সাইফুল আজম: যে দুঃসাহসী বাংলাদেশি বৈমানিককে আজও স্মরণ করে ফিলিস্তিনিরা
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশি বৈমানিক সাইফুল আজম। তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এই সদস্য যোগ দিয়েছিলেন ইরাক বাহিনীর হয়ে। মাত্র ছয় দিন স্থায়ী হয়েছিল ওই যুদ্ধ, তবে অসম সাহস আর অনন্য রণনৈপুণ্যের জন্য সাইফুল আজম ঠিকই ফিলিস্তিনিদের মনে গেড়ে নিয়েছেন স্থায়ী আসন।
তাই তো ২০২০ সালের ১৪ জুন সাইফুল আজমের মৃত্যুতে শোকাহত ছিল ফিলিস্তিনিরা। যুদ্ধের ৫৩ বছর পরও এই দুঃসাহসী যোদ্ধাকে স্মরণ করেছেন তারা। যুদ্ধে আরব বাহিনী ব্যর্থ হলেও সাইফুল আজম ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পশ্চিম ইরাকে অবস্থান নিয়ে ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৫ দিনের মাথায় গাজা এবং সিনাইয়ের কর্তৃত্ব নিয়েছিল ইসরায়েল। জুনের ৫ তারিখে সিরীয় বিমানবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েলি বিমান সেনারা।
তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ইসরায়েল মিশরের কাছ থেকে গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ, জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নিয়েছিল। দখল করে নিয়ে ছিল সিরিয়ার গোলান মালভূমিও। তাদের সামনে তেমন প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ।
এ সময় ইসরায়েলিদের যমদূত হয়ে জর্ডানে যান সাইফুল আজম।
৬ জুন আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে মিসরীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। একই দিন বেলা ১২টা ৪৮ মিনিটে চারটি ইসরায়েলি সুপারসনিক 'ডেসল্ট সুপার মিস্টেরে' জঙ্গি বিমান ধেয়ে আসে জর্ডানের মাফরাক বিমান ঘাঁটির দিকে। এবার তাদের লক্ষ্য জর্ডানের ছোট্ট বিমানবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।
সে সময় ইসরায়েলি সুপারসনিকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সমকক্ষ বিমান আরবদের হাতে ছিল না। তবু ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে মাফরাক বিমান ঘাঁটি থেকে 'হকার হান্টার' জঙ্গি বিমান নিয়ে উড়াল দেন অসম সাহসী সাইফুল আজম।
আর সেই হকার হান্টার দিয়েই ক্ষিপ্রগতির দুটি ইসরায়েলি সুপারসনিক ঘায়েল করে ফেললেন সাইফুল আজম। তার অব্যর্থ আঘাতে ভূপাতিত হয় একটি ইসরায়েলি 'সুপার মিস্টেরে'। আরেক আঘাতে প্রায় অকেজো হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কোনো মতে পালিয়ে ইসরায়েলি সীমানায় গিয়ে আছড়ে পড়ে আরেকটি বিমান।
সেদিন অকুতোভয় বৈমানিক সাইফুল আজমের অকল্পনীয় বীরত্বের কারণে ইসরায়েলের পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়।
এমন অসাধারণ বীরত্বের জন্য পুরস্কারস্বরূপ সাইফুল আজমকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করে ইরাক ও জর্ডান সরকার।
সাইফুল আজমের কাছে ইসরায়েলি বৈমানিকদের ধরাশায়ী হওয়ার ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পরদিনই তার কৃতিত্বে ইরাকি বৈমানিক দলের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয় ইসরায়েলিরা।
৭ জুন ইরাকের 'এইচ-থ্রি' ও 'আল-ওয়ালিদ' ঘাঁটি রক্ষা করার দায়িত্ব পড়ে এক ইরাকি বৈমানিক দলের কাঁধে। আর সেই দলের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন সাইফুল আজম ।
সেদিন চারটি 'ভালচার বোম্বার' ও দু'টি 'মিরেজ থ্রিসি' জঙ্গি বিমান নিয়ে আক্রমণ চালায় ইসরায়েল।
একটি 'মিরেজ থ্রিসি' বিমানে ছিলেন ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোর। দ্রোরের গুলিতে নিহত হন আজমের উইংম্যান। তার হামলায় ভূপাতিত হয় দুটি ইরাকি বিমান। একটু পর এ ঘটনার মোক্ষম জবাব দেন আজম।
তার অব্যর্থ টার্গেটে পরিণত হয় দ্রোরের 'মিরেজ থ্রিসি'। সে আঘাতের পর বাঁচার উপায় না পেয়ে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরা দেন ক্যাপ্টেন দ্রোর। ওই যুদ্ধবন্দীর বিনিময়ে জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈন্যকে মুক্ত করে ইসরায়েল।
আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সাইফুল আজম একটি অনন্য রেকর্ড তৈরি করেন। ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভূপাতিত করেছেন সর্বোচ্চ চারটি ইসরায়েলি বিমান। যে জন্য তাকে 'নাত আল-সুজাহ' সামরিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
তিনটি ভিন্ন দেশের হয়ে আকাশযুদ্ধে অংশ নেওয়া পৃথিবীর একমাত্র বৈমানিক ছিলেন তিনি। এই তিনটি দেশ হচ্ছে; পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক। আর মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ বিমানবাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন চারটি দেশের হয়ে।
যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনী বিশ্বের ২২ জন 'লিভিং ইগলস' এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
সাইফুল আজমের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদ সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক এই বৈমানিকের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি আরো লেখেন, আল-আকসা মসজিদ রক্ষায় অংশীদার ছিল আমাদের বাংলাদেশি ও পাকিস্তানের ভাইয়েরা।
ফিলিস্তিনি অধ্যাপক নাজি শওকরি তার টুইটারে লেখেন, 'সাইফুল আজম ফিলিস্তিনকে ভালোবাসতেন এবং জেরুজালেমের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন।'
ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত সাংবাদিক তামের আল-মিশালও সাইফুল আজমের প্রশংসা করেন এবং তাকে 'দ্য ঈগল অব দ্য এয়ার' বলে সম্বোধন করেন।
সাইফুল আজমের জন্ম ১৯৪১ সালে, পাবনা জেলার খাগড়বাড়িয়াতে। বাবার কর্মসূত্রে শৈশবের কিছু সময় তার কাটে কলকাতায়। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তার পরিবার আবার ফিরে আসে বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। মাধ্যমিকের পড়াশোনা করেন এখানেই। ১৪ বছর বয়সে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয় উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষালাভের জন্য। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দু' বছর পর তিনি পাইলট অফিসার কোর্স সম্পন্ন করেন। সে বছরেই তিনি জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি সর্বপ্রথম নিজের রণনৈপুণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পান। এসময় তার প্রথম শিকারে পরিণত হয় ভারতীয় 'ফোলান্ড নেট' জঙ্গি বিমান। ভূপাতিত বিমান থেকে ভারতীয় ফ্লাইট অফিসার বিজয় মায়াদেবকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করা হয়।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর মূল জঙ্গি বিমান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-৮৬ স্যাবর। আর এই 'স্যাবর কিলার' নামে বিশেষ পরিচিত ছিল যুক্তরাজ্য থেকে কেনা ভারতের 'ফোলান্ড নেট' জঙ্গি বিমান।
সেই ঘাতক আতঙ্কের অবসান ঘটে সাইফুল আজমের হাতে। এ কৃতিত্বে তার সহকর্মীদেরও যুদ্ধের মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায়।
আকাশপথের সম্মুখ সমরে 'ফোল্যান্ড নেট' বিমানকে পরাজিত করা সে সময় এক বিরল ঘটনা ছিল। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সাইফুল আজমকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা 'সিতারা-ই-জুরাত' এ ভূষিত করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি দেশের নবগঠিত বিমান বাহিনীর নবাগত সদস্যদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে একজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন।
অবসরের পর সাইফুল আজম ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দুবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ১৯৯১-৯৬ সালে পাবনা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাইফুল আজম। এরপর নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান 'নাতাশা ট্রেডিং এজেন্সি'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি । ২০২০ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়।