ইউক্রেনের পাল্টা-আক্রমণ কি কুরস্কের মতো আরেক পরাজয়ের রূপ নিচ্ছে?
কিছু পর্যবেক্ষক বলছেন, ইউক্রেনের জাপোরিঝিয়া অঞ্চলে বর্তমানে চলমান লড়াই অনেকটাই ১৯৪৩ সালের কুরস্কের লড়াইয়ের মতোন। প্রকৃত ঘটনাও কি তাই? আর তার তাৎপর্যই বা কোথায়?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত হয় এই 'ব্যাটেল অব কুর্স্ক'। পশ্চিম রাশিয়ায় সোভিয়েত লালফৌজকে হারাতে বিশাল প্রস্তুতি নিয়েছিল জার্মান বাহিনী। লালফৌজ-ও প্রতিরোধের সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়। বিপুল সংখ্যক সাঁজোয়া যান, ট্যাংক, কামান, যুদ্ধবিমান ও জনবল নিয়ে মুখোমুখি হয় উভয়পক্ষ। সেই ব্যাপকতার সাথে জাপোরিঝিয়ায় চলমান বর্তমান লড়াইকে তুলনা করা না গেলেও – অন্যান্য দিক থেকে সে তুলনা করা যেতে পারে।
জাপোরিঝিয়ায় রুশ বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করে একটি প্রবেশপথ তৈরি করতে চাইছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এতে তারা সফল হলে, রুশ বাহিনীকে দুইভাগে বিভক্ত করে আজভ সাগরের কাছাকাছি অবস্থান নিতে পারবে।
এই লক্ষ্য অর্জনে ন্যাটো-দ্বারা প্রশিক্ষিত ১২টি ব্রিগেড রয়েছে ইউক্রেনের। এরমধ্যে নয়টি ব্রিগেডে রয়েছে পশ্চিমা ট্যাংক, ইনফেন্ট্রি ফাইটিং ভিহাইকেল (আইএফভি), আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি), মাইন-রেজিস্ট্যান্ট অ্যামবুশ প্রটেক্টেড ভিহাইকেল (এমর্যাপ)সহ যথেষ্ট পরিমাণ অন্যান্য যান ও সরঞ্জাম।
যুদ্ধের সম্মুখভাগ বেশ দীর্ঘ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যেখানে একাধিক স্থানে লড়াই চলছে। রুশ সেনারা শক্ত অবস্থান নিয়েছে বাঙ্কার ও পরিখায়। অন্যদিকে ইউক্রেনীয়রা দুর্ভেদ্য এই প্রতিরক্ষা ব্যুহে দুর্বল কোনো স্থান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে, যাতে সেদিক দিয়ে 'ব্রেক থ্রু' অর্জন করা যায়।
কুরস্কের লড়াইয়ে উভয়পক্ষই বিমান বাহিনী ব্যবহার করেছে। সার্বিকভাবে জার্মান বিমানবাহিনী বা লুফৎওয়াফা আকাশপথের লড়াইয়ে বেশি সাফল্য পায় – কিন্তু, এজন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হয়। লুফৎওয়াফা জঙ্গিবিমান, ভূমিতে আক্রমণ পরিচালনাকারী বিমান ও বোমারু বিমান নিয়োজিত করেছিল।
আকাশযুদ্ধে ছাড়ে দেয়নি রাশিয়ান পক্ষও। তারা শত শত বিখ্যাত আইএল-২ স্ট্রুমোভিক ও লাভোচকিন এলএ-৫ বিমান মোতায়েন করে জার্মানদের ব্যতিব্যস্ত রাখে। এই লড়াইয়ে রাশিয়ার মোট ১,১৩০টি বিমান ধবংস হয়, সে তুলনায় জার্মানরা হারায় ৭১১টি বিমান।
জার্মানির আকাশে তখন হানা দিচ্ছিল ইঙ্গ-মার্কিন বোমারু বিমানের ঝাঁক। হাজার হাজার টন বোমা ফেলে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল একের পর এক শিল্পাঞ্চল। এতে সামরিক উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল। ফলে কুরস্কের লড়াইয়ে হারানো বিমান সংখ্যা পুনরুদ্ধারে গুরুতর সমস্যায় পড়তে হয়েছিল জার্মানিকে। তার সাথে ছিল জ্বালানির সংকটও। পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনের আকাশযুদ্ধে জার্মানি যখন দক্ষ পাইলটদের হারাচ্ছিল, তখন যুদ্ধ করতে করতে আরও ঝানু ও দক্ষ হয়ে উঠছিল রাশিয়ার নবীন পাইলটরা।
কুরস্কে জার্মান বাহিনীর অভিযানকে 'অপারেশন সিটাডেল' নাম দেন ওয়ারমাখট (জার্মান সেনাবাহিনী)-র জেনারেলরা। এই অপারেশনে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্যাংক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জার্মান পক্ষে লড়াইয়ে যোগ দেয় ২,৭০০ ট্যাংক, অন্যদিকে রাশিয়ানদের ছিল ৩,৬০০ ট্যাংক। লড়াই শেষে জার্মানির ১,৫৩৬টি ট্যাংক সম্পূর্ণ ধবংস বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাশিয়ান পক্ষে ২,৭৪১টি ট্যাংক ধবংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ট্যাংক রণাঙ্গন থেকে সরিয়ে এনে মেরামতের পর আবারো যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল। কখনো কখনো একই ট্যাংকের বেলায় তা দুই-তিন বারও হয়েছে বলে জানা যায়।
অন্যদিকে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে ড্রোন ও নির্ভুল লক্ষ্যভেদে সক্ষম যুক্তরাজ্যের তৈরি স্ট্রোমশ্যাডো মিসাইল দিয়ে শত্রুর কিছু ক্ষয়ক্ষতি করা ছাড়া – ইউক্রেনীয় বাহিনী সেভাবে লড়াই করতেই পারছে না।
নিজেদের বিমানশক্তিকে আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহার করছে রাশিয়া। ড্রোন ব্যবহারেও দেখাচ্ছে পারদর্শীতা। চমৎকার পারফর্ম করছে ভিখর মিসাইল-সজ্জিত রাশিয়ার কা-৫২ অ্যাটাক হেলিকপ্টার। এই হেলিকপ্টারে শত্রুর বিমানবিধ্বংসী মিসাইল প্রতিরোধের জন্য রয়েছে ইনফ্রারেড কাউন্টার-মেজারস-যুক্ত ভিতবেস্ক এল-৩৭০ সিস্টেম।
রাশিয়ানরা জানিয়েছে, ভিতবেস্ক সিস্টেম এরমধ্যেই বড় সংখ্যক স্বল্প-পাল্লার ও কাঁধ থেকে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইলকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ইউক্রেনের অনেক ট্যাংক, আইএফভি, এপিসি, এমর্যাপ ধবংস করতে পেরেছে কা-৫২। সুফল পাওয়ায়, গত সপ্তাহ থেকেই চলমান লড়াইয়ে হেলিকপ্টারের সংখ্যা বাড়িয়েছে রাশিয়া।
উভয়পক্ষই আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য মাইন ব্যবহার করছে। এসব মাইন অপসারণে সেভাবে সফল হচ্ছে না ইউক্রেনের কাছে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্যদেশগুলোর তৈরি মাইন অপসারণ যানগুলো। সম্প্রতি ইউক্রেনীয়রা একটি স্বচালিত অপসারণ যান মোতায়েন করেছে, ধারণা করা হচ্ছে এটি ইউক্রেনের কব্জা করা রাশিয়ার তৈরি ইউআর-৭৭ মাইন ক্লিয়ারার।
কুরস্কের যুদ্ধেও মাইন বড় ভূমিকা পালন করেছিল। জার্মান বাহিনীর অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়ে। কিন্তু ওয়ারমাখটের ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র ও প্যানজার ট্যাংকগুলোও গুরুত্বপূর্ণ সামর্থ্যের পরিচয় দেয় – আরও বেশি সংখ্যক রাশিয়ান ট্যাংক ধবংস করে। সে তুলনায়, ইউক্রেনের দেখানোর মতো সাফল্য যৎসামান্যই বলা চলে।