চীনের পতনমুখী জনসংখ্যা দেশটির ভবিষ্যতের ওপর যেভাবে প্রভাব ফেলবে
কয়েক দশক ধরে বেশিরভাগ পরিবারকে এক সন্তান নীতিতে সীমাবদ্ধ রাখার পর চীন এখন বলছে, আরও বেশি করে সন্তান গ্রহণ করতে। চীনের নীতিতে এ সহসা পরিবর্তনের কারণ হলো, দেশটিতে গত ছয় বছর একটানা জন্মহার পতনমুখী হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকের পর দেশটিতে এ প্রথমবারের মতো জনসংখ্যা কমেছে।
এর পাশাপাশি চীনে কর্মক্ষম জনসংখ্যাও কমতির দিকে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের এক চতুর্থাংশ মানুষের বয়স হবে ৬০ বা তার বেশি। আর তা-তে হুমকির মুখে পড়বে দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের তকমাটিও ভারতের কাছে হারাতে পারে এটি।
১. কী পদক্ষেপ নিচ্ছে চীন?
এক সন্তান নীতি বাদ দেওয়ার পাঁচ বছর পরে ২০২১ সালে চীনের পলিটব্যুরো দম্পতিদের তৃতীয় সন্তান গ্রহণের অনুমতি দেয়। নীতি বদলে দুই সন্তান হওয়ার পর তার প্রাথমিক সুফল পায় চীন। ২০১৬ সালে এর আগের বছরের তুলনায় এক মিলিয়ন বেশি শিশু জন্মায় চীনে। সেবছর মোট ১৭.৯ মিলিয়ন নতুন শিশু জন্ম নিয়েছিল চীনে।
কিন্তু এর পরের প্রতি বছরে আবারও দেশটিতে জন্মহার কমতে শুরু করে। ১৯৫০ সালের পর ২০২২ সালে সবচেয়ে কম সংখ্যক — ৯.৫৬ মিলিয়ন শিশুর জন্ম হয় চীনে। বর্তমানে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য প্রণোদনা দিতে শুরু করেছে চীনের সরকার।
২. কতটা কমেছে চীনের জনসংখ্যা?
২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে চীনের জনসংখ্যা ৮৫০,০০০ কমেছে। দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরোর অনুমান, জন্মহার কমার এ প্রবণতা চলমান থাকবে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, 'বাচ্চা নেওয়ার আগ্রহ কমে যাওয়া, বিয়ে ও গর্ভাবস্থায় দেরি, এবং গর্ভধারণের উপযুক্ত বয়সের নারীর সংখ্যা কমে যাওয়া।'
চীনে গত এক দশকে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে ৭০ থেকে ৬২ শতাংশে নেমে গিয়েছে। ব্লুমবার্গ ইকোনোমিকস-এর ধারণা অনুযায়ী, ২০৫০ সালে চীনের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে দাঁড়াবে ৬৫০ মিলিয়নে, যা ২০২০-এর তুলনায় ২৬০ মিলিয়ন কম।
দেশটির ফার্টিলিটি রেট তথা একজন নারীর সারাজীবনে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সংখ্যার গড় ২০২০ সালে ১.৩-এ পতিত হয়। কিন্তু অভিবাসীদের হিসেব বাদ দিয়ে জনসংখ্যার স্থিতিশীল বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ২.১ ফার্টিলিটি রেটের।
২০১৯ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ ধারণা করেছিল, ২০৩১ সালে চীনের জনসংখ্যা আরও বাড়বে। কিন্তু গতবছর এ অনুমান বদলে দেয় সংস্থাটি। জাতিসংঘের পূর্বাভাস, ২০৫০ সালের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা ১১০ মিলিয়ন কমবে এবং এ শতকের শেষ নাগাদ দেশটির জনসংখ্যা কমে বর্তমান সংখ্যার অর্ধেকে পরিণত হবে।
৩. এর প্রভাব কী হবে?
কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে গেলে চীনে শ্রমের দাম বেড়ে যেতে পারে, তার ফলে বাড়তে পারে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যও। দেশটির পেনশন তহবিলের ওপরও চাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জনসংখ্যা পতনের 'রিপল' প্রভাব পড়তে পারে চীনের বাইরেও।
চীনারা ঐতিহ্যগতভাবেই ছেলে সন্তানে আগ্রহী। এ কারণে মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে গর্ভপাত বেশি হওয়ার ফলে চীনের অনেক প্রদেশে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ১২০:১০০-এ পরিণত হয়েছে।
৪. এক সন্তান নীতির উৎস ও সমস্যার সমাধান
মৃত্যুহার হ্রাস ও জন্মহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ১৯৫৩ সালে চীন প্রথমবারের মতো পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারপরও ১৯৬০-এর দশকে চীনের জনসংখ্যা ৮০০ মিলিয়নে পৌঁছে যায়। পরের দশকে খাদ্য ও বাসস্থান সংকট শুরু হয় দেশটিতে। ১৯৭৯ সালে চীনের নেতা ডেং শাওপিং বেশিরভাগ দম্পতির জন্য এক সন্তান নীতি চালু করেন।
চীনের বর্তমান জনসংখ্যা সমস্যার কিছুটা সমাধান মিলতে পারে দেশটিতে অবসরের বয়সসীমায় পরিবর্তন আনা। তবে এমন নীতি জনগণ হাসিমুখে মেনে নেবে না। প্রায় এক দশক আগে এমন পদক্ষেপের আলোচনা শুরু হলে বিক্ষোভ প্রকাশ করেন চীনা নাগরিকেরা।
সন্তান গ্রহণের নীতিমালা তুলে দেওয়ার পাশাপাশি চীনের সরকারকে পরিবারগুলোর জন্য প্রি-স্কুল, স্কুলের মতো সহায়তাব্যবস্থা, এবং আর্থিক প্রণোদনা বা কর অবকাশ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্য ইতোমধ্যে পরিবারগুলোকে সন্তান গ্রহণের নিশ্চয়তা দিতে চীনের সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ জন্মহার বাড়াতে গিয়ে তীব্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। চীনের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ব্লুমবার্গ থেকে সংক্ষেপে অনূদিত