তারল্য সংকটে চাপে থাকবে ব্যাংকিং খাত
ব্যাংকিং খাতে এখন যেসব সমস্যা হচ্ছে, এগুলো আরেকটু গভীরতর হওয়ার শঙ্কা আছে নতুন বছরে। বিশেষ করে, ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাবে। তাদের যে পরিমাণ তারল্য সমর্থন দরকার, তারা হয়তো সাপোর্টটা সেভাবে পাবে না। কারণ, আমাদের ঋণ যেভাবে বেড়েছে, আমানত সেভাবে বাড়েনি। ফলে কিছুটা তারতম্য থাকবে।
বিভিন্ন সময়ে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণকে– টার্ম লোনে রূপান্তর করে সময় বাড়িয়ে দেওয়াও ব্যাংকগুলোতে নতুন বছরে তারল্যতে টান পড়ার একটা কারণ। এমন না করলে ঋণগুলো ব্যাংকের কাছে ফেরত আসতো। তখন ব্যাংক আবার ঋণ দিতে পারতো। এসব দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এবছর টাকাপয়সার একটু টান থাকবে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বিশেষ করে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য একটু অসুবিধা হবে।
সামনের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস করা হবে, সেটি অর্জন করা হবে কঠিন। অবশ্য প্রবৃদ্ধি কম হলে– সেটি আবার মূল্যস্ফীতির চাপকে কমিয়ে রাখবে, এটা একটা ইতিবাচক প্রভাব। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সমর্থন দিয়ে রাখলে ব্যাংকগুলো একটু স্বস্তি পাবে।
এছাড়া, ব্যাংকগুলোকে ২০২৩ সালে তারল্য ও ঋণ ব্যবস্থাপনা বিচক্ষণতার সাথে করতে হবে। সঞ্চয় ও মূল্যস্ফীতির বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, ব্যাংকগুলোর জন্য বাজার থেকে বাড়তি টাকা পাওয়াটাও কঠিন হবে। অর্থাৎ, ব্যাংক খাতকে স্বাভাবিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ব্যাংক চ্যানেলে টাকার সংকট থাকলেও, সব দিক বিবেচনা করে মনে হচ্ছে, নতুন বছরে বৈদেশিক মুদ্রার তারল্যের অবস্থা আমাদের ভালো থাকবে। কারণ, ২০২৩ সালে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২০২২ সালের তুলনায় কম ডলার কিনতে চাইবে। ২০২০ সালে অনেকগুলো এলসি নিষ্পত্তি ডেফার করে দেওয়া হয়েছিল, যেগুলো গতবছরের মার্চে ম্যাচিউরড হয়। ফলে আমাদের দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ও ট্রেড ব্যালেন্সে একটা বড় রকমের ধাক্কা ছিল।
আশা করছি, নতুন বছর এমন থাকবে না। এছাড়া রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আরো বাড়তে পারে। কোভিডের কারণে চীনে উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে বলে অনেক পোশাক রপ্তানি অর্ডার আমাদের দেশে চলে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অব্যাহতভাবে ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রা ও টাকার তারল্য এবং নীতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরণের সাপোর্ট সামনের বছরও দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে, যাতে করে ব্যাংকগুলো এগোতে পারে। এই সাপোর্ট না পেলে অনেক ব্যাংকই অসুবিধায় পড়ে যাবে।
ব্যাংকগুলোর পক্ষে ডিজিটালাইজেশন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি থেকে ফেরত আসার সুযোগ নেই। নতুন বছরে ব্যাংক চ্যানেলে নতুন নতুন প্রযুক্তি সংযোজন ও ব্যবহার আরো বাড়বে। যেসব ব্যাংক নিজেদের জন্য প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে দেরি করবে বা কার্পণ্য করবে, তাদের পক্ষে ব্যবসা ধরে রাখা মুশকিল হবে। কারণ, গ্রাহকদের একটা বড় অংশ এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাংকিং- এ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ব্যাংকিং সেবায় তারা টেকনোলজির ব্যবহার দেখতে চায়। সেই অর্থে ব্যাংকগুলোকে ফিনটেক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বে গিয়ে নতুন টেকনোলজিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
এছাড়া, জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রামীণ অংশগ্রহণ বাড়াতে– ব্যাংকগুলোকে গ্রামেগঞ্জে তাদের পরিধি সম্প্রসারণ করতে হবে।
ব্যাংকিং খাত এখন কিছুটা শিথিলভাবে চালিত হচ্ছে। কর্পোরেট গভর্নেন্সকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পুঁজি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকগুলোর আরো মনোযোগী হওয়াও দরকার। না। তা নাহলে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিছু মন্দ ব্যাংকের জন্য, ভালো ব্যাংকও দুর্ভোগের শিকার হবে। সবশেষে, নতুন বছরে আমাদের ব্যাংকখাতকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
আরফান আলী ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন টিবিএসের প্রতিবেদক তন্ময় মোদক