সাগরের পানি দিয়ে গাজার টানেল ভাসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ইসরায়েলের
গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ভূগর্ভস্থ টানেল ধ্বংসের জন্য ইসরায়েল নতুন এক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাষ্ট্রটি বেশ বড়সড় একাধিক পাম্পের সাহায্যে সাগরের পানি দিয়ে টানেলগুলো ভাসিয়ে দিতে চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কৌশলের মাধ্যমে একদিকে টানেল ধ্বংস হবে, অন্যদিকে টানেলে লুকিয়ে থাকা হামাস যোদ্ধারা বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে। তবে এটি গাজায় পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর গাজার আল-শাতি শরণার্থী শিবির থেকে প্রায় এক মাইল উত্তরে কমপক্ষে পাঁচটি পাম্প জড়ো করেছে। প্রতিটি পাম্পই ভূমধ্যসাগর থেকে পানি উত্তোলন এবং ঘণ্টায় কয়েক হাজার ঘন মিটার পানি প্রবাহিত করতে সক্ষম। যা কিনা মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবগুলো টানেলকে ভাসিয়ে দিতে পারে।
আইডিএফ কর্মকর্তারা জানান, গত মাসের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে এ পরিকল্পনার কথা জানায় ইসরায়েল। পরে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা ও সামরিক কার্যকারিতার বিপরীতে এর পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হয়।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা জানেন না যে ইসরায়েল পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের কতটা কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরায়েল এটি এগিয়ে নিতে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবে পরিকল্পনাটি বাতিলও করেনি।
এ পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ এনিয়ে ব্যক্তিগতভাবে উদ্বেগ জানিয়েছেন। অনেকে আবার সমর্থন জানিয়ে বলেছে যে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো দ্বিমত বা বিরোধিতা নেই।
ইসরায়েলি বাহিনী এপর্যন্ত ৮০০টি টানেল চিহ্নিত করেছে। যদিও তারা বলছে যে, হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক এর চেয়েও অনেক বড়।
পরিকল্পনাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, টানেল ভাসিয়ে দেওয়ার কয়েক সপ্তাহব্যাপী দীর্ঘ এ প্রক্রিয়ার ফলে হামাস যোদ্ধারা টানেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে। এমনকি সেখানে সম্ভাব্য বন্দি থাকা জিম্মিদেরও বাইরে বের করে আনতে হবে তাদের।
গাজা থেকে জিম্মিদের সবার মুক্তির আগে ইসরায়েল এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করবে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আকষ্মিক হামলা চালানোর পর ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে আটক করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস।
ওই সূত্রটি বলে, 'টানেলগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়াটা কতটা ফলপ্রসূ হবে সে ব্যাপারে আমরা কেউই নিশ্চিত নই। আর এটি আদৌ কার্যকরী হবে কি না সেটি জানাও অসম্ভব। কারণ, আমরা জানি না যে কীভাবে টানেলের মধ্যে দিয়ে সাগরের পানি প্রবাহিত হবে।'
পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের আগে ইসরায়েলি বাহিনীকে অবশ্যই তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য তীব্র আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর সামরিক অভিযানে ইতোমধ্যেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা। বাস্তুচ্যূত হয়েছে স্থানীয় ২০ লাখের বেশি বাসিন্দার অধিকাংশই।
আইডিএফের এক কর্মকর্তার কাছে এ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অসম্মতি জানান। তিনি শুধু বলেন, বিভিন্ন সামরিক ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ব্যবহার করে বিভিন্ন উপায়ে হামাসের সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর সক্ষমতা ধ্বংস করতে কাজ করছে আইডিএফ।'
লুকিয়ে থাকা ও জিম্মিদের বন্দি করে রাখাসহ আরো কিছু কারণে হামাস ব্যাপক টানেল সিস্টেম ব্যবহার করছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সুপেয় ও নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছে গাজার বাসিন্দারা। সুপেয় পানির উৎসগুলো বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর আগে ইসরায়েলি পাইপলাইনের মাধ্যমে গাজায় পানি সরবরাহ করা হতো। এগুলোর মধ্যে একটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্য দুটিতেও পানি সরবরাহ ব্যাপক পরিমাণে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যেখানে ফিলিস্তিনিরা দিনে জন প্রতি ৮৩ লিটার পানি পেত, এখন সেখানে তারা মাত্র তিন লিটার পানি পাচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলেছে, প্রত্যেকের জন্য প্রতিদিন ন্যূনতম ১৫ লিটার পানি নিশ্চিত করা উচিত।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জন অল্টারম্যান জানান, টানেলগুলো কীভাবে ভেসে যাবে কিংবা কতটুকু পানি মাটি শুষে নেবে এবং এর প্রভাব কি হবে তা স্পষ্ট নয়। তাই সাগরের পানিতে টানেলগুলো ভাসিয়ে দেওয়ার প্রভাব সম্পূর্ণরূপে মূল্যায়ন করা কঠিন।
পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কর্মকর্তারা পরিকল্পনাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন ঠিকই, তবে এখন পরিকল্পনাটির সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে তারা কিছু জানেন না।
তিনি স্বীকার করেন যে ইসরায়েলের এমন পদক্ষেপ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলবে এবং বৈশ্বিক নিন্দারও শিকার হতে পারেন তারা।
সাবেক আরেক কর্মকর্তা বলেন, গাজায় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও মারাত্মকভাবে দুষিত হয়েছে। যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে এসব ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে।
নেদারল্যান্ডভিত্তিক শান্তি সংগঠন পিএএক্সের এই কর্মী ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণাকারী উইম জোয়াইনেনবার্গ বলেছেন, ধারণা করা হয় যে হামাসের টানেল নেটওয়ার্কের এক-তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টানেলের অবশিষ্ট অংশটি ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য প্রায় ১০ লাখ ঘন মিটার পানির প্রয়োজন পড়বে।
এক ইমেইল বার্তায় তিনি বলেন, গাজায় ভূগর্ভস্থ পানি ইতোমধ্যেই লবণাক্ত হতে শুরু করেছে। টানেল ভাসিয়ে দেওয়ার এ পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই দূষিত হওয়া গাজার মাটিকে আরো দূষিত করবে। সেই সঙ্গে টানেলে মজুদ করে রাখা বিভিন্ন বিপজ্জনক বস্তুগুলোও মাটি শুষে নিতে পারে।
২০১৫ সালে গাজার সঙ্গে সীমান্তবর্তী রাফা ক্রসিংয়ের নিচে সন্ত্রাসীদের একটি ভূগর্ভস্থ টানেল সাগরের পানি দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল মিসর। এতে আশে-পাশের অনেক কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।