সোনালী ব্যাংকের বেশি সুদের তহবিলের দিকে ঝুঁকছে সংকটে থাকা ইসলামী, আল-আরাফাহ, ন্যাশনাল ব্যাংক
বর্তমানে বাণিজ্যিক পর্যায়ে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহারেই – রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের মতো বেসরকারি ব্যাংক।
কোনো ব্যাংক তারল্য বা নগদ অর্থ সংকটে পড়লে, আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারের মাধ্যমে অপর ব্যাংক থেকে থেকে অর্থ ধার করতে পারে – যেখানে সুদের হারও বাণিজ্যিক হারের চেয়ে কম। কিন্তু, বেসরকারি এ তিনটি ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় যে তারা আরেকটি ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক পর্যায়ের সর্বোচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী, অটো লোন এবং পার্সোনাল লোনের মতো ভোক্তা ঋণ– যে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার ১২ শতাংশ– ব্যতীত অন্য সব ধরনের ঋণের ওপর ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৯% সুদ নিতে পারে।
তবে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অনুকূলে ফান্ড প্লেসমেন্ট খাতে ২০০ কোটি টাকা এবং আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এর অনুকূলে ৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ অনুমোদন করেছে জিয়াউল হাসান সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। ৯০ দিন মেয়াদে ৯% সুদ হারে এই তহবিল দেওয়া হচ্ছে।
পরিচালনা পর্ষদ একইদিনে, ন্যাশনাল ব্যাংকের নেওয়া ১৫০ কোটি টাকার ঋণের মেয়াদ পূর্বের সুদ পরিশোধ সাপেক্ষে ৯% সুদে আরো ছয় মাস মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবও অনুমোদন করেছে।
অন্যদিকে, গড় ওভারনাইট কলমানি রেট – বা যে সুদ হারে ব্যাংকগুলো একে অন্যের থেকে একদিনের জন্য টাকা ধার করে – তা গতকাল ৬.৭৫ শতাংশ ছিল বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে।
ব্যাংকিং শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ বিতরণে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই এই ব্যাংকগুলোর বর্তমান তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে দুটি ইসলামী ব্যাংকের নির্ধারিত সুদহারে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ্ বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন তালুকদার। তার মতে, এটি শরিয়াহ্-ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার নীতি-বিরুদ্ধ কাজ হয়েছে।
তিনি বলেন, 'ইসলামী ব্যাংকের সুদে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ নেই। আমি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইব'।
১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে ন্যাশনাল ব্যাংককে
গতকাল (২৩ জানুয়ারি) এক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, একক কোনো গ্রাহককে ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিতে হলে এখন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে ন্যাশনাল ব্যাংককে। পাশাপাশি নগদ আদায় ছাড়া পুরোনো ঋণ নবায়ন করা যাবে না।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শতভাগ নগদ টাকা জমা ছাড়া কোন ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন বলেন, 'ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছেন। এজন্য ব্যাংকটিতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। বড় ঋণ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে'।
গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা – যা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ, ব্যাংকটির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ২৭.৪৬ শতাংশ।
ব্যাংকটির এই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১৮ জানুয়ারি 'ব্যক্তিগত কারণ' দেখিয়ে পদত্যাগ করেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মেহমুদ হোসেন।
পদত্যাগের আগে গত সপ্তাহে মেহমুদ হোসেন টিবিএসকে বলেছিলেন, সোনালী ব্যাংকের থেকে টাকা নেওয়া আসলে ঋণ না।
তিনি বলেন, 'তিন মাসের জন্য একটা ফান্ড নেওয়া হয়েছে। আমাদের কিছুটা তারল্য সংকট আছে। এজন্য আমরা সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া তহবিলের মেয়াদ – ৯ শতাংশ সুদে আরও তিন মাসের জন্য বাড়িয়েছি'।
ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ
ঋণ বিতরণে অনিয়ম রোধ এবং তারল্য সংকট মোকাবেলায় গত ১১ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া, ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ, আদায় ও স্থিতির তথ্য পর্যালোচনা করার পাশাপাশি ব্যাংকটিতে পরিদর্শন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যেভাবে এই সংকটের সূচনা
গত জুলাই মাসে ডলার সংকট নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক গ্রাহক ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তোলা শুরু করেছে। এতে বেসরকারিখাতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে।
তখন থেকেই বেশিরভাগ ব্যাংকে নগদ তারল্য সংকট প্রকট রূপ ধারণ করে, যা মোকাবিলায় অন্য ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া শুরু করে ব্যাংকগুলো।
গত ৯ জানুয়ারি ব্যাংকগুলো কল মানি মার্কেটে ৯% এর বেশি সুদে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করে। ওইদিন একটি ব্যাংক ১০% সুদে ১৪ দিন মেয়াদে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়। অথচ এক বছর আগেও কলমানি বাজারে সুদহার ছিল ৪ শতাংশ।
পরিস্থিতি মোকাবিলায়, 'লেন্ডার অব লাস্ট রিসোর্ট' স্কিমের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক দিন মেয়াদে ৮.৭৫% সুদে ৮ হাজার কোটি টাকা ধার নেয় ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া, ইসলামী ব্যাংকসহ আরও চারটি শরিয়াহ্-ভিত্তিক ব্যাংক সুকুক বন্ডের বিপরীতে ১৪ দিন মেয়াদে আরও চার হাজার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ইসলামী ব্যাংক দেশের অনেক বড় একটি ব্যাংক। এখানে গ্রাহকের দেড় লাখ কোটি টাকা আমানত রয়েছে। একইসঙ্গে, এক কোটি ৯০ লাখ গ্রাহক রয়েছে। সেই বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংককে তারল্য সমর্থন দিয়েছে।
২০২২ সালের নভেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা– সে হিসাবে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ কমেছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৩.২৮ শতাংশ।
আল- আরাফাহ ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ হলো ৪২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে দুই হাজার ৯৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সালের জুন শেষে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের নভেম্বর শেষে এর পরিমাণ নেমে আসে মাত্র ৬৪৬ কোটি টাকায়।
বিদেশি বন্ড জারির মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ ন্যাশনাল ব্যাংকের
উচ্চ হারে খেলাপি ঋণের কারণে দুই বছর ধরে তীব্র আর্থিক সংকটে ভুগছে ন্যাশনাল ব্যাংক। এজন্য রেগুলেটরি ক্যাপিটালের শর্ত পূরণে বিদেশি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বৈদেশিক উৎস থেকে এক হাজার কোটি টাকা তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগও নিয়েছে ব্যাংকটি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুসারে, সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বৈদেশিক মুদ্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সাত বছর মেয়াদী বন্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেছিলেন, ব্যাংকের মূলধন ক্ষয়কারী উচ্চ নন-পারফর্মিং ঋণের কারণে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।