ব্রিকস কি নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে পারবে?
দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে শীর্ষস্থানীয়, জনসংখ্যা বেশি এবং আধিপত্য বিস্তারেও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাই চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত জোট ব্রিকসের মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলনে নজর রাখছে পুরো বিশ্ব।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে আয়োজিত সম্মেলনে অবশ্য সশরীরে উপস্থিত থাকছেন না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কারণ তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে। আর দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিসির সদস্যভুক্ত দেশ। তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, দক্ষিণ আফ্রিকায় তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। যদিও চাইলে তা এড়ানো সম্ভব, তারপরও আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও জটিলতা এড়াতে ভার্চ্যুয়ালি সম্মেলনে যুক্ত হবেন পুতিন।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ ও চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে এই সম্মেলন শুরু হচ্ছে। তাই ব্রিকস জোটের এই মিলনমেলার পুরোভাগে হয়তো থাকবে দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার করে চলা ওয়াশিংটন কেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থা খর্ব করার কৌশল।
সম্মেলনের প্রধান এজেন্ডাগুলোর মধ্যে থাকবে জোটের সম্প্রসারণ। আলজেরিয়া থেকে আর্জেন্টিনা, প্রায় ৪০টি দেশ এই জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।
জোটের প্রতি এমন আকর্ষণের কারণ সদস্য দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি। ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে ব্রিকসের পাঁচ সদস্য দেশের সক্ষমতা জি৭ এর সম্মিলিত জিডিপির বেশি। বিশ্ব জিডিপির ২৬ শতাংশই ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর। তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) তাদের ভোটের ক্ষমতা মাত্র ১৫ শতাংশ।
এই ধরনের ভারসাম্যহীনতার অভিযোগের সাথে গ্লোবাল সাউথে উদ্বেগ বাড়ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। যেভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সাথে করা হয়েছে। এ কারণেই ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো নিজ উদ্যোগে এবং সম্মিলিতভাবে ডলারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের মুদ্রায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের চেষ্টা করছে।
কিছু একটা পরিবর্তন প্রয়োজন, এমন কথায় সম্মত হওয়া এবং একসঙ্গে কীভাবে কাজ করব সে বিষয়ে সম্মত হওয়া ভিন্ন বিষয়। ২০২০ সালের মে থেকে ভারত ও চীন সীমান্ত নিয়ে বিরোধে জড়িত। আবার ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিল চাইছে রাশিয়া ও চীনের মতই পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে।
সুতরাং, ব্রিকস কি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিপরীতে নতুন অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ভিত তৈরি করতে পারবে? নাকি নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা তাদের সুযোগকে সীমিত করবে?
সংক্ষেপে এই প্রশ্নের উত্তর হলো- ব্রিকস সদস্যরা তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করবে, তবে রাতারাতি মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা বদলে ফেলে নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচ্ছিন্ন কিছু অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিকল্প নিয়ে হাজির হতে পারে ব্রিকস। এ বিষয়গুলোও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়াবে। তবে উদ্যোগ কার্যকর করতে, ব্রিকস সদস্যদের অসম অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে সমতা আনতে হবে। যে সমস্যার সমাধান করা দেশগুলোর জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় হবে।
গ্লোবাল সাউথের 'কণ্ঠস্বর'
জুনের ব্রিকসের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রমানিয়াম জয়শঙ্কর বর্তমান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, 'স্বল্প কয়েকটি দেশের করুণার উপর বেশি সংখ্যক দেশকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।'
এই অনুভূতি উন্নয়নশীল সব দেশেই প্রতিধ্বনিত হয়। কারণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা মাত্র ৫ দেশের।
অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী চীন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলও। মধ্যপ্রাচ্যের দুই শত্রুভাবাপন্ন দেশ সৌরি আরব ও ইরানের মধ্যে বিরোধ মিমাংসা হয়েছে চীনের মধ্যস্ততায়। যে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের বড় পরাজয় বলে ভাবা হচ্ছে।
অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ চীন ও রাশিয়াকে আরো কাছে এনেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও ব্রাজিল নিয়েছে নিরপেক্ষ অবস্থানের কৌশল। দেশগুলো রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের মতো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি আবার একই সাথে যুদ্ধের যৌক্তিকতায় মস্কোর পাশেও দাঁড়ায়নি।
আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং ভারতের মতো উদীয়মান এশীয় শক্তিগুলির মধ্যে বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের ঐক্যবদ্ধ সুর বিদ্যমান। চীন ও রাশিয়াও নিজেদেরকে ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা এড়ানোতে চ্যাম্পিয়ন বলে একরকম ঘোষণা করছে। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর প্রতি সহমর্মী অবস্থান নিয়েছে।
ভারতও নয়া দিল্লিতে হতে চলা জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে আফ্রিকান ইউনিয়নের যোগ দেওয়া নিয়ে কাজ করছে।
নয়া দিল্লির থিংক ট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) ফেলো ভিভেক মিশ্রা বলেন, নিশ্চয়ই নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরির সুযোগ আছে। কারণ গ্লোবাল সাউথ এখন তাদের 'মুখপাত্র' খুঁজছে। বেশি সুবিধা পাবে এমন দেশের সাথে কাজ করতে চাইছে।
আবার ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার মতো বিষয়গুলো অন্যদেরকেও ভীত করছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই ক্ষমতা সবার ওপর প্রয়োগ করার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা
২০১৫ সালে ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) গঠন করা হয়। যার উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে উন্নয়ন অর্থায়নের উপর বিকল্পভাবে নিয়ন্ত্রণ আনা।
জোটটি 'ব্রিকস পে' তৈরিতে কাজ করছে। যার মাধ্যমে নিজস্ব মুদ্রা ডলারে রূপান্তর না করেই ব্রিকসের মধ্যে অর্থ লেনদেন করা যাবে। তবে প্রতিষ্ঠার ৮ বছর পরও এনডিবি ডলার নির্ভরতা কমাতে পারেনি। এখনো বৈশ্বিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৬০ শতাংশই ডলার।
ব্রিকসের নতুন মুদ্রা প্রচলনের বিষয়টিও জোর আলোচনায় আছে। যদিও বিষয়টি এবারের শীর্ষ সম্মেলনে আলোচিত হবে না বলে জানিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। জোহানেসবার্গভিত্তিক সাউথ আফ্রিকা ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ারের জ্যেষ্ঠ গবেষক গুস্তাভো ডি কারভালহো বলেন, ব্রিকসের মধ্যে ডলারকে প্রতিস্থাপন করবে এমন মুদ্রা নিয়ে আসার লক্ষ্য নেই। বরং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহারের বিকল্প উপায় অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
ব্রিকস এবং এতে জোগ দিতে ইচ্ছুক দেশগুলোর ধারণা পরিষ্কার। তারা ডলারের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত। কারণ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকির পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়লে অর্থ লেনদেনও চাপে পড়তে হয়।
ডি কারভালহো বলেন, ডলারের উপর নির্ভরতা কমানোর আরেকটি যুক্তি আছে। এটি বড় অর্থনৈতিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতামত বা সম্পৃক্ততা বাড়াবে।
ব্রিকসের বিগত ঘোষণাতেও বড় ও প্রভাবশালী অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও আইএমএফে 'সীমিত' প্রভাবের হতাশা উঠে এসেছে।
তাহলে জোটটে উপেক্ষা করা অসম্ভব করে তোলার উপায়? পাঁচ দেশের জায়গায় সদস্য সংখ্যা আরো বাড়িয়ে তোলা- মত দেন এই বিশেষজ্ঞ।
সংখ্যায় আধিক্য
ব্রিকস নিয়ে স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়শীল দেশগুলোর মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। সর্বশেষ আলজেরিয়া ব্রিকস ও এনডিবি-তে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তার আগেই মিশর, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে।
বর্তমানের জোটের সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে চীন ব্রিকস সম্প্রসারণের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মিত্র বাড়ানোর চেষ্টায় থাকা রাশিয়াও সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে এখনো সব সদস্য এই বিষয়ে সম্মত নয় যে, সদস্য সংখ্যা বাড়লেই ব্রিকস শক্তিশালী হবে।
ব্রাজিল পিছটান দেওয়ার কারণ হলো, দেশটি ভাবছে সদস্য সংখ্যা বাড়লে জোটে তার প্রভাব কমে আসবে। অন্যদিকে ভারতও সম্প্রসারণের বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী নয়। তবে উদ্যোগ নেওয়া হলে নয়া দিল্লি ভেটো দেবে না বলেই মত বিশ্লেষকদের। জোট সম্প্রসারণের পূর্বে ভারত মূলত চীনের সঙ্গে চলমান বিরোধ সমাধানে বেশি আগ্রহী।
শীর্ষ সম্মেলনের পার্শ্বরেখায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বৈঠক করবেন কি না তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্কই নির্ধারণ করবে জোট সম্প্রসারণের ভবিষ্যত।
'এদিক না হয় ওদিক' নয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন ব্রিকস 'যে কোন এক পক্ষকে' বেছে নিতে বাধ্য করবে না। কারভালহো বলেন, ব্রিকসের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ডলারে বাণিজ্য করার মতো কোনো একক মাধ্যমকে বেছে নেওয়া মতো কোনো ভাবনা নেই। বরং পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজেদের সুবিধা মতো মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ থাকতে পারে।
সহজ কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের ডলার আধিপত্যকে পুরোপুরি ধ্বংস করা নয়, বরং অন্য দেশগুলোর কাছে সমান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিকল্প তুলে ধরতে চাইছে ব্রিকস। এই ধারণা গ্রহণ করা বিশেষ করে ইউরোপের কাছে কিছুটা কঠিন হতে পারে। কারণ ইউরোপীয়দের কাছে ব্রিকস হলো চীন ঘেষা পশ্চিমা বিরোধী এজেন্ডায় পরিচালিত একটি জোট।
তবে শিগগিরই হয়তো ব্রিকস-কে 'অন্যদের মতামতও গুরুত্ব পাক' এমন বৈশ্বিক অনুভূতির প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হবে।