‘তাদের মধ্যে কেন লোভ-লালসা আসে’; ফারুক-নাজমুল দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে সুজন
গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর একসঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক হন ফারুক আহমেদ ও নাজমুল আবেদীন ফাহিম। পরিচালকদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন ফারুক। নির্দিষ্ট কোনো কমিটির দায়িত্ব না পেলেও অলিখিতভাবে বিসিবির 'দ্বিতীয় প্রধান'-এর পদ মেলে নাজমুল আবেদীনের। সেই থেকে একসঙ্গে কাজ করে আসছেন দুজন।
তবে একসঙ্গে কাজ করে যাওয়ার পথটা বেঁকে গেছে দুজনের। বেশ আগেই গুঞ্জন ছড়ায়, দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন ফারুক-নাজমুল। এতোদিন গুঞ্জন থাকলেও রোববার ব্যাপারটি প্রকাশ্যে আনেন নাজমুল আবেদীন। একটি সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগ করেন, বিসিবির সভাপতি তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। বিষয়টি নিয়ে পরে কথা বলেন ফারুকও।
বিসিবির দুজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মাঝে এমন দ্বন্দ্ব দেখে হতাশ খালেদ মাহমুদ সুজন, দুজনের চরম সমালোচনা করেছেন তিনি। বিসিবির সাবেক পরিচালক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মনে করেন, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তার ভাষায় ব্যাপারটি লোভ করার মতো, ইগোর সমস্যাও দেখতে পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নের লক্ষ্যে দায়িত্ব নেওয়া কারও মধ্যে লোভ-লালসা কীভাবে আসে, প্রশ্ন বিপিএলর দল ঢাকা ক্যাপিটালসের প্রধান কোচের দায়িত্বে থাকা সুজনের।
বিপিএল এখন সিলেটে। ম্যাচের আগের দিন সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আউটারে অনুশীলন করে কয়েকটি দল। অনুশীলনের আগে-পরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন কয়েকটি দলের প্রতিনিধি। তবে এসব ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ফারুক ও নাজমুল আবেদীনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের বিষয়টি।
নাজমুল আবেদীন অভিযোগ করে বলেন, বিসিবি সভাপতি তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। বিসিবি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সামনে বিসিবি সভাপতির করা একটি মন্তব্যে তিনি চরম হতাশ। এ ছাড়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না বলেও জানান তিনি। এভাবে চলতে থাকলে পরিচালকের দায়িত্ব ছাড়ার কথা জানান নাজমুল আবেদীন। পরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে ফারুক জানান, ভুল বোঝাবুঝি থেকে এমন হতে পারে। তবে বিষয়টি মিটমাট হয়ে গেছে।
মিটমাট হয়ে যাওয়ার দাবি করলেও কালকের ঘটনার রেশ আজও রয়ে গেছে। বিসিবিতে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় আজ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া সুজনের কাছে। চরম সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'কালকের একটা ঘটনা দেখলাম ফারুক ভাই-ফাহিম ভাইয়ের দ্বন্দ্ব। এটা ব্যথা দেয় যে, দুজনই সাবেক ক্রিকেটার। তাদের কেন ইগোর সমস্যা হবে! তারা তো ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্যই এসেছেন এবং তারা যখন এসেছেন, তখন অনেক কমিটমেন্ট করেছেন, আমি দেখেছিলাম। বিশেষ করে ফাহিম ভাই তো অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন, অনেক বলেছেন যে, উনি অনেক দেখেছেন এবং সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করছেন, চিন্তা করেছেন। সেগুলো আমি এখন দেখছি না।'
বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান হতে চান নাজমুল আবেদীন। সুজনের দৃষ্টিতে এমন ইচ্ছার কথা জানানো লোভ করার সমান। তার ভাষায়, 'আমি দেখছি লোভ-লালসার মতো হয়ে যাচ্ছে যে, আমি অপারেশন্স না পেলে কাজ করব না, পদত্যাগ করব। এটা তো লোভ-লালসা স্রেফ!। এই লোভ-লালসা কেন আসে তাদের মধ্যে? আমার ক্রিকেট অপারেশন্সই নিতে হবে কেন? আমি যদি অন্য কমিটির চেয়ারম্যান হই, ওখানে সার্ভ করতে পারব না কেন?'
নাজমুল আবেদীন ক্রিকেট অপারেশন্সের মাস্টার কিনা, প্রশ্ন রেখে সুজন আরও বলেন, 'উনি কি ক্রিকেট অপারেশন্সের মাস্টার? উনার আগে তো আকরাম ভাই মাস্টার। উনি চাইতে পারে। কারণ আকরাম ভাই বাংলাদেশের সাবেক সফল অধিনায়ক এবং অপারেশন্স চেয়ারম্যানও ছিলেন। তাহলে উনি (নাজমুল আবেদীন) কেন বলছেন যে, অপারেশন্স ছাড়া হবেই না! এটা তো ইগোর ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। ফারুক ভাই-ফাহিম ভাই, আমার মনে হয় ইগোর সমস্যা। সত্যি কথা বলছি, এটা কী হচ্ছে… আমি জানি না।'
দুজন অভিজ্ঞ মানুষকে ঘিরে এমন অবস্থা তৈরি হওয়ার ব্যাপারটাকে লজ্জার বলছেন সুজন। সাবেক এই বিসিবি পরিচালক বলেন, 'এতো অল্প পরিচালক দিয়ে ফারুক ভাইয়ের জন্য বোর্ড চালানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেন ফারুক ভাই নতুন পরিচালক নিচ্ছেন না… যাদেরকে উনারা নিতে চান, নিয়ে নিলেই পারেন। যখন তাদের এই মন-মনিসিকতা দেখি, তখন খারাপ লাগে। দুইজন সিনিয়র মানুষ, আমরা যাদেরকে অনেক সম্মান করি… ফারুক ভাই ও ফাহিম ভাই, দুজনই আমাদের শ্রদ্ধেয় ও সাবেক ক্রিকেটার। তাদেরকে যখন এমন দেখি ক্রিকেটার হিসেবে, লজ্জিত হই আসলে আমরা ক্রিকেটাররা কী এত বেশি লোভী নাকি!'
নিজেদের মধ্যে কথা বলে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলা যেতো বলে মনে করেন সুজন। তার মতে, ঘরের কথা এভাবে সংবাদমাধ্যমে জানানো উচিত হয়নি। সুজন বলেন, 'যেটা চার দেয়ালের ভেতরে শেষ হতে পারতো, এটা সারা বাংলাদেশের মানুষ কেন জানবে? তারা দুজনই ক্রিকেটার। তাহলে আমাদের ক্রিকেটারদের লোকে কী বলবে! এই কথাটা ভাবা খুব স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে যে, আমরা নিজের স্বার্থের জন্য বোর্ডে যাই। আমাদের সব ক্রিকেটারের জন্য এটা লজ্জার ব্যাপার। দুজন সিনিয়র মানুষ যা করলেন, আমরা যারা জাতীয় দলে খেলেছি বা বাইরে যারা, সব ক্রিকেটারের জন্য লজ্জাজনক। এই যে ইগোর সমস্যা বা কাড়াকাড়ির সমস্যা চলছে যে, কে বোর্ড সভাপতি হবেন, কে অপারেশন্স চেয়ারম্যান, কে ডেভেলপমেন্টের প্রধান; এটা খুবই মজার ও লজ্জাজনক।'
'কার সংসারে অশান্তি নেই! আমার কথা হলো, তারা দুজনই অনেক সিনিয়র মানুষ। ফাহিম তো আমাদের সবার গুরু… এ রকম একজন ক্রিকেট প্রশিক্ষক। উনি তো বিচক্ষণ, উনি কেন এটা প্রকাশ্যে বলবেন? উনি যদি মনে করেন, উনার সম্মান পাচ্ছেন না, দায়িত্ব পাচ্ছেন না, উনি ফারুক ভাইয়ে সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন, ওয়ান টু ওয়ান। উনি ফারুক ভাইকে বলবেন, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব হিসেবে যদি কিছু না জানেন, উনি সরাসরি পদত্যাগ করবেন। এটা তো প্রকাশ্যে বলার দরকার নেই।' বলেন সুজন।