‘আগে অথবা পরে, বিপিএল বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি হবে’
এবার নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) দল গড়েছে ফরচুন সুজ লিমিটেড। দেশি-বিদেশি তারকা ক্রিকেটার নিয়ে প্রতিবারই শক্তিশালী দল গড়ে ফরচুন বরিশাল নামে খেলা ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। কখনও শিরোপা জিততে পারেনি দলটি, দেখতে পারেনি লাভের মুখও। এরপরও দলটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের আশা, বাংলাদেশে বড় ইন্ডাস্ট্রি হবে বিপিএল এবং দেরি হলেও একটা সময়ে ঠিকই লাভ করা যাবে টি-টোয়েন্টি এই ঘরোয়া টুর্নামেন্ট থেকে।
প্রতিবারের মতো এবারও তারকাবহুল দল গড়েছে ফরচুন বরিশাল। আরও একবার শিরোপার লক্ষ্যে স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছে তারা। বিপিএলে দল গঠনের প্রক্রিয়া, দল গড়তে খরচ, দল গড়ার উদ্দেশ্য, বিপিএলের মান ও ক্রিকেট বিশ্বে অবস্থান, এবারের দল নিয়ে আশা ও দলের কাছে প্রত্যাশাসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন ফরচুন বরিশাল ও ফরচুন সুজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মিজানুর।
এবারের দল নিয়ে সন্তুষ্ট মিজানুর, তবে উৎকণ্ঠা আছে নিজ নিজ বোর্ড থেকে বিদেশি ক্রিকেটারদের অনাপত্তিপত্র পাওয়া নিয়ে। তিনি বলেন, 'আমরা অত্যন্ত ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ছাড়া আমাদের সব ক্রিকেটারই ফিট আছেন। বিদেশি ক্রিকেটার নিয়ে আমাদের একটু জটিলতা আছে, অনেক খেলোয়াড়েরই অনাপত্তিপত্র পাইনি আমরা এখনও। আশা করি পেয়ে যাব। অন্যান্য দলেরও একই অবস্থা, কারণ এই সময়ে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগও হয়।'
শিরোপাকে লক্ষ্য করে অন্তত ছয় মাস ধরে দল গোছানোর কাজ করেন জানিয়ে ফরচুন বরিশালের স্বত্ত্বাধিকারী বলেন, 'আশা তো সব সময় জেতারই থাকে। আমাদের আশা এবার যেন ফাইনালে যেতে পারি এবং ফাইনাল জিতে ট্রফিটা নিজেদের করে নিতে পারি। এটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা অন্তত ছয় মাস আমরা কাজ করেছি দল গড়তে। কিন্তু দিনশেষে এসবের কোনোটাই কাজে লাগেনি। কারণ এতোগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ চলছে যে, খেলোয়াড় সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আমরা যার সঙ্গে চুক্তি করেছি, দেখা গেছে সে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তো ছয় মাসের কাজ আমার কাছে শূন্য মনে হয়েছে। চূড়ান্তভাবে যে কাজটা করছি, মনে হচ্ছে এটাই আসল কাজ।'
দুই বছর আগে টিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিজানুর বলেছিলেন, বিপিএলে দল গড়তে ১০-১২ কোটি টাকার মতো খরচ হয়। এবারও তেমনই খরচ হয়েছে, তবে আগের মতো স্পন্সর পাওয়া যায়নি। অন্যতম কারণ হিসেবে বাংলাদেশের দলের বিশ্বকাপ ব্যর্থতাকে উল্লেখ করেছেন তিনি, 'আমাদের খরচ বাড়েনি। কারণ, সবাই জানে সারা বিশ্বেই অবস্থা খুব খারাপ। তো আমরা সেভাবেই খেলোয়াড়দের বলেছি, খেলোয়াড়রা ওভাবেই এটাকে মেনে নিয়েছে। আর আমাদের খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমরা আগে থেকেই যোগাযোগ করে নিয়েছি, এটায় সমস্যা হয়নি।'
'আমরা মূলত স্পন্সর নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। স্পন্সর পাচ্ছি না, এটা বড় সমস্যা। আমার কাছে মনে হয়, একটা কারণ হতে পারে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স। আমরা বিশ্বকাপে খারাপ করেছি, কিন্তু এটা তো হতেই পারে। খেলতে গেলে জিতবে, হারবে; এটাই তো স্বাভাবিক। তবে সবচেয়ে বড় কারণ নির্বাচন। সবাই আমরা নির্বাচন নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছি। নির্বাচন শেষে বিপিএল নিয়ে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। স্পন্সর যে পাচ্ছি না, এটাই মূলত কারণ।' যোগ করেন তিনি।
বিপিএলের দশম আসর চলছে, যদিও টুর্নামেন্টটির তেমন উন্নতি হয়নি। উল্টো জৌলুশ হারিয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগটি। এমন আসরে দল গড়ে এখনও লাভের মুখ দেখতে পারেননি মিজানুর, তারপরও বিপএল নিয়ে বড় আশা তার, 'আমি যেটা সব সময় বলে থাকি, আগে অথবা পরে, বিপিএল বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি হবে। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে খেলা অন্যভাবে মিশে গেছে। এ কারণেই মনে হয় বিপিএল অনেক বড় ইন্ডাস্ট্রি হবে আগামীতে।
'কোভিডের পরে যেহেতু আমরা (বিপিএল) একটু নিচে নেমে গেছি, বিপিএল ভালোভাবে আবার গুছিয়ে নেবে। কোভিডের কারণে তখন পর্যাপ্ত ইনস্ট্রুমেন্ট পাওয়া যায়নি, স্ট্যান্ডার্ড কমেছে। ইচ্ছা থাকলেও বিসিবি সংশ্লিষ্ট মানুষ আনতে পারেনি। অনেক জটিলতা ছিল। এবার হয়তো আগের চেয়ে অনেক ভালো হবে।' বলেন তিনি।
যে লক্ষ্যে বিপিএলে দল গড়া, তা এখনও পূরণ হয়নি জানিয়ে মিজানুর বলেন, 'লক্ষ্য পূরণে একটু পিছিয়ে আছি সত্যি বলতে। আমার আশা ছিল আমার বিভাগে (বরিশাল) খেলা হবে, আমি একটা স্টেডিয়াম করব। তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে আমি দল গঠন করব। যেমন আইপিএলে দেখেন অঞ্চলভিত্তিক, কলকাতা নাইট রাইডার্স যদি আপনি গড়েন, কলকাতা থেকে আপনাকে পাঁচজন খেলোয়াড় নিতে হয়। এমন একটা চিত্র বাংলাদেশে যেন একটা সময়ে এসে যায়, সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি যেহেতু বরিশালের, বরিশাল নিয়ে আমাকেই তো কাজ করতে হবে। এমন পরিকল্পনা ছিল, কোভিডের কারণে হয়ে ওঠেনি।'
বিপিএলের আর্থিক গঠন, মান, স্পন্সরশিপ; সব বিবেচনা করে ২০২২ সালে মিজানুর বলেছিলেন, বিপিএল থেকে বিনিয়োগের ২০ শতাংশও হয়তো আয় করা সম্ভব হবে না। দুই বছর পেরোলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি, এরপরও অবশ্য তিনি আশাবাদী, 'পুরো বিশ্বই খারাপ অবস্থায় আছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, মুদ্রাস্ফিতি পুরো বিশ্বেই আছে। এমন অবস্থায় আমরা অনেকটাই ওভারকাম করেছি, কিন্তু পুরোপুরিভাবে হয়নি। এখন পর্যন্ত বিপিএলে লাভ করতে পারিনি। তবে এক সময় না এক সময় লাভে যেতে পারবো ইনশাআল্লাহ।'
বিশ্বের অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, বিপিএলে তা থাকলে স্পন্সরশিপের বাইরেও দলগুলো আয় করতে পারে বলে মনে করেন মিজানুর। এ নিয়ে অবশ্য আক্ষেপ নেই তার, বরং খুশিই ফরচুন বরিশালের স্বত্ত্বাধিকারী, 'অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোয় যেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে, সেগুলো যদি বিসিবি কখনও বিবেচনা করে, তখন সেটা সম্ভব হবে। এখন পর্যন্ত সেটা করেনি, আশা করি নিকট ভবিষ্যতে তারা সেটা করবে।'
'সব মিলিয়ে আমি খুশি। বিসিবি যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে, সেটায় আমি সন্তুষ্ট। গতবার একটা বিষয়ে বিসিবিকে আমি অনুরোধ করেছিলাম, আমার মনে হয় সেটা নিয়ে তাদের ভাবা উচিত। আমরা সাতটা দল, খেলা দেখার জন্য সাতটা দলেরই জায়গা থাকে। তারা যেন সবাই খেলা দেখতে পারে, আমন্ত্রণ থাকে। আগেরবার করেছিলাম রানার্সআপের জন্য ট্রফি রাখতে, সেটা বিসিবি করেছে। এবারও একই অনুরোধ থাকবে বিসিবির প্রতি, সবগুলো দলই যেন খেলা দেখতে পারে। মালিকরা যেন সম্মানের সঙ্গে খেলা দেখতে পারে। আমরা শুধু সম্মানটা চাই।'
বিপিএলের প্রাইজমানি, ডিআরএস, আম্পায়ারিং, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়েও অভিযোগ নেই মিজানুরের, 'এ বছর ইতোমধ্যে বিসিবি ঢেলে সাজিয়েছে। আমাদের অভিযোগ করার কোনো জায়গাই নেই। আমি যা তথ্য পেয়েছি, এবার খুবই ভালো কাজ করেছে বিসিবি। এটা যদি হয়, তাহলে আমার মনে হয় কোনো সমস্যা নেই। আমরা আমাদের ভাবনা বা পরামর্শ জানালে বিসিবি সাড়া দেয়, মিটিং ডাকে। আমাদের সঙ্গে কিন্তু বিসিবির মিটিং হয়। বিপিএল সংশ্লিষ্ট সব ধরনের মিটিংয়েই আমাদের ডাকা হয়।'
বিপিএলকে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট বলা হলেও মাঠে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় না। দর্শকরা সেভাবে আসেন না। যদিও মিজানুরের ভিন্ন মত, 'মিরপুরে ঢাকার মানুষ সব সময়ই খেলা দেখে। অন্যান্য শহরে গ্যালারি পূর্ণ থাকে। চট্টগ্রাম, সিলেটে প্রচুর দর্শক হয়। বরিশালে খেলা দেন, পাঁচটা স্টেডিয়াম ভরা যায়, এমন দর্শক পাবেন। বগুড়াতে দিলেও হবে। বরিশালে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে মাঠটা প্রস্তুত করেছে, আমি আশাবাদী যে আগামী মৌসুমেই হয়তো বরিশালে বিপিএরের খেলা হবে। হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলা হলে প্রচুর দর্শক হয়। এটা একেবারে ঠিক নয় যে, দর্শক হয় না।'
বাংলাদেশে ক্রিকেটের অবস্থান, জনপ্রিয়তা অনুযায়ী টুর্নামেন্ট হিসেবে বিপিএলে সেভাবে এগোতে পারেনি। এ বিষয়ে মিজানুরের ব্যাখ্যা, 'উন্নতি কিন্তু হচ্ছে। মাঝে দুই বছরে হয়তো করোনার জন্য একটু পিছিয়ে গিয়েছিল বিপিএল। আমরা কিন্তু দুইয়ে ছিলাম, আইপিএলের পরই বিপিএল ছিল। একটা সময়ে আসলেই দুইয়ে ছিল বিপিএল। এখন হয়তো বিপিএল সেখানে নেই, তবে ফিরে আসবে বলে আমার ধারণা।'