খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চান মাহফুজুর-আলাউদ্দিনরা
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ম্যাচ চলছে। স্টেডিয়ামে হাজির সবারই চোখ মাঠে। কিন্তু ম্যাচটি আর দশটি পেশাদার ম্যাচের মতো নয়, কয়েক মুহূর্তেই এটা বোঝা গেছে। এই ম্যাচে অংশ নেওয়া ক্রিকেটারদের কেউ কেউ ঠিক মতো দৌড়াতে পারেন না, কারও আবার পায়ের একটা অংশই নেই। এমন কেউ আছেন, যে কিনা ঠিকভাবে বল ধরতে পারেন না। কারও আবার আঙুল বা পুরো একটি হাতই নেই।
জন্মগতভাবে অথবা পরবর্তীতে দুর্ঘটনা ও অসুস্থতায় অঙ্গহানি হয়েছে তাদের। মাঠে অবশ্য মাহফুজুর রহমান, মোহাম্মদ আলাউদ্দিনদের দেখে বোঝার উপায় নেই তারা কতো প্রতিকূলতাকে সঙ্গে নিয়ে খুশি মনে বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার হোম অব ক্রিকেটে এমনই এক লড়াই দেখা গেল, জান লাগিয়ে লড়লেন দুই দলের ২২ ক্রিকেটার। যারা স্বপ্ন দেখেন তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানদের মতো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার, সেটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও।
গত দুই সপ্তাহ ধরে নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আউটারে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার মিরপুরে অনুষ্ঠিত হলো ফাইনাল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কর্তৃক প্রথমবারের মতো আয়োজিত দশ দলের এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ইউনিসারভ ডিসেবল ক্রিকেট দলকে (ইউডিসিটিবি) ৫৩ রানে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড (বিসিএপিসি)।
টুর্নামেন্ট সেরা ক্রিকেটার, সেরা বোলার, সেরা ব্যাটসম্যান; সবাই বিসিএপিসির। তাদেরই দুজন মাহফুজুর ও আলাউদ্দিন। ৬ ম্যাচে ১৪০ রান ও ১০ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন অলরাউন্ডার মাহফুজুর। সমান ম্যাচে আলাউদ্দিন নিয়েছেন ১৩ উইকেট। এই ১৩ উইকেট নেওয়ার পথে প্রতিটা ডেলিভারি দিতে কতোটা সংগ্রাম করতে হয়েছে, ম্যাচের পর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানালেন বাঁহাতি স্পিনার আলাউদ্দিন।
নিজের সীমাবদ্ধতা ও সংগ্রামের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা কেউ-ই যেহেতু অন্যদের মতো স্বাভাবিক নই, ফিট নই; আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে ক্রিকেট খেলতে হয়, খেলতে প্রচুর কষ্ট করতে হয়। এই যে খেলার পর এখন পা ব্যথা করছে, দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছি না। ম্যাচের পর সাধারণত বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিই, থেরাপি নিই। তারপর কিছুটা ঠিক হয়, আস্তে আস্তে সুস্থ হই, আবার মাঠে নামি। এই কারণেই খেলাটা চালিয়ে নেওয়া আমাদের বড় বাধা।'
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পোলিওতে আক্রান্ত হস আলাউদ্দিন, পা দুটো শুকিয়ে যায় তার। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ৩৯ বছর বয়সী বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এই ক্রিকেটার। কিন্তু খেই হারান না তিনি, ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন জিইয়ে রাখেন ঠিকই। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন দলে সুযোগ পেয়ে ছক্কা মেরে বাংলাদেশকে জেতানোর পর মনের জোর বেড়ে যায় আলাউদ্দিনের, হয়ে ওঠেন আরও সাহসী।
নিজের জীবনের দুঃখের অধ্যায় ও অনুপ্রেরণার গল্প শোনাতে গিয়ে আলাউদ্দিন বলেন, 'এখানে খেলার আগে থেকেই ক্রিকেট খেলতাম, ছোট বেলায় পাড়া-মহল্লায় ক্রিকেট খেলতাম। যদিও আমার দুই পায়েই সমস্যা। আমার দুই পা চিকন, ভারসাম্য নেই। ১৯৯৫ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমার পোলিও হয়। পোলিও আক্রান্ত হওয়ার পর আমার পা এমন হয়ে যায়।'
'আমার সীমাবদ্ধতা আছে, সবার মতো করে দৌড়াতে পারবো না জেনেও আমি হাল ছাড়িনি। আমি স্বপ্ন দেখে গেছি, মনে সাহস ছিল যে খেলতে পারবো। এই সাহস আমাদের সবার মাঝে আছে, এটা নিয়েই আমরা যাত্রা শুরু করি। ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে একটা বিশাল ছয় মেরে আমি ম্যাচ জেতাই, সেরা খেলোয়াড় হই। আমাদের দল চ্যাম্পিয়ন হয় (২০১৩ সালে)। ওখান থেকে মনের জোর আরও বেড়েছে, সাহসটা আরও বেড়ে যায়। আমরা এখন খেলছি, কাজ করছি।' যোগ করেন তিনি।
ক্রিকেট খেলে সংসার চলে না আলাউদ্দিনের। উত্তরার বাসিন্দা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এই ক্রিকেটারের স মিলের ব্যবসা আছে। তবে বিসিবি তাদেরকে এবার তত্ত্বাবধানে নেওয়ায় আশা দেখছেন আলাউদ্দিন, 'আমার বাড়ি উত্তরাতে, ক্রিকেট খেলার বাইরে ব্যবসা করি। আমার একটা স'মিল আছে। মূলত ব্যবসাই আমার মূল কাজ। ক্রিকেট খেলে আমার সংসার চলে না। ক্রিকেট আমাদের স্বপ্ন। আমরাও যে ক্রিকেট খেলতে পারি, এটা দেখানোর জন্য খেলছি। বিসিবি এখন আমাদের সব দলকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়েছে। বিসিবি থেকে আমরা বেতনসহ সুযোগ-সুবিধা পাবো।'
মিরপুরে মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালসহ দেশ ও বিদেশের কতো নামি ক্রিকেটারকেই তো খেলতে দেখেছেন আলাউদ্দিন। সেই মাঠে খেলতে পারাটা তার কাছে স্বপ্ন পূরণের মতো, 'মিরপুরে ঐতিহাসিক এই মাঠে প্রথম খেললাম। ঐতিহাসিক এই কারণে বলছি এখানে সাকিব-তামিম-মুশফিক ভাইরা খেলেন, মাশরাফি ভাই খেলেছেন। অনেক ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ এখানে। আজ খেললাম, ব্যাপারটা স্বপ্ন পূরণের মতো। তাসকিন-সাকিব ভাইরা যে উইকেটে বোলিং করেন, সেখানে বোলিং করার অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না।'
সারা বছর নিজেদের মতো করে ক্রিকেট বলে অনুশীলন করেন আলাউদ্দিনরা। বিসিবির সুদৃষ্টি পেয়ে এবার বিশ্বকাপস্বপ্ন ভর করেছে তার মনে, 'বিসিবির তত্ত্বাবধানে আমাদের নিয়েছে, পাপন ভাই আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে আমাদের বিশ্বকাপ হবে। আমরা সেখানে অংশ নিবো। আমরা যতোটুকু পারি বহির্বিশ্বে দেশের নাম উজ্জ্বল করার চেষ্টা করবো। সাকিব-তামিম ভাইদের মতো বিশ্বকাপে আমরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।'
টুর্নামেন্ট সেরা মাহফুজুর তিন মাস বয়সেই দুর্ঘটনার শিকার হন। আগুনে হাত পুড়ে যায় তার। একটি আঙুল বাকা হয়ে যায়, এ ছাড়া অনেকটা অংশ পুড়ে জোড়া লেগে যায়। যে কারণে ডান হাতে একেবারেই কম জোর পান তিনি, 'আমার বয়স যখন তিন মাস, তখন আমার হাতটা পুড়ে যায়। এরপর থেকে সমস্যা শুরু হয় হাতে। হাতটা ধীরে ধীরে প্যারালাইসড এর মতো হয়ে যায়। আমার ডান হাতটা পুরোপুরি প্যারালাইসড না, তবে হাতে জোর অনেক কম। হাতে আঙুল একটা বাঁকা। অনেকটা অংশ পুড়ে জোরা লেগে গেছে।'
মাহফুজুর বাঁহাতে স্পিন বোলিং করেন, ডান হাতে করেন ব্যাটিং। শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই নিরুৎসাহিত করলেও তরুণ এই ক্রিকেটার তাতে কান পাতেননি। লড়ে যাচ্ছেন, স্বপ্ন দেখেন বিশ্বকাপ খেলারও, 'অনেকেই বলেছেন হাতের এমন অবস্থা নিয়ে ক্রিকেট খেলা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি আমার নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছি, কোচরা অনেকে বিশ্বাস রেখেছেন। এ কারণে সাফল্য পেয়েছি। স্বপ্ন দেখি দেশের হয়ে বিশ্বকাপে খেলবো, ভালো কিছু করবো, যেটায় দেশের নাম উজ্জ্বল হয়।'
মাহফুজুরের আদর্শ সাকিব আল হাসান। তার বোলিংয়ের সবকিছুই পাখির চোখ করেন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এই ক্রিকেটার। সাকিবকে আদর্শ মেনে সাফল্য পাওয়া মাহফুজুর চ্যাম্পিয়নের মালা পরে স্মরণ করলেন তার কয়েকজন কোচকে, 'ছোট বেলা থেকেই আমি সাকিব ভাইকে অনুসরণ করি। আমি সাকিব ভাইয়ের কোয়ালিটির বোলিং করার চেষ্টা করি। উনি কীভাবে মাথা খাটিয়ে বোলিং করেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করি। আমি যশোরে কিশবপুর ক্রিকেট একাডেমিতে অনুশীলন করি। ওখান থেকে আমি উঠে এসেছি। ওখানকার কোচ ইমরান খান কারী। জাহিদ ভাই আছেন, উনিও কোচিং করান। উনি আমার অনেক কিছুই ঠিক করিয়ে দেন। তবে বিসিএপিসির কোচ জসিম উদ্দিন স্যার আমাকে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড টিমে নিয়ে এসেছেন।'