‘প্রতিবন্ধীদের ফেরিওয়ালা’ আরিফুজ্জামান
এলাকায় এলাকায় গিয়ে তিনি খুঁজে বের করেন প্রতিবন্ধী শিশুদের। ভর্তি করিয়ে দেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। খরচের ভার বহনের দায়িত্ব তুলে নেন নিজ কাঁধে। চলাচলের সহায়তার জন্য বিতরণ করেন হুইল চেয়ার। ঈদ ও পূজায় বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেন নতুন জামাকাপড়। বছর শেষে সবাইকে নিয়ে আয়োজন করেন মিলনমেলার। প্রতিবন্ধীদের প্রতিযোগী বানিয়ে অংশগ্রহণ করান ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আরিফুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির এসব কর্মকাণ্ডের ফলে আলো ফুটেছে শত শত প্রতিবন্ধীর জীবনে।
তার বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়নে। পুরো নাম কাগজী মো. আরিফুজ্জামান ওরফে তুহিন কাগজী। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও তিনি। তবে জনসেবার চেয়েও তার নাম বেশি ছড়িয়েছে প্রতিবন্ধী সেবায়। তাই স্থানীয়রা তার নাম দিয়েছেন 'প্রতিবন্ধীদের ফেরিওয়ালা'। তিনি নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছে 'কাগজী প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্ট', যার স্লোগন 'প্রতিবন্ধীরা প্রতিভাবন্দী নয়, ওরাও মানুষ'।
তিনি বলেন, 'জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাকে নানারকমের সামাজিক কাজে আমাকে অংশ নিতে হয়। তবে আমার মূল লক্ষ্য হলো প্রতিবন্ধীর সহায়তায় করা। যেদিন কোনো প্রতিবন্ধীর সেবা করতে পারি না, সেদিন রাতে ভালো ঘুম হয় না। এটা আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
প্রতিবন্ধীরা নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হন, সেই যাতনা হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন আরিফুজ্জামান। তাই বেছে নিয়েছেন এই মহতী উদ্যোগ।
তিনি জানান, ছোটবেলায় একদিন ফুটবল খেলতে গিয়ে তার একটি হাত ভেঙে গিয়েছিল। টানা দুই মাস তাকে ভাঙা হাত নিয়ে ঘরে কোনো বসে দিন কাটাতে হয়েছিল। ওই সময়ে এক নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে বড় পরিসরে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে হাত ভাঙা থাকায় পরিবার থেকে তাকে সেই অনুষ্ঠানে নেওয়া হয়নি। সেই প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে বাল্যকাল থেকেই তিনি প্রতিবন্ধীদের সেবায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এই সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে প্রতিনিয়ন ভর্ৎসনার শিকার হতে হয়েছে আরিফুজ্জামানকে। তার বড় ভাই অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সপরিবারে থাকেন জার্মানিতে। ছোট বোন থাকেন ঢাকায়। আর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা থাকেন খুলনা শহরে। পারিবারিক স্বজনরা চাননি তিনি এভাবে জীবন কাটিয়ে দেন।
আরিফুজ্জামান বলেন, 'পরিবার থেকে চেয়েছিল আমিও বড় ভাইয়ের মতো প্রবাস জীবন কাটাই বা বোনের মত ঢাকা শহরে গিয়ে ব্যবসা শুরু করি। তবে আমাকে অজপাড়াগাঁ থেকে কেউ সরাতে পারেনি। এখানে থেকে আমি শত শত অসহায়কে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে শেখাচ্ছি। আত্নীয়-স্বজনরা এসব কর্মকাণ্ডের জন্য আমাকে নিয়ে পাগল বলে সম্বোধনও করেছেন। তবে আমাকে এই সেবা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।'
খুঁজে খুঁজে প্রতিবন্ধী শিশু বের করে তাদের তালিকা তৈরি করেন তিনি। পরে শুরু করেন নানা সেবা ও সহায়তা। ২০০৫ সাল থেকে এভাবে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে ২৫০ প্রতিবন্ধীকে সহায়তা করে আসছেন। ওইসব অর্থও তিনি খরচ করেন নিজের মাছের ঘের ব্যবসার আয় থেকে।
তাসলিমা খাতুন নামের এক শিশুকে ২০০৫ সালে প্রথম সহায়তার মাধ্যমে তার সেবার সূচনা। প্রতিবন্ধী ওই শিশুর স্বপ্ন ছিল অন্যান্যদের মতো বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করবে। তবে তার বাড়ি থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব ছিল প্রায় দেড় কিলোমিটার। জন্ম থেকেই দুই পা পঙ্গু থাকায় সে একাকী বিদ্যালয়ে যেতে পারত না। তাই কোলে করে প্রতিদিন মেয়েকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন ও নিয়ে আসতেন তার মা। কয়রা উপজেলার কয়রার বাগালী গ্রামের মা ও মেয়ের এই সংগ্রাম নজরে এসেছিল আরিফুজ্জামানের। তখনই তার মনে পড়েছিল ছোট লার স্মৃতি। তাই সেই সময় তিনি একটি হুইল চেয়ার কিনে দিয়ে আসেন তাসলিমা খাতুনকে। পরে জানতে পারেন প্রতিবন্ধী শিশুটির পিছনে পরিবার লেখাপড়ার জন্য অর্থ খরচে আগ্রহী না। তখন শিক্ষার ভার বহনের দায়িত্বও নিজ কাঁধে তুলে নেন। সেই ছোট শিশু তাসলিমা খাতুন এখন পূর্ণবয়স্ক তরুণী। পাইকগাছা সরকারি কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে লেখাপড়া করছেন। এখনও তাকে সহায়তা করছেন আরিফুজ্জামান।
তাসলিমা খাতুন বলেন, 'ছোটবেলা মায়ের কাছে যখন আমি বিদ্যালয়ে যাওয়ার বায়না করতাম, তখন প্রতিবেশীরা আমাকে বিদ্যালয়ে না দেওয়ার পরামর্শ দিতেন। আরিফুজ্জামান কাকুর সাথে পরিচিত হওয়ার পর তিনি আমার পরিবারকে আমার শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেন। আমার আত্মপ্রচেষ্টায় আমি অনেক শ্রেণিতে প্রথম হতাম। তখন কাকু আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে আদর করতেন। তাই দেখে আমার মা আনন্দে কান্না শুরু করতেন।'
তাসলিমা খাতুনের জন্ম হতদরিদ্র দিনমজুর বাবার ঘরে। তার বাবা এখন অসুস্থ থাকায় কোনো কাজ করতে পারেন না। তার দুই ভাইও দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালান। সেই পরিবার থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করতে পেরেছেন তাসলিমা । এখন স্বপ্ন দেখেন স্নাতক শেষে একদিন চাকুরি করবেন। আর আরিফুজ্জামানের মতো শত শত প্রতিবন্ধীর পাশে সহায়তার হাত বাড়াবেন।
শুধু তাসলিমা খাতুনই নয়, বছরের পর বছর ধরে তার মতো আরও ১৫ জনের শিক্ষার ভার বহন করে আসছেন তিনি। হতদরিদ্র ১০ প্রতিবন্ধীর পরিবারকে নিজ খরচে ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। ২৫০ জন প্রতিবন্ধীর মাঝে হুইলচেয়ার বিতরণ করেছেন। গত ৭ বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের মিলনমেলার আয়োজন করে আসছেন। ওইদিন অচল এসব মানুষদের মুখে হাসি ফোটাতে আয়োজন করেন ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। ব্যবস্থা রাখেন উন্নত খাবার ও দামি পোশাকের।
প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেই তিনি অবদান রাখছেন। খুলনা বিএল কলেজ থেকে ইসলামী ইতিহাসে স্নাতকোত্তর শেষ করে বেকার ছিলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের খায়রুল ইসলাম। প্রতিবন্ধী এই যুবককে একটি কম্পিউটারের দোকান করে দিয়েছেন আরিফুজ্জামান। সেখানে থেকে আয় করে পরিবারের ভরণপোষণ করছেন খায়রুল।
অসহায়দের পাশে থেকে আনন্দ পান তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে আরিফুজ্জামান বলেন, 'সাধারণত কোনো প্রতিবন্ধী শিশুকে কেউ কোলে নিতে চায় না। আর আমি যখন বাড়ি বাড়িতে গিয়ে তাদের কোলে তুলে আদর করি, নতুন জামা কাপড় পরিয়ে দিয়ে আসি, তাদের মায়েরা খুশিতে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেন না। মায়েদের মনে হাসি ফোটাতে পেরে, আমি আনন্দ খুঁজে পাই।'
আরিফুজ্জামানের এসব কার্মকাণ্ড নিয়ে গর্বিত ওই এলাকার মানুষেরাও। দুই পা পঙ্গু থাকা স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুভাষ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, 'কোবী প্রতিবন্ধী শিশু যদি শিক্ষা না নিতে চায় তখন আরিফুজ্জামানের আমাকে দেখিয়ে তাদের শিক্ষায় উৎসাহিত করেন। আমাকে দেখে অন্য প্রতিবন্ধীরা যাতে শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের স্বাবলম্বী করতে পারে, সেজন্য প্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করেন।'
পাইকগাছা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে ৭ বছর দায়িত্ব পালন করা সরদার আলী আহসান বলেন, 'কোথাও কোনো প্রতিবন্ধী কষ্ট পাচ্ছেন, তা শুনলেই সেখানে দৌড়ে যান আরিফুজ্জামান। প্রতিবন্ধী শিশুদের লেখাপড়ায় তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। তার এই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরা আলোর পথে ফিরতে পারছেন।'