রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি দিতে বাড়তি দুই বছর সময় চায় বাংলাদেশ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। সরকার এই ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই বছর বাড়তি সময় দেওয়ার অনুরোধ করেছে।
দেশের সর্ববৃহৎ এই বিদেশি ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ করার কথা ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ। এখন সরকার চাচ্ছে ২০২৯ সালের ১৫ মার্চ প্রথম কিস্তি দিতে।
গত ২৭ মার্চ আন্তঃমন্ত্রণালয় এক বৈঠকের পরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এই ঋণের মেয়াদ ও প্রথম কিস্তি পরিশোধে দুই বছর বাড়তি সময় চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে— বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের একটি যৌথ সমন্বয়ক কমিটি রয়েছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এই কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে এই প্রকল্পের মূল ঠিকাদার রোসাটমের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে এবিষয়ে রাশিয়ার অর্থমন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়ার পরামর্শ দেন।
বাড়তি সময় কেন চাইছে বাংলাদেশ
ইআরডি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই অনুরোধের পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করেন। এরমধ্যে রয়েছে করোনা মহামারির প্রভাব, চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি, যন্ত্রপাতি ও মালামাল পরিবহনে রুশ সংস্থাগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের মন্থর গতির মতো বিষয়গুলো।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, বিভিন্ন কারণেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম বেশ বাধাগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে করোনা মহামারি অন্যতম। ওই সময় টানা দুই মাস কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে। এরপর এসেছে রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রধান প্রধান সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বাংলাদেশ আর রাশিয়ার সরাসরি লেনদেন করতে পারছে না। ফলস্বরূপ; রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রধান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান রোসাটমের পাওনা সোনালী ব্যাংকে একটি এসক্রো অ্যাকাউন্ট খুলে জমা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বন্দর, জাহাজ ইত্যাদির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যে কারণে রাশিয়া থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজনীয় মালামাল, যন্ত্রপাতি আনাও জটিল হয়ে পড়েছে।
সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ধীরগতি
এদিকে রূপপুর থেকে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কার্যক্রমও ধীরগতিতে এগোচ্ছে। বিশেষত পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর দিয়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে পরিকল্পনার চেয়ে বেশি সময় লাগছে। অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও এখন চাপের মধ্যে রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর যে প্রয়োজন দেখা দিয়েছে– এটি তার অন্যতম প্রধান কারণ।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমতে শুরু করে। যুদ্ধের আগের সময়ের ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে যা বর্তমানে নেমে এসেছে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। যুদ্ধ শুরুর পরে বিশ্ববাজার থেকে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের মতো পণ্যদ্রব্য আমদানির ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যায়, যা রিজার্ভের পতনেও ভূমিকা রাখে। এছাড়া, ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রারও হয় ব্যাপক অবমূল্যায়ন। টাকার এই অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। আগে যেখানে এক ডলার ৮৬ টাকায় কেনা যেত, যুদ্ধের পরে একপর্যায়ে তা কিনতে হয়েছে ১২০ ডলারে।
ঋণচুক্তির শর্তাবলী
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১১ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে একটি আন্তঃসরকার ঋণচুক্তি (আইজিসিএ) সই হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রুশ ফেডারেশনের জেএসসি অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট এর মধ্যে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি 'জেনারেল কনট্র্যাক্ট' স্বাক্ষরিত হয়।
ইআরডিতে অনুষ্ঠিত সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, এই ঋণের ৯০ শতাংশ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ব্যয় হবে। এই নির্মাণ ব্যয়ের ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের জন্য ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও রুশ সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি চুক্তি হয়।
চুক্তির শর্ত হচ্ছে ঋণ ব্যবহারের মেয়াদ (ইউটিলাইজেশন পিরিয়ড) হলো ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭ বছর। আর ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হলো ৩০ বছর।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই ঋণের কিস্তি বছরে দুইবার দিতে হবে। একটি ১৫ মার্চ ও অপরটি ১৫ সেপ্টেম্বরে। প্রতিবছর ঋণের আসল বাবদ ৩৭৯ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে। প্রতি কিস্তিতে দিতে হবে ১৮৯ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণ পরিশোধের একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি জানতে চেয়েছে ইআরডি
২৭ মার্চ আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় গৃহীত মূল সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি ছিল– বিদ্যমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ান ফেডারেশনকে ঋণ পরিশোধের জন্য একটি বিকল্প, নিরাপদ ও সুরক্ষিত পেমেন্ট পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা।
সভার কার্যবিবরণী অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ পেমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েছে ইআরডি। বর্তমানে রাশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যবসার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ।
ওই সভায় উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন অতিরিক্ত পরিচালক জানিয়েছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তিন জনের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করেছে, এবং রাশিয়ান পেমেন্ট বিষয়ে আলোচনার জন্য চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন।
সফরের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পেমেন্ট মডালিটি তৈরির কাজ করছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার পাওনা চীনা মুদ্রায় চীনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করার পরিকল্পনা করছে বলেও জানান তিনি।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজের অগ্রগতি
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত কার্যক্রমের ৬৫ দশমিক ৫২ শতাংশ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে।
এজন্য ২০১৬ সালের জুলাই থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ৭১ হাজার ৮৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। যা প্রকল্পে বরাদ্দ করা ব্যয়ের ৬২ দশমিক ৮২ শতাংশ। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এরমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ২২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা দিচ্ছে এবং রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা।
২০২৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়া থেকে পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান আসে ঢাকায়। এরপর গত বছরের ৫ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে এই জ্বালানি হস্তান্তর করা হয়। যেখানে ভার্চুয়ালি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশ নেন।
ওই অনুষ্ঠানে পুতিন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায় চালু হবে ২০২৬ সালে।
রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরেনিয়াম বুঝে পাওয়ার মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পারমাণবিক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু, ২০২৬ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা যাবে কি-না তা নিয়েও এখন সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে প্রয়োজন বিশেষ সঞ্চালন লাইন। সেই সঞ্চালন নির্মাণ প্রকল্প আশানুরুপ গতিতে এগোচ্ছে না। সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলে– রূপপুরের দুটি ইউনিট থেকে ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।