ব্যাট হাতে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন অশ্বিন।
সামান্য এই পুঁজিতে আর কতোটাই লড়াই করা সম্ভব! বাংলাদেশ হয়তো এমন আশাই করেনি। কিন্তু তৃতীয় দিনের শেষ বিকেলে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের দেখা মেলে। ম্যাচের আড়াই দিন নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ভারতকে দিক ভুলিয়ে দেন সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। তাদের স্পিন ছোবলে দিশেহারা হয়ে পড়ে লোকেশ রাহুলের দল।
বিশেষ করে মিরাজের বিপক্ষে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় ভারতকে। তৃতীয় দিন শেষ বিকেলে ৩৭ রানেই ৪ উইকেট হারায় তারা, তিনটিই ছিল মিরাজের শিকার। ২৩ ওভারে ৪ উইকেটে ৪৫ রান তুলে তৃতীয় দিন শেষ করে ভারত। অক্ষর প্যাটেল ২৬ ও নাইট ওয়াচম্যান জয়দেব উনাদকাত ৩ রানে অপরাজিত থাকেন।
ভারতের ইনিংসে আঘাত হেনে শুরুটা করে দেন সাকিব। পরে অধিনায়কের সুরে সুর মিলিয়ে স্পিন ঘূর্ণিতে রাজত্ব করেন মিরাজ। ভারতের ইনিংসের তৃতীয় ওভারেই তোপ দাগেন সাকিব, ফিরিয়ে দেন ভারত অধিনায়ক লোকেশ রাহুলকে। এই ওভারে সাকিবের করা প্রথম বলেই ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন লোকেশ, অসাধারণ দক্ষতায় তা তালুবন্দি করেন নুরুল হাসান সোহান।
চার ওভার পর স্পিন ঘূর্ণিতে জেতেশ্বরকে বিভ্রান্ত করেন মিরাজ। এগিয়ে এসে ডিফেন্স করার চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু ব্যাটে-বলে করতে পারেননি। একটু দেরিতে ধরলেও চেতেশ্বর পপিং ক্রিসে ফেরার আগেই স্টাম্প ভাঙেন সোহান। ১২ রানেই লোকেশ রাহুল ও পূজারাকে হারিয়ে বিপাকে পড়ে ভারত। শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন শুভমান গিল ও অক্ষর প্যাটেল।
যদিও এই জুটি বড় হতে দেননি মিরাজ। ৭ রান করা শুভমানকে ফিরিয়ে নিজের দ্বিতীয় উইকেট তুলে নেন ডানহাতি এই অফ স্পিনার। তৃতীয় দিনের শেষ বিকেলে মিরাজের সর্বশেষ শিকার বিরাট কোহলি। তার বলে শর্ট লেগে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ভারতের তারকা এই ব্যাটসম্যান। ৮ ওভারে ১২ রান খরচায় ৩টি উইকেট নেন মিরাজ। ৬ ওভারে ২১ রানে একটি উইকেট নেন সাকিব।
হাতে দুই দিন ও ৬ উইকেট, ১০০ রান তোলাটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ না হলেও ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় কঠিন অবস্থাতেই পড়ে যায় ভারত। লোকেশ রাহুল, জেতেশ্বর পূজারা, শুভমান গিল ও বিরাট কোহলিদের সবাই যে ব্যর্থ হন। টিকে থাকা অক্ষরের সঙ্গে চতুর্থ দিনে ভারতের ভরসা ছিল ঋষভ পন্ত, শ্রেয়াস আইয়ার। ৫টি টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক অশ্বিনেও আস্থা ছিল তাদের, আর তার ব্যাটেই লেখা ভারতের জয়।
১০০ রান করার মিশন নিয়ে চতুর্থদিন সকালে মাঠে নামে ভারত। এদিন শুরুতেই ছক্কা মেরে ভীতি ছড়ান উনাদকাত। যদিও ভারতীয় পেসারকে বেশি সময় টিকতে দেননি সাকিব। এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে তাকে ফিরিয়ে দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ১৬ বলে ১৩ রান করে ফেরেন উনাদকাত।
এরপর উইকেটে যান সবচেয়ে বড় হুমকি ঋষভ পন্ত। নেমেই রান তুলতে থাকেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান, বেশ সাবলীলই মনে হচ্ছিল তাকে। কিন্তু মিরাজের স্পিন ঘূর্ণিতে বেশি সময় টিকতে পারেননি ভারতের আশা-ভরসার প্রতীক। ১৩ বলে ৯ রান করে মিরাজের এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন পন্ত।
৪ উইকেট তুলে নেওয়া মিরাজ কিছুক্ষণ পর আবারও ঝলক দেখান। এবার তার শিকার আগেরদিন ভারতকে পথ দেখানো অক্ষর প্যাটেল। মিরাজের নিচু হয়ে যাওয়া বল ব্যাকফুটে খেলার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু বল প্যাডে লেগে স্টাম্প ভেঙে দেয়। ৬৯ বলে ৩৪ রান করে ফিরে যান অক্ষর।
জয় থেকে বাংলাদেশ তখন মাত্র ৩ উইকেট দূরে। কিন্তু এমন সময়ে জুটি বাধলেন শ্রেয়াস-অশ্বিন, তাদের আর থামানোই গেল না। দুইজনই খেললেন মহাগুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। চাপ কাটিয়ে তুলে তাদের ১০৫ বলে ৭১ রানের হার না মানা জুটিতে সহজেই জয় তুলে নেয় ভারত। অশ্বিন ইনিংসেরা ৪২ ও শ্রেয়াস ২৯ রানে অপরাজিত থাকেন।
ভারতকে দিক ভুলিয়ে দেওয়া বাংলাদেশের ডানহাতি স্পিনার মিরাজ ১৯ ওভারে ৬৩ রানে ৫টি উইকেট নেন। সাকিবের শিকার ২ উইকেট। আগের ইনিংস সাকিব নেন ৪ উইকেট। ওই ইনিংসে তার সঙ্গে সুর মেলানো তাইজুলও নেন ৪ উইকেট। প্রথম ইনিংসে মিরাজ পান একটি উইকেট।