ঠোঙার দুঃখ পলিথিন, সুখে নেই কাগজীপাড়া
পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ হয়েছে ২২ বছর হয়। কাগজীদের দুঃখের বয়স এর চেয়ে অল্প কিছুকাল বেশি। অথচ ঘটনা উল্টো ঘটার কথা ছিল। পলিথিন নিষিদ্ধ মানে কাগজের ঠোঙার বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু তা যে হলো না। আইন পড়ে থাকল কাগজে, পলিথিন সয়লাব বাজারে। ফলে কাগজের ঠোঙার ব্যবহার কমতে থাকল দিন দিন। কাগজীপাড়ার কাগজীরা পড়ল অথৈ জলে, ভেবে পেল না কূল। মুদি দোকান, মাছ বাজার, সবজি বাজার সবখানেই পলিথিন। অথচ ঠোঙা পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে কম; তবু পলিথিনেই আগ্রহ ক্রেতা-বিক্রেতা সবার।
কারণ কী? দক্ষিণ কাগজীপাড়ার ঠোঙা ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম কাজী তিনটি কারণ চিহ্নিত করলেন। এক. আগের দিনে মানুষ চটের ব্যাগ বা ডুলা হাতে করে বাজারে যেত, দোকানি তিন-চার-পাঁচ পদের সদাই আলাদা আলাদা ঠোঙায় পুরে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিত, এখন আর কেউ ডুলা বা ব্যাগ হাতে নেয় না। দুই. আগের মতো কাগজ আর সহজলভ্য নেই, ঠোঙা মেশিনে তৈরি হয় না, ঠোঙার দাম পড়ে পলিথিনের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি। তিন. ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে খুব ব্যস্ত, ঠোঙায় সদাই ভরতে সময় কিছু বেশি লাগে যা কারুরই নেই।
আধুনিকতা ও ঠোঙার ঠ্যাঙাঠেঙি
নজরুল কাজীর সঙ্গে আলাপ করে বোঝা গেল, ঠোঙা একটি লাইফস্টাইল বা জীবনধারা, যার সঙ্গে পাটের তৈরি সুতলি, হাতে তৈরি পণ্যসামগ্রী, আয়োজন করে বাজারে যাওয়া, হাটবার মনে রাখা, খাবার তাজা খাওয়ার অভ্যাস ইত্যাদি জড়িত। আধুনিক সময়ের সঙ্গে ঠোঙার তাই বনিবনা কম।
বিশ-বাইশ বছর আগেও নজরুল কাজী ঢাকার মালিবাগ, যাত্রাবাড়ি, দোলাইরপাড়, নন্দীরবাজার, রায়সাহেব বাজার, শান্তিনগর, মগবাজারে ঠোঙা সরবরাহ করতেন। এখন করছেন মাত্র তিনটি বাজারে—মৌলভীবাজার, কাপ্তানবাজার ও কারওয়ানবাজারে।
মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভার একটি গ্রাম কাগজীপাড়া। কাগজে-কলমে অবশ্য গ্রামটির নাম দক্ষিণ নগর কসবা। পুরো গ্রামজুড়ে ঠোঙা বানানোর কাজ হতো বলে লোকমুখে কাগজীপাড়া নাম হয়ে যায়। আজ নামটি আছে, কাজ নেই।
মায়ের কাছে রাসেল মিয়া শুনেছেন, নানার বাবাও ঠোঙা ব্যবসায়ী ছিলেন। এভাবে হিসাব মেলালে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ নগর কসবায় কাগজের কাজ চলছে। রাসেলই হবেন হয়তো কাগজীপাড়ার ঠোঙা ব্যবসায়ীদের শেষ প্রজন্ম।
রাসেলের ওস্তাদ তার মা রাহেলা বেগম। কাগজীপাড়া তার নানাবাড়ির এলাকা। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পর থেকে রাহেলা বেগম পিতার ব্যবসার হাল ধরেন। নিজে ভালো কারিগর ছিলেন, আরো ২০-২২ জন কারিগর তার সঙ্গে কাজ করত। ভৈরব ও নরসিংদীতে মণকে মণ ঠোঙা পাঠাতেন। প্রস্তুতকৃত ঠোঙা বাজারে নিয়ে যাওয়া এবং ঢাকার বেচারাম দেউড়ি থেকে কাঁচামাল কিনে আনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্বামীকে। সে সময় কমলাঘাট থেকে মালবাহী জাহাজ ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা হয়ে ভৈরব পৌঁছাত। এখন ধলেশ্বরী শীর্ণা, কমলাঘাটের আড়তগুলো তালাবদ্ধ থাকে।
সিমেন্টের বস্তা ছিল বড় উৎস
রাসেলের বয়স এখন উনচল্লিশ। এগারো বছর বয়সে কাজে লেগেছিলেন। তখনো বাজারে পলিথিন আসেনি, এলেও মহামারি রূপ ধারণ করেনি। আট বছর রাসেল ভালোই রোজগার করেছেন। রাহেলা বেগমের সময়ে সিমেন্টের বস্তা আসত বিদেশ থেকে। ছয় স্তরে ছয়টি কাগজ জুড়ে দিয়ে তৈরি হতো বস্তাগুলো। আকারেও বড় ছিল সেগুলো।
সিমেন্ট ঢেলে দেওয়ার পর বেঁচে যাওয়া বস্তাগুলো মৌলভীবাজার, বেচারাম দেউড়ির পাইকাররা সংগ্রহ করতেন। তাদের থেকে পিস হিসেবে কিনে আনতেন রাহেলা বেগম ও অন্য কাগজীরা। তারপর প্রতিটি ভাঁজ আলাদা করা হতো, মাপেমাপে কাটা হতো, কারিগরদের হাতে তুলে দিলে তারা নির্দিষ্ট ওজনের ঠোঙা তৈরি করে দিতেন। এখনো সেই একই প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে তৈরি হয় ঠোঙা। সিমেন্টের বস্তা তৈরি হতো যে কাগজ দিয়ে, সেগুলোকে খাকি কাগজ বলা হয়।
নজরুল কাজী বলছিলেন, 'এখন আর সিমেন্টের বস্তা কাগজে তৈরি হয় না, এখন আমরা খাকি কাগজ বেশি পাই গুঁড়া দুধের প্যাকেট থেকে। ২৫ কেজির প্যাকেট হয়। দুই বা তিন স্তরের কাগজ দিয়ে তৈরি এসব প্যাকেট। পিস হিসেবে বিক্রি হয়, প্রতি পিস ১৮-২০ টাকা দাম। এক কেজিতে ৫-৬টি ওঠে। এক কেজি কাগজ থেকে প্রাপ্ত এক কেজি ঠোঙা আমরা বিক্রি করি ১৩৫ বা ১৪০ টাকা। আকারভেদে ঠোঙাগুলো ২ থেকে ২০ কেজি ওজন ধরতে পারে।'
তুঁতের স্বাদ তেতো বলে
কাগজের ঠোঙা তৈরিতে বেশি দক্ষ নারীরা। একসময় কাগজীপাড়ার হাজারের বেশি নারী এ পেশায় যুক্ত ছিলেন। পাড়ার ৬০০ পরিবারের সাড়ে পাঁচশই এ কাজে যুক্ত ছিল। এখন আছে ৩০-৩৫টি পরিবার।
ঠোঙার আঠা তৈরি হয় ময়দা, পানি ও তুঁতে দিয়ে। তুঁতের স্বাদ তেতো হওয়ায় ইঁদুর ও তেলাপোকার আক্রমণ থেকে বাঁচানো যায় ঠোঙা। আঠা দেওয়ার পর তা রোদে শুকাতে হয়। আঠা লাগানোর অল্প সময়ের মধ্যেই না শুকাতে দিলে শ্যাওলা পড়ে যায়। বর্ষাকালে শুকাতে দেওয়া হাঙ্গামার কাজ, সারাক্ষণ আকাশের দিকে নজর রেখে চলতে হয়।
নজরুল কাজী বললেন, যতটা পরিশ্রম করি তার সমান উপার্জন নেই আমাদের। ১ কেজি ঠোঙায় ৪০ টাকার কম লাভ হলে সংসার চালানো দায় হয়।
রাসেল মিয়াও বললেন, 'এখন কোনোরকমে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকছি। ঠোঙার বাজার খুব স্লো বা মন্থর। দিনে দিনে আরো স্লো হয়ে যাচ্ছে। সন্তানদের কাউকে এ পেশায় আনার কথা ভাবতে পারি না। হাটবারে ভৈরব বাজারে দুই রাত থাকতেন বাবা। খোলা জায়গায় ঠোঙা স্তূপ করে বসতেন। ক্রেতার অভাব হতো না, বাড়ি ফিরতেন কোঁচড় ভর্তি টাকা নিয়ে। তখন পয়সারও দাম ছিল আর জিনিসপত্রও ছিল সস্তা। আমরা ভালোই ছিলাম।'
ঠোঙার ভরা (পিক) মৌসুম মার্চ থেকে জুন চার মাস। এ সময় মাসে ৬০ মণ ঠোঙা প্রস্তুত করেন নজরুল কাজী, যার অর্থমূল্য সাড়ে তিন লক্ষ টাকা।
তিনি হিসাবটা আরো খোলাসা করলেন। ৬০ কেজি কাগজ থেকে ৭০ কেজি (আঠা যুক্ত হয়ে) ঠোঙা প্রস্তুত হয়। ৬০ কেজি কাগজের দাম ৬ হাজার টাকা; কারিগর, যাতায়াত ও আনুষঙ্গিক আরও ১ হাজার ৫০০ টাকা যুক্ত হয়ে মোট খরচ দাঁড়ায় সাড়ে ৭ হাজার টাকা। ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা গেলে ৭০ কেজিতে পাওয়া যায় ৯ হাজার ৮০০ টাকা, লাভ হয় ২৩০০ টাকা। সেই হিসাবে ভরা মৌসুমের চার মাসে লাভ হয় প্রায় চার লক্ষ টাকা, যা দিয়ে চলতে হয় ১২ মাস। অন্য (অফ পিক) মাসগুলোতে আয়-ব্যয় সমান হয় বা ব্যয় কিছু বেশি হয়।
সাদা কাগজের ঠোঙা
কাগজীপাড়া থেকে ১০ মিনিট দূরত্বের মস্তানবাজারে বেশি তৈরি হয় সাদা কাগজের ঠোঙা । সাদা ঠোঙার কাগজের উৎস স্কুল-কলেজের পরীক্ষার খাতা বা অফিস-আদালতে ব্যবহৃত কাগজ। ঢাকার নিমতলী থেকে কেজি দরে তা কিনে আনেন মস্তানবাজারের কাগজীরা।
আকারভেদে এ ঠোঙা ২৫০ গ্রাম থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত ওজন ধরতে পারে। এগুলো বিক্রি হয় আশি টাকা কেজি দরে। পুরি-শিঙাড়ার হোটেল, ফলের দোকান, ডাল, চিনি, খুদের মুদি দোকানে সাদা ঠোঙা বেশি চলে। মস্তানবাজারে ৮টি সাদা ঠোঙার পাইকারি দোকান আছে। ছোট ঠোঙা বান্ডিল (৫০০ বা ১০০০ পিস) ধরে বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২৩০ টাকা দরে।
বাদাম, ঝালমুড়ি বিক্রির ভ্যানগুলোতে কাগজের ঠোঙার চল সবচেয়ে বেশি। ফার্মেসিতেও কাগজের ঠোঙার ব্যবহার বলতে গেলে ১০০ ভাগ। ফার্মেসির ঠোঙা অবশ্য একটু স্পেশাল। মিরকাদিম বাজারের ওষুধের দোকানিরা তাদের প্রয়োজনীয় ঠোঙা মিটফোর্ড থেকেই কিনে আনেন।
সারাদেশে আরো নানান জায়গায় ঠোঙা তৈরি হয়; যেমন যশোর, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে। তবে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বাজারগুলোর ঠোঙার চাহিদা কাগজীপাড়াই মেটায়। ঢাকার মৌলভীবাজারে মশলার দোকানগুলোতে খাকি ঠোঙা চলে শতভাগ, কাপ্তানবাজারের দোকানি ও ক্রেতা উভয়েরই ঠোঙার প্রতি টান আছে, নারায়ণগঞ্জের দিগবাবু বাজার ও নিতাইগঞ্জেও ঠোঙার ভালো চাহিদা।
'পলিথিন হিংসাও ছড়ায়'
নজরুল কাজী বললেন, 'পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের কথা ভেবে যদি ক্রেতাসাধারণ ঠোঙার চাহিদা বাড়ান, তবে আমাদের বিশেষ উপকার হয়। পলিথিনে গরম ভাজা-পোড়া নিলে অল্পক্ষণে ঘেমে যায়, অন্য কোনো খাবারই পলিথিনে বহন করা ঠিক না, একটু একটু করে শরীরে বিষ ঢুকে যায়। পলিথিনের তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধা আছে, তবে ক্ষতি বিরাট।'
রাসেল মিয়া একটু বেশি আক্রমণাত্মক, তিনি বলছিলেন, 'পলিথিন মানে ক্যান্সার। খাল-নালা সব ভরে যাচ্ছে পলিথিনের কারণে, পানি চলাচল করতে পারছে না। বৃষ্টি হলে ঢাকার রাস্তায় হাঁটু পানি, পলিথিনে জমে পানি সরে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়, এখন গ্রামেও একই অবস্থা। ঠোঙা দুই-দশদিনের মধ্যে মাটিতে মিশে যায়, কিন্তু পলিথিন বছরের পর বছর জায়গা দখল করে রাখে। ফসলি জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে এই পলিথিনের কারণে, অথচ আমাদের হুঁশ নেই। নতুন প্রজন্মের কথা আমাদের ভাবা উচিত, আমাদের সন্তানদের পলিথিনের পৃথিবী উপহার দিয়ে যাচ্ছি, এর ক্ষতি মারাত্মক।'
কাগজের ঠোঙার কিছু অসুবিধার কথাও স্বীকার করলেন নজরুল কাজী। যেমন এর দাম বেশি, অসতর্কতায় পথেই ছিঁড়ে যেতে পারে। হার্ডবোর্ড দিয়ে যে ঠোঙার তলা তৈরি হয়, তা দিয়ে ৫০-৭০ গ্রাম ওজন ফাঁকি দিতে পারে দোকানি, ক্রেতা এই ক্ষতি মানবে কেন?
তবু তিনি বলেন, 'পলিথিনের যে সুদূরপ্রসারী ক্ষতি, তার তুলনায় ওই অসুবিধাগুলো সামান্য। সচেতন হলেই অসুবিধাগুলো এড়ানো যায়। পলিথিন নিষিদ্ধ আইন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োগ নেই কোনো। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে লোকে পলিথিন তৈরির কারখানা দিচ্ছে, দুঃখের কথা আর কত বলব! তার ওপর কাগজেরও ঘাটতি আছে। সবমিলিয়েই আমরা কাগজীরা বিপদগ্রস্ত।'
রাসেলের মা রাহেলা বেগমের বয়স সত্তরের বেশি। অভিজ্ঞতায় জীবন তার পূর্ণ। একটা বিশেষ দিকে দৃষ্টি ফেরালেন, 'দ্যাখেন, পলিথিন সমাজে হিংসা ছড়াচ্ছে। কীভাবে? পলিথিনে আপনি আপেল নিয়ে যাচ্ছেন, দেখা যায় পরিষ্কার, যার কেনার সামর্থ্য নেই সে ছেলের দিকে তাকাতে পারে না, কষ্টে ভিতরে ভিতরে পুড়ে যায়। অন্যদিকে ঠোঙায় আপনি যা-ই পরিবহন করেন, দেখার কোনো সুযোগ নেই, অন্যকে কষ্টও দিতে হয় না। বিষয়টাকে কিন্তু ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।'