জল্লাদের আত্মজীবনী: পুঞ্জীভূত ভুল আর আক্ষেপে ভরপুর যে জীবন
আত্মজীবনী লিখতে কি ভালো লেখক বা সাহিত্যিক হতে হয়? 'কেমন ছিল জল্লাদের জীবন' বইটি পড়লে তা মনে হবে না। এবারের বইমেলায় জ্ঞানীগুণী লেখকের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে অনেক 'অলেখকদের' বইও — এমন দাবি করে পত্র-পত্রিকায়, ফেসবুকে এ নিয়ে মানুষের সমালোচনা, বিদ্রুপ, ঠাট্টার শেষ নেই।
তবে উল্লিখিত বইটি পড়ে কোনো পাঠকের কাছে মনে হতেই পারে: সাহিত্যগুণ থাকুক বা না থাকুক, তথ্যসমৃদ্ধ হোক বা না হোক, অন্তত নিজের জীবনকে উদাহরণ হিসেবে টেনে বই লেখা যেতে পারে। 'কেমন ছিল জল্লাদের জীবন' বইটা ধাঁচেরই। বইটির লেখক জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। গতবছর ২০২৩ সালের ১৮ জুন কেরাণীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
৯৬ পৃষ্ঠার এই বইয়ে জল্লাদ তার বাল্যকাল থেকে শুরু করে বর্তমানে তিনি কেমন আছেন, কী করছেন সে সবকিছু তুলে ধরেছেন। মোট ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বইটিতে জীবনের শুরু থেকে এই শেষ পর্যায় পর্যন্ত মানুষ হিসেবে তার চাওয়া-পাওয়া, শাস্তি, জীবনের না বলা অনেক কথা তিনি তুলে ধরেছেন। নির্বিকারে স্বীকার করে গেছেন ফেলে আসা জীবনের ভুল, অন্যায় দিকগুলো নিয়ে। আবার কোথাও হয়তো ইচ্ছেকরেই বিশেষ কারও মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে গেছেন – পাঠক হিসেবে এমনটাও মনে হতে পারে!
আদরে যত্নে বেড়ে উঠেছিলেন শাহজাহান
পাটব্যবসায়ী হাছান আলী ভূঁইয়া আর মা সবমেহের বেগমের কনিষ্ঠ সন্তান শাহজাহান ভূঁইয়া। বড় তিন বোন আর বাবা মায়ের আদরযত্নেই কেটেছে তার বাল্যবেলা। তার প্রতি আদরের নমুনা দিতে তিনি লিখেছেন, 'ছোটোবেলা থেকেই আমি বাবা মায়ের খুব আদরের ছিলাম। তার প্রমাণ হলো, জন্মের পর থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত আমি কোনোদিন ভাত মুখে নেইনি।'
আরও পড়ুন: ৬০ ফাঁসির জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া: ৪৪ বছর কারাভোগের পর জীবন যেমন যাচ্ছে
শাহজাহানের বাবা হাছান আলী ভূঁইয়ার সততা এবং নামের প্রভাব ছিল সারা গ্রামজুড়েই। তাই কখনো কোনোকিছু টাকা দিয়ে কিনতে হয়নি শাহজাহান ও তার বোনেদের। লজেন্স, চিপস, মিষ্টি পছন্দ হলেই বাবার নাম বললে দিয়ে দিত দোকানদাররা, বাজার করতে গেলে বাজারের সবচেয়ে বড় তাজা মাছ, সতেজ তরকারিটা তুলে দেওয়া হতো তার বাবার ব্যাগে।
একে তো ছিলেন সবার অতি আদরের, সেইসঙ্গে ছিলেন গৃহস্থ বাড়ির সন্তান। টাকাপয়সা বা অভাব বলতে কিছু ছিল না। স্বাধীনতার পর বাহাত্তর সালে যখন দেশে ভয়ংকর দূর্ভিক্ষ শুরু হয় তখনও শাহজাহানদের না খেয়ে থাকতে হয়নি। ফলে ঘুরেবেড়ানো, বাবা মায়ের কাছে এটা ওটা আবদার আর খেলাধুলাই ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী।
সাধারণত কোনো কুখ্যাত খুনি বা আসামির ছেলেবেলার জীবন ঘাঁটলে দেখা যায়, তাদের জীবন কেটেছে হয়তো অর্থকষ্টে, নয়তো মানসিক কোনো আঘাত থেকে। কিন্তু শাহজাহানের জীবন সম্পর্কে বইটি পড়লে অন্য আর দশটা শিশুর মতোই তার ছেলেবেলাও স্বাভাবিক সুস্থ জীবন বলে মনে হয়।
তবে একদম ছোট থেকেই তার মধ্যে একধরনের প্রতিশোধপরায়ণতা ছিল। যেমন, খেলতে গিয়ে বয়সে বড় যদি কেউ গায়ে হাত তুলত বা ধমক দিত, ঐ মুহূর্তে চুপ থাকলেও ঠিকই পরে সুযোগ বুঝে আঘাত করতেন তাদের ওপর। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন: 'কারণ জানতাম, খালি হাতে আমি তাদের সাথে পারব না। তাই বাঁশের কঞ্চি কেটে নিয়ে তাদের সাথে আবার দেখা করতাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালাতাম। আমার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বাঁশের কঞ্চির একটা আঘাতই যথেষ্ঠ ছিল।'
একটু বড় হয়ে তার মধ্যে দেখা দিল চুরি করার প্রবণতা। ছোট বোন হাসিনার সাথে বাজার নিয়ে ফেরার সময় রাস্তার ধারে একটি মরিচক্ষেত থেকে দুটো মরিচ চুরি করে নিয়ে আসেন শাহজাহান। যদিও তখনও চুরি কী জিনিস তা তিনি বুঝতেন না। কিন্তু তার বাবা ছিলেন প্রচণ্ড সৎ একজন মানুষ। তাই ছেলের চুরির ঘটনা শুনে তিনি আর মেনে নিতে পারেননি। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মেরেছিলেন ছেলেকে। কোনো অপরাধ করলেই বাবা কঠোর শাসন করতেন। শাহজাহানের আত্মজীবনীতে বারবার উঠে এসেছে তার বাবার এই শাসনের কথা।
কিন্তু তাতে নিয়তি হয়তো বদলানো সম্ভব না। তাই সপ্তম শ্রেণি থেকেই তিনি বেশ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছিলেন। ক্লাস ফাঁকি দিতেন, স্কুলের ডাব, জাম্বুরা চুরি করতেন। দিনদিন তার উৎপাত বেড়েই চলছিল। এ কারণে স্কুল থেকে বের করেও দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু তাতে বরাবরই নির্লিপ্ত ছিলেন তিনি। নিজের নিলির্প্ততা বোঝাতে লিখেছেন, "হেডমাস্টার যখন অফিসে ডেকে নিয়ে বললেন, আমাকে আর এই স্কুলে রাখবেন না। আমি মনে মনে বললাম, 'দেশে কি ইশকুল একটাই না-কি?'"
এরপর শাহজাহান বাহাত্তরের মেট্রিকে অটোপাশ করেন। যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মারামারি করা, বেকার ঘুরে বেড়ানো, সাথে ছিল বাগানে ঢুকে চুরি করার অভ্যাস – অর্থাৎ বেশ ভবঘুরে জীবন।
এভাবেই অল্প বয়স থেকেই শাহজাহান চলে যাচ্ছিলেন বিপথে। শাসন পেয়েছেন কেবল বাবার থেকেই। মা শুধু বোঝাতেন ভালোমন্দের হিসেব। কিন্তু বাবার শাসন এবং মায়ের আদর কোনোটাই শাহজাহানকে ফেরাতে পারেনি স্বাভাবিক পথের দিকে। কোনো আয় রোজগার না করে, ভবঘুরে জীবন এবং উচ্ছৃঙ্খলপনাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার জীবনের প্রধান কাজ।
বিয়েও করেছিলেন
একপর্যায়ে ছেলে বাজে পথে এগোচ্ছে দেখে বাবা হাছান আলী ভাবলেন বেকার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে একটা চাকরিতে ঢোকাতে হবে। সংসারের দায়িত্ব পড়লে হয়তো শুধরোবে। যেদিন পাত্রী দেখতে যাওয়া হয়, সেদিনই বিয়ে হয়। মেয়ের বাবা কথা দেন, বিয়ের পর জামাইকে চাকরি দেবেন। কিন্তু মেয়ের বাবাও আর চাকরি দিলেন না, এদিকে শাহজাহানও বৌ না নিয়ে এসে জেদ ধরে বসে রইলেন।
এক পর্যায়ে বাবা হাছান আলীর জোরাজুরিতেই ছেলেকে সেনাবাহিনীর পদাতিক বাহিনীতে যোগ দিতে হলো। সেখানেও মন বসছিল না। এরমধ্যে শাহজাহান বাবা হলেন। কিন্তু ভূমিষ্ঠের পরদিনই মারা গেল বাচ্চাটি। ফিরে এসে আর মন টিকতো না সেনাবাহিনীতে, তার ওপর ছিল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাজে ব্যবহার। সব মিলিয়ে সহ্য করতে না পেরে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। আর এই সিদ্ধান্তটাই তার জীবনের প্রথম বড় ভুল ছিল বলে তিনি স্বীকার করে গেছেন বইয়ের শেষদিকে।
সেনাবাহিনী থেকে সেবার পালিয়ে আসার কারণে তার নামে ওয়ারেন্ট জারি হয়। সেনাবাহিনীর আইন লঙ্ঘন করায় এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডিত হন শাহজাহান। ১৯৮১ সালে সেটাই ছিল তার জেল জীবনের শুরু।
এক মিশ্র অনুভুতি
কোনো 'অন্যায় না করেও' সেবার প্রথম কারাগার ঢুকতে হয় তাকে। কিন্তু তার জীবনের গতিপ্রবাহ দেখলে বোঝা যায়, এর অন্য উপায়ও ছিল তার হাতে। সঠিক পরিবেশ, আদরযত্ন পেয়েও তিনি বেছে নিয়েছিলেন ভবঘুরে জীবন। আর দশটা ছেলের মতো দায়িত্ব নেওয়ার কোনো চিন্তা তার ছিল না।
যদিও মুক্তি পাবার পর শাহজাহানকে নিয়ে বের হওয়া লেখালেখি এবং সাক্ষাৎকারগুলোতে শাহজাহানের জীবন নিয়ে মানুষের আবেগ, খারাপ লাগা, সহানূভূতিই প্রকাশ পেয়েছে একপ্রকার। বইটির প্রকাশক নিজেও সে চিন্তা থেকেই বইটি ছাপাতে সাহায্য করেছেন।
কিন্তু বইটি পড়লে পাঠকের মনে এক মিশ্র অনুভুতিই তৈরি হতে পারে। তার প্রথম জেলে যাওয়ার ঘটনাটি পড়ে পাঠকের কাছে শাহজাহানের জীবনকে পরিস্থিতির শিকার মনে না হয়ে বরং তার চরিত্রের খামখেয়ালিকেই এমন জীবনের জন্য দায়ী মনে হওয়াটা খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়।
আবার কারাগার গিয়ে তিনবেলা খাবারের প্লেটে বড় বড় পোকা খুঁজে পাওয়া, একই চৌবাচ্চার পানি দিয়ে শৌচকর্ম আর খাওয়াদাওয়ার কাজ সারা, ড্রেনের সঞ্চিত পানি দিয়ে নিজ নিজ খাবারপ্লেট দিয়ে পানি উঠিয়ে গোসল করা, শৌচকার্যের জন্য সেলের মধ্যে এক কোণায় চটের বস্তার বেড়া দেওয়া — এসব বর্ণনা পড়লে কখনো পাঠকের মনে শাহজাহানের জন্য মায়া, করুণারও জন্ম নেবে।
তবে বুদ্ধিমান শাহজাহান দমে যাওয়ার পাত্র নন। পরিচিত মানুষ থাকায় অল্প দিনেই চৌকা ওয়ার্ডে থাকার সুযোগ পান। চৌকা ওয়ার্ডে থাকার কারণে ভালোমত খাবার দাবারও কপালে জুটতো তার। যদিও সেই আটার রুটি থেকে বড় বড় পোকা খুঁজে পাওয়া থেকে তখনো মুক্তি মেলেনি।
সারাদিন কাজ, তিনবেলা খাওয়া এবং ঘড়ি ধরে বিশ্রাম এভাবেই চলছিল তার জীবন। কিন্তু কারাগার থেকে বের হয়ে কী করবেন তা ভেবে দুশ্চিন্তা হতো। কারাগারের অন্যান্য কয়েদীদের সঙ্গে থেকে থেকে রোজগার করার পথও তাই খুঁজছিলেন।
শাহজাহান ঠিক করলেন, বের হয়ে শুরু করবেন ডাকাতি
দশমাস পর জেল থেকে বের হয়ে শুরু হলো আবার সেই ভবঘুরে জীবন। এদিকে জেলে থাকার কারণে এবং স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে না পারায় এক পর্যায়ে তাদের তালাকও হয়ে যায়। বাবা হাছান আলীও তাকে কোনো ভরণপোষণ দিতেন না। ফলে এক পর্যায়ে শুরু করলেন বাড়ির জিনিস বাজারে বিক্রি করে টাকা কামানো।
হালাল উপায়ে কাজ করতে গেলেও তার পোষাতো না। একে তো টাকা কম, তার ওপর সারাদিনের কাজ শেষে হাতে আর সময় পেতেন না আড্ডা, ঘোরাফেরার জন্য। তাই সহজে টাকা উপার্জন করা যায় এই উপায়ের দিকেই ঝুঁকছিলেন শাহজাহান। কারাগারে থাকাকালীনই যেহেতু ডাকাতদলের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন, তাই সে পথেই পা বাড়ালেন। শুরু হলো ডাকাতির জীবন। আবারও একটি ভুল পথ।
তবে নিজের লেখা স্বীকারোক্তিতেই তিনি জানিয়েছেন, ডাকাতি করতে গিয়ে তার প্রথমবার ভয় লেগেছিল বৈকি। তবে খারাপ পথ বলে মনে হয়নি তার কাছে। ডাকাতি করলেও তিনি চেয়েছিলেন কাউকে প্রাণে বধ না করতে। এদিকে এ পথে উত্তরোত্তর তার উপার্জন বাড়ছিল। প্রথম ডাকাতিতে ছয়শ, দ্বিতীয়টিতে নয়শ, তৃতীয়টিতে ষোলশ; এভাবেই হাতে টাকা আসছিল। বাড়ি বাড়ি ডাকাতের পর একপর্যায়ে আরও লাভের আশায় শুরু করেন বিভিন্ন মহাসড়কে বাস থামিয়ে ডাকাতি করা। প্রথম তিনবছরে প্রায় সাড়ে চারশো ডাকাতি করেছেন শাহজাহান।
'ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী বাসগুলোতে টিকিট কেটে প্যাসেঞ্জার হিসেবে উঠে পড়তাম। কুমিল্লায় চান্দিনায় এক দেড় মাইলের একট নির্জন রাস্তা ছিল, যেখানে কোনো জনবস্তি নেই। সে এলাকায় পৌঁছেই আমরা গাড়ি কন্ট্রোলে নিয়ে নিতাম। ড্রাইভারের মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে গাড়ি আস্তে চালানোর নির্দেশ দিতাম। আর ইন্ডিকেটরে এমনভাবে সিগন্যাল দিতে বলতাম যেন, পেছন থেকে আসা গাড়িগুলো মনে করে এই বাস নষ্ট হয়ে গেছে এবং পাশ কাটিয়ে চলে যায়। জিনিসপত্র নেওয়া হয়ে গেলে গাড়ি থামিয়ে সবাই নেমে পড়তাম। আর বলতাম, একটানে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে' — এভাবেই ডাকাতির স্মৃতিচারণ করেছেন শাহজাহান।
এরপর একবার ধরা পড়ে জেল খেটেছেন। কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে আবার সে পথেই ছুটেছেন। ডাকাতি করতে গিয়ে একবারের এক খুনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, 'ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে সোজা সেই পুলিশফাঁড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকলো। গাড়ির গতি দেখে হাশেমের মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে হাতে থাকা ছুরি ড্রাইভারের পিঠে ঢুকিয়ে দিল। ধারালো ছুরি পিঠ ভেদ করে ফুসফুস কেটে সামনে দিয়ে বের হয়ে গেল। মারা যাবার আগে, ড্রাইভার কোনোভাবে পুলিশফাঁড়ির কাছে গাড়ি থামালো।'
জল্লাদের জীবন তাকে আকৃষ্ট করেছিল
প্রথমবার কারগারে যাবার আগে শাহজাহান জানতেন না জল্লাদ কাকে বলে। কিন্তু প্রথমবার গিয়ে যখন দেখেন, জল্লাদদের কারাগারের জীবন অন্যদের চেয়ে আলাদা এবং বিলাসিতার। তখন সে জীবনের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তার।
ডাকাতির পর তিনি যখন ধরা পড়েন, একপর্যায়ে ৩৬টা মামলায় দায়ে একশত চুরাশি বছর সাজা হলো তার। কিন্তু জেলজীবনেও শাহজাহান তার সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। কখনো দাবি আদায়ে অন্য কয়েদীদের নিয়ে কঠোর অনশন, কখনো নিপুণতা ও দক্ষতার সাথে সর্দারের দায়িত্ব পালন, আবার সহকারী জল্লাদ থেকে আস্তে আস্তে কুখ্যাত খুনি ফিরোজ পাগলার ফাঁসির মাধ্যমে প্রধান জল্লাদ হয়ে ওঠা।
বইটিতে কেবল শাহজাহানের জীবন নয়, সাথে কারাগারের জীবন, সে জীবনে কয়েদীদের বিভিন্ন গল্প, ঘটনা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে ফাঁসির মঞ্চে লাল রুমালের গল্প, যমটুপির গল্প, আসামির ভর-উচ্চতার সাথে মিল রেখে পুতুল বানানোর গল্পসহ একটি ফাঁসির রায় আসার পর সপ্তাহ ধরে সে মঞ্চ প্রস্তুতির রক্তহিম করা নানা ঘটনা। কারাগারের এই অন্ধকার কুঠুরির জীবন, ভুলপথে পা বাড়ানোর অভিশাপ, ফাঁসির মঞ্চে ঝড়ে যাওয়া কুখ্যাত খুনিদের প্রাণ; এসব সত্য ঘটনাগুলো পড়ার সময় পাঠক আগ্রহ আর ভীতি দুটোই অনুভব করবেন।
'শাহজাহান, কতক্ষণ লাগবে? তাড়াতাড়ি শেষ করে দিও'
আছে ফিরোজ পাগলাসহ, এরশাদ শিকদার, বাংলা ভাই, যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগমুহূর্ত এবং পরমুহূর্তের না জানা অনেক ঘটনার উল্লেখ। যেমন তিনি লিখেছেন, যমটুপি পরানোর আগে ফিরোজ পাগলা বলেছিলেন, 'ও স্যার, আমারে ছাইরা দেন, আর জীবনে অন্যায় করব না।'
আবার যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম ফাঁসির আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'শাহজাহান, কতক্ষণ লাগবে? তাড়াতাড়ি শেষ করে দিও।'
মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখা এবং নিজ হাতে মৃত্যু কার্যকর করার পর শাহজাহানেরও মন ভারী হয়ে উঠত। সে জন্য ভালো খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকত সেদিন। এছাড়া দুদিন বিশ্রামও নিতেন তিনি একটি ফাঁসি কার্যকর করার পর।
জল্লাদ হিসেবে শাহজাহান ফাঁসি দিয়েছেন মোট ৬০টি। কিন্তু সাজা মওকুফে জটিলতা তৈরি হওয়ায় কাগজ কলমের হিসেবে তার নামে মোট ২৬টি ফাঁসি দেখানো হয়েছে। এ সংখ্যা বাংলাদেশের একজন জল্লাদের জন্য সর্বোচ্চ সংখ্যক ফাঁসি। এই দীর্ঘ এবং সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা থেকে শাহজাহান লিখেছেন: একটা মানুষ যখন জানতে পারে যে মারা যাবে, তখন আর সে উচ্ছৃঙ্খল থাকেনা।
নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চান
এখন যখন পেছন ফিরে তাকান, শুধু নিজের ফেলে আসা অন্যায়, ভুল সিদ্ধান্তগুলোই দেখতে পান শাহজাহান। আফসোস আর অনুশোচনা ছাড়া আর কিছুই করার নেই এখন তার। 'যদি বাবা মায়ের কথা মেনে চলতাম, যদি সেনাবাহিনীর চাকরিটা ছেড়ে না আসতাম। যদি আরেকটু সহ্য করে থাকতাম, যদি বাবা মায়ের সাথে বেয়াদবি না করতাম তবে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। হয়তো আমারও একটা পরিবার হতো, একটা সুখের জীবন হতো': তিনি লিখেছেন শেষ পাতায়।
শেষ অধ্যায়টিতে জল্লাদ তার ব্যক্তিগত জীবনের করে আসা সব ভুল, ভুল পথে পা বাড়ানো, ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় নিয়ে তার অনুশোচনা ও আফসোসের কথাগুলো তুলে ধরে তরুণ সমাজকে বোঝাতে চেয়েছেন, জীবন কত মূল্যবান। তরুণদের উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছেন: 'আমার জীবনের উদাহরণ টেনে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি কোনটা আসলে ভুল পথ, কোনটা আসলে সঠিক পথ।'
আর বাবা-মায়েদের উদ্দেশেও শাহজাহান বলেছেন: 'সন্তানদের বোঝার চেষ্টা করুন, শাসনের অভাব যেমন সন্তানকে বিপদে নিয়ে যেতে পারে, তেমনি অতিরিক্ত শাসনও সন্তানের মনে ক্রোধের আগুন তৈরি করতে পারে।'
বইটি হয়তো শাহজাহান ভূঁইয়ার সরাসরি লেখা নয়। কেউ হয়তো অনুলিখন করেছেন। যদিও এ ব্যাপারে বইটিতে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তবে যদি কেউ লেখকের নাম দেখে মনে করেন, বইটির আসলে কোনো সাহিত্যগুণ নেই, তাহলে ভুল হবে। এই বইয়ে সাহিত্যগুণ আছে কি না সেটি বিবেচ্য নয়। বরং ভেতরের কথাগুলো থেকে কতটা জানা গেছে সেটিই বিবেচ্য। এ বইটি যেমন একটি আত্মজীবনী হিসেবে একজন পাঠক পড়তে পারবেন, তেমনি জানতে পারবেন কারাগার জীবনের, বিশেষ করে জল্লাদ জীবনের নানা অজানা তথ্য। বইটি অন্তত পাঠকের মনে জীবনের ভালোমন্দ সম্পর্কে আরেকটু ভাবনার খোরাক জোগাবে।