আবেগতাড়িত বুদ্ধিমানরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন? বেজোসসহ বিশেষজ্ঞদের চার পরামর্শ
কর্মক্ষেত্রে বা ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিদিনই ছোটবড় নানা সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাদের। কখনো কখনো আমরা বুঝে উঠতে পারি না কোন সিদ্ধান্তটি আমাদের জন্য সবচেয়ে উপকারী। অনেক সময় একটা ছোট ভুল সিদ্ধান্তের জন্য জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আবার দেখা যায়, বিপদে পড়ে সাহায্য দরকার হলেও মুখ ফুটে তা চাইতে পারেন না কিংবা প্রথম দেখায় কারও মনে নিজের ব্যাপারে সুন্দর ধারণা সৃষ্টির উপায় জানেন না অনেকেই।
সবচেয়ে বড় কথা, সুস্থ-সুন্দর ও কার্যক্ষম জীবনযাপনের ইচ্ছা সবারই থাকে। কিন্তু এই কাঙ্ক্ষিত জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতি জানা না থাকায় হোঁচট খান কেউ কেউ। ইনক ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে বিজ্ঞানভিত্তিক চারটি নিয়মের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো অনুসরণের মাধ্যমে উপরের অনেকগুলো সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে এবং নিজের জীবনকে আরও সুন্দর করে তোলা সম্ভব হবে।
সিদ্ধান্ত নেওয়া: 'টু-ওয়ে-ডোর' নীতি
প্রথমেই আপনার উদ্দেশ্য কী, প্রধান কোন কাজটি করতে চান, তা নিয়ে ভাবতে হবে। আপনি যদি আর দশটা মানুষের মতো হন, তাহলে প্রথমেই ভাবতে বসবেন সম্ভাব্য প্রতিকূলতার কথা।
ধরুন, একটা ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন, কিন্তু তাতে যদি ব্যর্থ হন? ক্যারিয়ারের মোড় বদলাতে গিয়ে যদি ধাক্কা খান? নতুন জায়গায় বদলি হতে চাচ্ছেন, কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি পুরনো বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের ভীষণ মিস করতে শুরু করেন? এরকম পরিস্থিতিতে আপনার আবেগ আপনার বিরুদ্ধে কাজ করে, পক্ষে নয়। বিশেষ করে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবতে ভাবতে আপনি অসাড় অনুভব করেন। আপনার কাছে মনে হয় এ সবই 'ওয়ান-ওয়ে-ডোর ডিসিশন', অর্থাৎ এমন সিদ্ধান্ত যা পরিবর্তনযোগ্য নয়।
অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও বিলিয়নিয়ার জেফ বেজোসের মতে, সিদ্ধান্ত মূলত দুই প্রকারের হয়। প্রথমত, 'ওয়ান-ওয়ে-ডোর'—যে সিদ্ধান্তগুলো একবার নিয়ে ফেললে তা পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব। যেমন কোনো কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা, ব্যবসা বিক্রি করে দেওয়া, কোনো সরবরাহকারীর সাথে সম্পর্কের ইতি টানা ইত্যাদি। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, একবার এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে আর পিছু হটার সুযোগ থাকে না। (বেজোস এগুলোকে 'টাইপ ১' সিদ্ধান্ত বলেও অভিহিত করেছেন)।
দ্বিতীয়ত, 'টু ওয়ে ডোর'—এ সিদ্ধান্তগুলো পরিবর্তন বা বাতিল করা সম্ভব। যেমন নতুন কর্মী নিয়োগ, উপরি কোনো ব্যবসা বা চাকরি, নতুন ধরনের সেবা দেওয়া, নতুন প্রাইসিং মডেল তৈরি ইত্যাদি। বেজোসের ভাষায় 'টাইপ ২' নামের পরিচিত এই সিদ্ধান্তগুলোকে প্রথম দফায় জীবন-মরণ সিদ্ধান্ত বলে মনে হলেও, সত্যিটা হচ্ছে এসব সিদ্ধান্ত পাল্টানো যায় বা সংশোধন করা যায়।
বেজোস বলেন, 'আপনি যদি "টু-ওয়ে-ডোর" সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে খুব বেশিদিন এর ফল ভোগ করার চাপ মাথায় নিয়ে কাটাতে হবে না। কারণ যেকোনো সময় এসব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা সম্ভব।'
তাই এরপর যখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় পড়বেন, তখন এক ধাপ পিছু হটে চিন্তা করতে হবে, আপনার সিদ্ধান্তটি টাইপ ১ নাকি টাইপ ২ হতে যাচ্ছে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তবে কখনো কখনো 'টু-ওয়ে-ডোর' সিদ্ধান্তও ভুল প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা নেই। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে যে আপনি সেই ভুল শুধরে নিতে পারবেন এবং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠবেন।
তবে কিনা বেজোসের ভাষ্যমতে, 'আপনাকে দ্রুত উপলব্ধি করতে হবে যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেটি শুধরে নেওয়ার উপায়ও খুঁজতে হবে।' আর এটাও শুরু হবে 'ওয়ান-ওয়ে-ডোর ও টু-ওয়ে-ডোর' সিদ্ধান্তের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারার মাধ্যমে। কারণ তখনই আপনি সময়োপযোগী ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করবেন।
সাহায্য দরকার? 'বিওয়াইএএফ' নীতি অনুসরণ করুন
মনে করুন তো শেষবার কবে আপনার কাছে কেউ সাহায্য চেয়েছে? বেশিরভাগ মানুষই এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা শঙ্কিত বোধ করে, আবার কেউ কেউ আত্মরক্ষামূলক আচরণও করে। কারো অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে যতই মনে হবে যে 'না' বলার সুযোগ নেই, সেই অনুরোধটি মূল্যায়নের দিক থেকে আপনার মনোযোগ তত বেশি সরে আসবে। আবার একইসাথে আপনি আরও বেশি 'না' বলার উপায় খুঁজতে থাকবেন।
কমিউনিকেশন স্টাডিজে প্রকাশিত চল্লিশটিরও বেশি গবেষণার একটি রিভিউ প্রকাশ করা হয় ২০১৩ সালে। সেখানে বলা হয়েছে, 'but you are free', সংক্ষেপে (বিওয়াইএএফ) নীতি মেনে কাউকে অনুরোধ করলে অপরপক্ষের জন্য এর জবাব দেওয়াটা সহজ হয়। গবেষকদের মতে, আপনাকে অনুরোধটি এমনভাবে করতে হবে যাতে অপরপক্ষের মনে না হয় যে, তার 'না' বলার মতো অবস্থা নেই।
যেমন আপনি বলতে পারেন 'আমরা স্বেচ্ছাসেবী খুঁজছি, কিন্তু আপনার ইচ্ছা না থাকলে "না" বলতে পারেন।' কিংবা এ-ও বলতে পারেন, 'আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন? আমি জানি আপনি ব্যস্ত আছেন, তাই "না" বলতে দ্বিধা করবেন না।'
আবার এভাবেও বলতে পারেন—'আমি বুঝতে পারছি আপনার হাতে সময় নেই, কিন্তু তবুও একটু সাহায্য করতে পারবেন কি?'
সত্যি বলতে কী, প্রায় সব মানুষই চায় দয়ালু হতে। সবাই চায় অন্যের কাছে উপকারী হতে এবং নিজের কাজের মাধ্যমে পার্থক্য গড়তে। গবেষকদের মতে, কাউকে অনুরোধ করার সময় যদি তার সামনে 'না' বলার সুযোগ রাখা হয়; তাহলে ওই ব্যক্তির 'হ্যাঁ' বলার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়ে যায়!
অর্থাৎ আপনাকে এটুকু বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তা করতে হবে যে কাউকে সাহায্য করার জন্য বাধ্য করা যাবে না, তার হাতে বিকল্প রাখতে হবে। এরপরে তারা চাইলে সাহায্য করতেও পারে, না-ও করতে পারে।
প্রথম দেখায়ই সুন্দর প্রভাব রাখার উপায়
শেষবার কবে নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে? মনে মনে ভাবুন, পরবর্তী ১০ মিনিটে আপনারা একে অপরকে চারটি প্রশ্ন করতে পারেন:
—জীবনে কোন বিষয়টির জন্য আপনি সবচেয়ে কৃতজ্ঞ?
—কেউ যদি আপনি, আপনার জীবন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সব সত্যি বলতে পারত, তাহলে আপনি কী জানতে চাইতেন তার কাছে?
—বাইরের কোনো মানুষের সামনে কখনো কেঁদেছেন?
—অপর ব্যক্তিটির সঙ্গে যদি আপনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতে চান, তাহলে তাকে এমন কোনো তথ্য জানান যা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্নগুলো পড়ে অদ্ভুত ঠেকছে না? নিশ্চয় ভাবছেন, অপরিচিত মানুষকে এসব প্রশ্ন কীভাবে করা যায়?
কিন্তু গবেষকরা বলছেন উল্টো কথা। জার্নাল অব পারসোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজিতে প্রকাশিত একাধিক গবেষণার অংশ হিসেবে তারা এই পরীক্ষাটি চালিয়েছিলেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে উল্লিখিত চারটি প্রশ্নে তারা বিব্রতবোধ করেননি, বরং একাত্মবোধ করেছেন এবং কথা বলে আনন্দ পেয়েছেন।
শুরুতে অংশগ্রহণকারীরা অনুমান করেছিলেন, অপরিচিত কেউ যদি তাদের প্রশ্ন করে—'আপনার জীবনের সবচেয়ে বিব্রতকর মুহূর্ত কোনটি?', তাহলে হয়তো তাদের অস্বস্তি বোধ হবে। কিন্তু কথপোকথন শেষে দেখা গেল, হয়েছে তার উল্টো। বরং আপাতদৃষ্টিতে 'বিব্রতকর' প্রশ্নগুলো নিয়ে আলাপ করতেই তারা বেশি মজা পাচ্ছিলেন এবং একে অপরের প্রতি টান অনুভব করেছিলেন।
তবে মনে রাখতে হবে, এ ধরনের কথপোকথনে কারও ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে কোনো 'জাদুকরী' প্রশ্নের দরকার হয় না কিংবা কোনো নির্দিষ্ট নিয়মও নেই। উল্লিখিত চারটি প্রশ্নের বাইরেও অসংখ্য প্রশ্ন করতে পারেন। যেমন, জীবনে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে সবচেয়ে বেশি অনুশোচনা হয়? কী করতে সবচেয়ে ভালোবাসেন? আগামী ৫ বছর পর নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চান? ... এসব প্রশ্নের মাধ্যমেও আপনি কথপোকথন চালিয়ে নিতে পারবেন।
কথাবার্তা চলার সময় অবশ্যই অপরপক্ষের কথা মন দিয়ে শুনতে হবে, সাড়া দিতে হবে। প্রথমে ছোটখাটো প্রশ্ন দিয়ে আরম্ভ করে আস্তে আস্তে গভীরে যেতে পারেন; ব্যক্তির কর্মজীবন নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। আপনি যদি আগ্রহ দেখান, তাহলেই অপরপক্ষ আরও মনে খুলে কথা বলার সুযোগ পাবে। এভাবেই আপনাদের কথপোকথন অর্থবহ হয়ে উঠবে এবং দুজনেই আনন্দিত ও পরিপূর্ণ বোধ করবেন।
জীবনকে সুন্দর করতে চান? অভিযোগ করা চলবে না!
কেউ আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করলে বা অবহেলা করলে স্বভাবতই আমাদের ভীষণ মন খারাপ হয় এবং ক্ষোভ উগড়ে দিই। কারণ আমাদের ধারণা, মনের মধ্যে কিছু পুষে না রাখা আমাদের জন্য ভালো। কষ্ট চেপে রাখলেই বরং পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যায়।
কিন্তু ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ওয়ার্ক অ্যান্ড অর্গানাইজেশনাল সাইকোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, কোনোকিছু নিয়ে অভিযোগ করতে থাকলেই বরং আপনার আরও খারাপ লাগবে। গবেষকরা বলছেন, বাজে ঘটনা ঘটার সময়ে বা এর পরপরই তা নিয়ে আলোচনা করলে আমাদের মস্তিষ্কে ওই নেতিবাচক অনুভূতি বারবার ফিরে আসে। এর ফলে আমাদের স্মৃতির মধ্যে এটি গেঁথে যায় এবং আবেগীয় দিক থেকে আমাদের প্রভাবিত করে।
নেতিবাচক কোনো ঘটনা নিয়ে অভিযোগ করতে থাকলে আমরা সহজে ওই ঘটনা ভুলতে পারি না। বাজে স্মৃতি মুছে ফেলে সামনে এগিয়ে না গিয়ে উল্টো অভিযোগ করতে থাকলে আমাদের সব কর্মকাণ্ডে ওই নেতিবাচকতা ঘুরেফিরে আসে। গবেষকরা দেখেছেন, যারা অভিযোগ করেন তাদের মনমেজাজ খারাপ থাকে এবং কাজের মধ্যে কোনো তৃপ্তি পান না। ফলে তাদের জীবনের আনন্দ হালকা হতে থাকে এবং পরবর্তীতে তাদের আত্মমর্যাদাবোধ আরও কমে যায়।
তবে অভিযোগ করা যাবে না মানে এই নয় যে আপনার সাথে যা কিছুই ঘটুক, তা মুখ বুজে শুধু সহ্য করতে হবে। কিন্তু নেতিবাচক ঘটনাটি মনের মধ্যে গেঁথে ফেলা যাবে না এবং সারাক্ষণ শুধু সেটা নিয়েই চিন্তা করা যাবে না।
ইনক ম্যাগাজিনের লেখক জাস্টিন বারিসোর ভাষ্যে, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা আবেগতাড়িত বুদ্ধিমত্তা মানে নিজের আবেগকে নিজের সুবিধার্থে কাজে লাগানো, নিজের বিরুদ্ধে নয়।
তাই অভিযোগ করে সময় নষ্ট করার বদলে কীভাবে নিজের অবস্থার উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। আগামী দিনগুলোকে কীভাবে সাজাবেন, সেই পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে আবারও সেই নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।
অন্যদের সাথে কথপোকথনের সময় হোক বা নিজে চিন্তাভাবনার সময়, সবসময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকরা এই ইতিবাচক মনোভাবকেই 'স্পোর্টসম্যানলাইক' বা খেলোয়াড়সুলভ আচরণ বলে অভিহিত করেছেন। এটি এমন এক দক্ষতা যা অনুশীলন ও পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব।