অস্কারে কি ইতিহাস গড়বে নাটু নাটু?
দাড়িওয়ালা সুদর্শন এক ভারতীয় বিমূঢ় চেহারার এক ইংরেজকে জিজ্ঞাসা করলেন, "সালসা নয়, ফ্লামেঙ্কোও নয়, মাই ব্রাদার। তুমি কি নাটু জানো?" কোনো প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই নিজের বন্ধুকে সাথে নিয়ে শুরু হলো চলচ্চিত্রের পর্দার অন্যতম হাই-অকটেন গান আর নাচ।
কেবল নিজেদের চওড়া হাসি আর ইলাস্টিক সাসপেন্ডার দিয়ে আল্লুরি সিতারামা রাজু (রাম চরণ তেজ) আর কোমারাম ভিম (এনটি রামা রাও জুনিয়র) তাদের পায়ের নিখুঁত এবং শক্তিশালী নাচের স্টেপ দেখিয়ে এক ধুলোর ঝড় তুললেন। তাদের নাচকে 'বিরক্তিকর' এবং 'জঘন্য' বলা জেক নামের খলনায়কোচিত ইংরেজকে দেখা গেল নাচের প্রতিযোগিতায় যুক্ত হওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে যেতে। তবে রাজু আর ভিমকে দেখা গেল তাদের নাচ চালিয়ে যেতে, মুখে অক্ষত অবস্থায় থাকলো চওড়া হাসি। ২০২২ সালের তেলেগু ব্লকবাস্টার 'রাইজ রোর রিভোল্ট' তথা 'আরআরআর' নামে পরিচিত চলচ্চিত্রের ভাইরাল হওয়া 'নাটু নাটু' গানটিতেই দেখা যায় এই দৃশ্য।
গানের নাটু কথার অর্থ একেবারেই সাধারণ দেশি নাচ, যেটি সালসা বা ফ্লামেঙ্কোর মতো বিদেশি বা অ-ভারতীয় নয়। একেবারেই মাটির কাছাকাছি গ্রামীণ জিনিসকে এই গানের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
একইসাথে গানটি পুরো চলচ্চিত্রের একটা ক্ষুদ্র রূপকার্থও বটে। দুই নাটু মুক্তিযোদ্ধা শক্তিশালী ইংরেজ সাম্রাজ্যকে (যেটি তুলে ধরা হয়েছে স্কট বাক্সটন নামের ইংরেজ গভর্নর, তার স্ত্রী ক্যাথেরিন এবং প্রায়ই স্থানীয় ভারতীয়দের গায়ে হাত তোলা জুনিয়র অফিসারের মাধ্যমে) হাঁটু গাড়তে বাধ্য করেছে। এই গান অনেকটা প্রতিশোধের মতো, যেখানে ক্ষুদ্র ডেভিড তার বিরাটাকার প্রতিদ্বন্দ্বী গোলায়াথকে নাচের মাধ্যমে হারিয়ে দিচ্ছে।
ইতিহাসভিত্তিক এবং আবেগীয় প্লট থাকায় আরআরআর যে ভারতে সফল হবে তা বেশ স্বাভাবিকই ছিল। তবে পুরো বিশ্বের দর্শকদের কাছে, বিশেষ করে সারাবিশ্বের চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের 'বছরের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকা'য় থাকার মতো ঘটনা এর আগে খুব বেশি হয়নি। অক্টোবরের শেষে জাপানে মুক্তি পাওয়ার পর এটি এখন জাপানে সবচেয়ে বেশি আয় করা ভারতীয় চলচ্চিত্র। জানুয়ারি মাসে নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ডসে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতে নেওয়া আরআরআর-এর পরিচালক এসএস রাজমৌলি এই চলচ্চিত্রকে, 'ওভার দ্য টপ অ্যাকশন ফ্যান্টাসি' হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছেন।
চলচ্চিত্রের সফলতার আরও একটি কারণ এর মূল গান নাটু নাটু, যেটি দর্শকদের মধ্যে অ্যাড্রেনালিনের বন্যা বইয়ে দেয়। গানটিও গত জানুয়ারি মাসে রিহানা, টেইলর সুইফট এবং লেডি গাগার মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে হারিয়ে 'সেরা অরিজিনাল গান' ক্যাটাগরিতে জিতে নেয় গোল্ডেন গ্লোব। অস্কারেও সেরা অরিজিনাল গান হিসেবে নমিনেশন পাওয়া গানটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার সময়েও পরিবেশন করা হবে। সবমিলিয়ে গানটির প্রতি আকর্ষণ এখন তুঙ্গে।
সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তা
ভারতীয় শ্রোতারা নাটু নাটু গানের তালে তালে গান গাওয়া কিংবা নাচানাচি করলেও এটা কি অনন্য বা অসাধারণ কিছু? হয়তো না। দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে কাজ করা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আনন্দ কৃষ্ণামূর্তি গানটিকে 'আনন্দদায়ক' বললেও তিনি জানান, "ভারতীয় চলচ্চিত্রের নিয়মিত দর্শক হিসেবে আমরা এরচেয়েও ভালো গান শুনেছি, তবে যারা এই ধরনের গানের সাথে পরিচিত নয়, তাদের কানে হয়তো এই গান অনেক ভালো লাগবে।" তবে এই গানের প্রভাব একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়। রিম খোকার নামের এক ভারতীয় লেখক জানান, "গানটির মধ্যে একধরনের প্রাকৃতিক পাগল করে দেওয়া শক্তি আছে, যেটা স্ক্রিনে একেবারে ফেটে পড়ে। আমি বহুদিন পর কোনো গান শুনে এরকম মজা পাইনি।"
তবে অস্কারে কোনো ভারতীয় গান নমিনেশন পাওয়ায় কৃষ্ণামূর্তি বেশ খুশি। এর আগে কেবল একবারই এটি হয়েছে, ২০০৯ সালের স্লামডগ মিলিয়নেয়ার চলচ্চিত্রে, যখন সুরকার এআর রহমান তার 'জয় হো' গানের জন্য অস্কার জিতে নেন। তবে চলচ্চিত্রটি পুরোপুরি ভারতীয় ছিল না। পরিচালক ড্যানি বয়েলের অধীনে চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ কর্মীই ছিল ইংরেজ।
কৃষ্ণামূর্তি জানান বলিউড নামটা প্রমাণ দেয় যে এটা তেমন বিশেষ কিছু নয়, কেবল হলিউডের সস্তা অনুকরণ। "এটা সত্যি যে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের অনেক কিছুই বৈচিত্র্যময়, তবে এর বেশিরভাগই অনুকরণমূলক। তবে আমরা একমাত্র যে জিনিসটা মৌলিকত্বের দিক থেকে এগিয়ে আছি তা হলো আমাদের গান আর নাচ। বাকি সবই আমাদের চলচ্চিত্রের দর্শকরা অন্য কোথাও দেখে ফেলেছে। তাই এটি স্বাভাবিক যে এই গানটির মাধ্যমেই আমরা ভাষাগত বাধাটি ভেঙে ফেলতে পেরেছি।"
আরআরআর চলচ্চিত্রটির মতো নাটু নাটু গানটিও যথেষ্ট আলোচনার দাবি রাখে। ২০২১ সালে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে থাকা প্রধানমন্ত্রী ভলোদিমির জেলেন্সকির প্রাসাদোপম সরকারি বাড়ির সামনে শ্যুট করা এই গানটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা অরিজিনাল গান অ্যাওয়ার্ড জিতে নেওয়ার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। গানটির 'হুক' অংশটি ইতিমধ্যেই টিকটকে ঝড় তুলে ফেলেছে, যেখানে টিকটক ব্যবহারকারীরা সাড়ে চার মিনিটের গানটির ক্ষুদ্র অংশ নিজেরাই রিমেক করার চেষ্টা করছেন। অনেকেই আবার কীভাবে এই বিশেষ ধরনের নাচ নাচতে হবে তাও শেখানোর টিউটোরিয়াল বের করেছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দর্শকদের মনে গেঁথে গিয়েছে এই গানটি।
এই গান ইন্সটাগ্রামে আবিষ্কার করার পর খোকার ব্যাখ্যা করেন কেন বর্তমান ভাইরান গানগুলোতে ১৫-২০ সেকেন্ডের চমৎকার সিকোয়েন্স থাকা আবশ্যক, নাটু নাটুর ক্ষেত্রে গানটির কোরাস যে ভূমিকা পালন করেছে। তা-ই লস অ্যাঞ্জেলেসের বিয়ন্ড ফেস্টে যখন চাইনিজ থিয়েটার গ্রুপ এই গানের তালে নেচে ওঠে, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না
প্যারাডাইম শিফট
আরআরআর-এর প্লট একেবারেই সাধারণ এবং সহজ। নায়ক আর খলনায়কদেরকে পরিষ্কারভাবে আলাদা করা যায়। ঔপনিবেশকতাবিরোধী বার্তাও খুবই জোরালোভাবে দেওয়া হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে, সাথে সমাজের তৃণমূল অংশের বিদ্রোহের অংশও ছিল নজরকাড়া। তবে চলচ্চিত্রটির বার্তায় বেশ কিছু বড় সমস্যাও আছে। এর মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় চিহ্নের ব্যবহার যেটি হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডাকে আরও শক্ত ভিত দিতে পারে, বিশেষ করে এটি এমন এক সময়ে মুক্তি পেয়েছে যখন জাতীয়তাবাদের আগুনে জ্বলা দেশটি ক্রমেই ডানপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। চলচ্চিত্রটির আরও একটি সমস্যা হলো জাতপ্রথা, যেখানে দেখা যায় নিচু জাত থেকে উঠে আসা ভীম উঁচু জাতের রামের তীক্ষ্ণবুদ্ধির কাছে নুয়ে পড়ে। ভক্স এটি উল্লেখ করে বলে, "এই অংশটি উত্তেজনাকর হলেও সেই উঁচু বর্ণের বর্ণবাদী মনোভাবের কোনো ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় না।"
চলচ্চিত্রটিতে ভারতীয়দেরকে তাদের ইংরেজ শোষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেখা গেলেও কৃষ্ণামূর্তি জানান পশ্চিমা দর্শকদের আগ্রহ থাকলেও এখানে একটি বর্ণবাদী উপাদান রয়েছে। তার মতে, "অন্যান্য দেশের দর্শকদের কাছে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে অনেকটা চিড়িয়াখানার সাথে তুলনা করা যায়। তারা ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখতে আগ্রহী হন এর উদ্ভট এক্সটিক জিনিসগুলো দেখার জন্য, নিজের সাথে মেলানোর জন্য নয়। ফলে পশ্চিমা দর্শকরা যখন এ ধরনের চলচ্চিত্র দেখতে আগ্রহী হন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয় যে চলচ্চিত্রটিতে উদ্ভট অবাস্তব কিছু থাকবে, আর এই চলচ্চিত্রটিও তা-ই।"
তবে আরআরআর-এর ক্ষেত্রে যে জিনিস খুবই ইতিবাচক তা হলো এতদিন ধরে বাইরের পৃথিবীর কাছে মুম্বাইভিত্তিক বলিউড ইন্ডাস্ট্রিই ছিল ভারতীয় সিনেমার অন্য নাম। তবে আরআরআর-এর এই সাফল্য প্রমাণ করেছে তেলেগু ভাষা ছাড়াও অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রও উত্তর ভারতের হিন্দিভাষীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সাথে পুরো বিশ্বেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
গোল্ডেন গ্লোভবের পর নাটু নাটু এবার অস্কারের মঞ্চও জয় করতে পারে, কারণ সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বিভিন্ন জাতি-বর্ণ-লিঙ্গের প্রতি তথা বৈচিত্র্যের প্রতি জোর দিচ্ছে।
আর এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নাটু নাটুর গান, সুর আর নাচ প্রাণশক্তিতে ভরপুর। যে কারণে চলচ্চিত্রে ভারতীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল একমাত্র ইংরেজ জেনি ভিমকে বলে, "It was overwhelming. The beat pulsating through your body, the flying feet, the flashing eyes."
সূত্র: বিবিসি কালচার