মূলধন ঘাটতিতে আরও ৪ ব্যাংক
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে আরও ৪ ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
নতুন করে ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকগুলো হলো- দেশীয় মালিকানাধীন বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংক এবং বিদেশি মালিকানাধীন হাবিব ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকগুলোতে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩,৭৩২ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিক শেষে ১১টি ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৩৩,৫৭৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ৯ ব্যাংকের মধ্যে ৭ ব্যাংকই বর্তমানে মূলধন ঘাটতিতে আছে। ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এসব ব্যাংকের বর্তমান মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮,৪৭৩ কোটি টাকায়।
এছাড়া বেসরকারি ৬ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ৫,১৮৫ কোটি টাকা। নতুন করে যোগ হওয়া দুই ব্যাংক বাদে অন্য ব্যাংকগুলো হলো- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুন শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংকে জুন প্রান্তিকে ঘাটতি কিছুটা বেড়েছে; অন্যদিকে জনতা, সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে কমার দিকে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "ব্যাংকগুলো যে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে এটি কাটানোর জন্য দুইটি উপায় আছে। প্রথমত, ব্যাংকগুলোকে তাদের খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। খেলাপি ঋণ কমলে প্রভিশনের ওপর চাপ কমবে। ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি কমে আসবে।"
"দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তা পরিচালকদের নতুন করে ক্যাপিটাল ইনজেক্ট করতে হবে। নতুন ক্যাপিটাল আসলে ঘাটতিও কমে আসবে," বলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেটের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এছাড়া, বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দেখায়, ব্যাংকিং খাতে ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি রেশিও বা ক্যাপিটাল টু রিস্ক (ওয়েটেড) অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) মার্চের ১১.২৩ শতাংশ থেকে কমে জুনে ১১.১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বরে এই অনুপাত ছিল ১১.৮৩ শতাংশ।
একটি ব্যাংক কতটা ভালোভাবে সকল নিয়মনীতি ও শর্তপূরণ করছে তা নির্ধারণের একটি সূচক হল সিআরএআর। এটি রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটের সঙ্গে মূলধনের তুলনা করে পর্যবেক্ষকদের ব্যাংকের ব্যর্থতার ঝুঁকি নির্ধারণে সহায়তা করে। এটি আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষিত রাখতে এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও দক্ষতা প্রচারে ব্যবহৃত হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চের তুলনায় জুনে ব্যাংকিং খাতের উদ্বৃত্ত মূলধন ১,৬১১ কোটি টাকা কমে ১২,৭৬২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে উদ্বৃত্ত মূলধন ছিল ২১,৭৯৮ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো বাদে অল্প কয়েকটি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত মূলধন বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "অনেক ব্যাংকের প্রচুর খেলাপি ঋণ রিশিডিউল করার কারণে মোট খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানো হচ্ছিল। তবে মার্চ ও জুন কোয়ার্টারে নতুন করে রিশিডিউল করার সুবিধা না পাওয়ার কারণে যেসব খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখানোর সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল, সেটি আর মিলেনি। ফলে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে ১.৫ লাখ কোটি ছাড়িয়েছে।"
তিনি বলেন, "আর খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশন রাখতে হয়। এসব কারণে একটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়ে। তবে জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো নেট প্রফিট বাড়ায় প্রভিশন রাখার সক্ষমতাও বেড়েছে। তাই ক্যাপিটাল শর্টফল (মূলধন ঘাটতি) খুব বেশি মাত্রায় বাড়েনি।"
জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বকেয়া ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ বেড়ে ১০.১১ শতাংশ হয়েছে, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৮.৮০ শতাংশ।