পৃথিবীজুড়ে ডায়াবেটিক রোগীদের প্রাণহানি বাড়িয়েছে কোভিড-১৯
কোভিড-১৯ নতুন করোনাভাইরাস সৃষ্ট এমন এক ব্যাধি যা; হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির সমস্যা এবং ডায়াবেটিস বা বহুমূত্রের মতো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। সংক্রমণের পর রোগীর পুর্বাপর শারীরিক অবস্থা এবং বয়স অনুসারে, তা প্রাণ সংশয়ের মাত্রাও বাড়ায়।
চলতি মাসের মাঝামাঝি প্রকাশিত ফরাসি এক গবেষণা জানায়, করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রতি ১০ জন ডায়াবেটিক রোগীর মধ্যে একজন ৭ দিনের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারেন।
গবেষণাটি টাইপ-১ এবং টাইপ-২ নামের দুই ধরনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব নতুন আলোকে তুলে ধরে।
শারীরিক ওজন বেশি; এমন ডায়াবেটিস এবং কোভিড রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সাতদিনের মধ্যে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস সহায়তা নিতে বাধ্য হন। এমনকি মারাও যেতে পারেন এসময়ের মধ্যে। এদের ৮৯ শতাংশই ছিলেন টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
প্রায় ১৩শ' রোগীকে পর্যবেক্ষনের পর গবেষকরা দেখেন, সাতদিনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের ১৮ শতাংশ বাড়ি ফিরে যাওয়ার মতো সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের আরও দীর্ঘসময় ধরে এজন্য অসুস্থ থাকতে হয়।
বিশ্বমারির মাঝে জনস্বাস্থ্যে ডায়াবেটিসের প্রভাব নিরূপণে এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান।
এর ভিত্তিতে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ডায়াবেটিক রোগীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ কোষগুলো বেশ ধীর গতিতে উদ্দীপ্ত হয়। প্রতিরোধে অক্ষমতার একারণে সংক্রমণের জীবাণুরা শেষ লড়াইয়ে জয়ী হয়।
বিশ্বব্যাপী বিস্তারিত এক মহাব্যাধি:
অব্যাহত নগরায়ন, প্রক্রিয়াজাত খাবার, পানীয় এবং যাপিত-জীবনের নানা বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী ডায়েবেটিস রোগীর সংখ্যা চলমান মহামারির আগে থেকেই ব্যাপক আকার ধারণ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) প্রদত্ত তথ্যানুসারে, ১৯৮০ সালে পৃথিবীতে ডায়াবেটিক রোগী ছিলেন ১০ কোটি ৮০ লাখ। সে সংখ্যা ২০১৪ সালে এসে ৪২ কোটি ২০ লাখে উন্নীত হয়।
১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। যা ২০১৪ সালে উন্নীত হয় ৮ দশমিক ৫ শতাংশে। আর ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল নাগাদ ৫ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্কের মৃত্যুর জন্য দায়ি ছিল ডায়াবেটিস।
হু জানায়, উন্নত বিশ্বের চাইতে এখন নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ডায়েবেটিক রোগীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এ পরিসংখ্যান বাংলাদেশে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যখাতের প্রেক্ষাপটে ভীতিজনক এক পরিণতি ইঙ্গিত করে।
ডায়াবেটিসের মতো দূরারোগ্য ব্যাধি এপর্যন্ত কোভিড-১৯ প্রভাবিত শীর্ষ দেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। যার ভীতিকর প্রমাণ মিলেছে যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্রে দুই মহাব্যাধির তাণ্ডব:
করোনাভাইরাসে শনিবার (২৫ জুলাই) নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে মোট এক লাখ ৪৮ হাজার জন মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ৪১ লাখের বেশি।
ইতোপুর্বে দেশটির সরকারি এক গবেষণায় উঠে আসে, অব্যাহত সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মৃতদের ৪০ শতাংশই হলেন ডায়াবেটিস রোগী।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) গত মে'তে ১৫টি রাজ্যের ১০ হাজার করোনা রোগীর মৃত্যু গবেষণাটির আওতায় পর্যালোচনা করে। সেখানে আরও দেখা গেছে, ৬৫ বছরের নিচে যারা মারা গেছেন তাদের অর্ধেকের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি দূরারোগ্য ব্যাধিটি সক্রিয় ছিল।
গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী সিডিসি'র সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ জনাথন ওরথাম- ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্য এর ফলাফলকে ''চরম আতঙ্কের'' বলে অভিহিত করেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স পরিচালিত এক স্বতন্ত্র জরিপেও ডায়াবেটিক রোগীদের উচ্চ মৃত্যুহার উঠে আসে। রাজধানী ওয়াশিংটনসহ মোট ১২টি প্রদেশে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এতে অংশ নেওয়া ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা এবং মিশিগানের মতো ১০টি রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পেছনে ডায়াবেটিস বা অন্য দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগের বিষয়টি মৃত্যুসনদে উল্লেখ করেছেনা তারা। অন্য দুইটি অঙ্গরাজ্য এব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। তাদের এ অসহযোগিতা চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরার পথে বড় বাঁধা।
বিশেষ করে, মৃত্যুঝুঁকি বেশি এমন ব্যক্তিদের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে সার্বিক পরিস্থিতির একটি সুষ্ঠু চিত্র পেলে, তারা সে অনুসারে ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতি বাড়তি যত্নশীল হওয়ার সুযোগ পেতেন।
কোভিড-১৯ অবশ্য একটি উপেক্ষিত সত্যের উপরে নতুন করে আলো ফেলছে মাত্র। সেই ২০০৯ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ডায়াবেটিসে মৃত্যুহার শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছরই যা লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ছে। এর পেছনে আছে বর্ণবাদী আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট। বিশেষ করে, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায়- কৃষ্ণাঙ্গ এবং লাতিন আমেরিকান নৃগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই ডায়াবেটিসের হার অতিরিক্ত বেশি। আর কোভিড-১৯ এসব পিছিয়ে থাকা এসব গোষ্ঠীর মার্কিন নাগরিকদের জীবনই বেশি কেড়ে নিচ্ছে।
''ডায়াবেটিস আগে থেকেই এক ধীর গতির মহামারিতে রূপ নিয়েছিল। কোভিড-১৯ এর সঙ্গে মিলে এটি এখন শক্তিশালী জোয়ারে পরিণত হয়েছে'' বলছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুরারোগ্য ব্যাধি গবেষণা এবং নীতি পরামর্শ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক অ্যালবার্ট হুয়াং।
ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষা কবচ হলো, রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা। কোভিড-১৯ মহামারি বিদ্যমান চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটিয়ে, মানুষকে বাড়ির ভেতরে অবস্থান করতে বাধ্য করে; সেই রুটিনেরও ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। আবার স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্যভ্যাসও এর ফলে অনেক দরিদ্র মানুষ মেনে চলতে পারছেন না।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও অন্যতম কারণ। ডায়াবেটিসের প্রধান ওষুধ ইনসুলিনের উচ্চদাম, মহামারির মাঝেও দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেক নাগরিককে কাজ করতে বাধ্য করে। কর্মক্ষেত্রে, এভাবে বিপুল সংখ্যক মার্কিনী করোনা সংক্রমিত হন। আবার ভাইরাস সৃষ্ট মন্দায় চাকরি হারাচ্ছেন অসংখ্য নাগরিক, ফলে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত স্বাস্থ্যবীমা পাওয়ার সুযোগও কমছে।
হাভার্ড মেডিকেল স্কুলের ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ এনরিক ক্যাবাল্লেরো বলেন, ''এ পরিস্থিতি আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব ছিল এবং সেই অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়া যেত।''
সময় থাকতে যে মার্কিন প্রশাসন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি অবহেলা করেছে, সেদিকেই ইঙ্গিত দেন তিনি।
তিনি বলেন, ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি গুরুত্ব সহকারে দেখার অনেক সুযোগ শীর্ষ কর্মকর্তাদের ছিল। এর ফলে রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়াটা বেশ সহজ হতো। একদিকে তাদের হাসপাতাল ভীতি কাটতো, অন্যদিকে বাড়িতেও তারা শারীরিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার বাড়তি সহায়তা পেতেন।
কোভিড-১৯ যে ডায়াবেটিক রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াতে পারে, অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো- তা জেনেও উদাসীন থেকেছে। ২০০৩ সালের করোনাগোত্রের আরেকটি ফুসফুসের সংক্রামক জীবাণু সার্সে মোট মৃতদের ২০ শতাংশই ছিলেন ডায়াবেটিক রোগী।
এরপর, ২০০৯ সালে এইচ১এন১ ফ্লু মহামারির সময়, ডায়াবেটিক রোগীদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় তিনগুণ বেশি ছিল।
সাম্প্রতিকতম অতীতে ২০১২ সালে মিডল ইস্ট র্যাসপেটরি সিনড্রোম বা মার্স নামের আরেক করোনাগোত্রের ভাইরাসে যারা মারা গিয়েছিলেন বা গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন, তাদের ৬০ শতাংশই ছিলেন ডায়াবেটিক রোগী।
ব্রাজিল:
ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যায় বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ দেশ ব্রাজিল। আর করোনাভাইরাসে দ্বিতীয় প্রভাবিত দেশ। এপর্যন্ত লাতিন আমেরিকার দেশটিতে মারা গেছেন ৮৫ হাজার ৫৬২ জন।
ব্রাজিলে ২০ থেকে ৭৯ বছর বয়স্কদের এক কোটি ৬৮ লাখ ডায়াবেটিক রোগী। দেশটিতে সরকারিভাবে কোভিড-১৯ এ মৃত রোগীদের কতজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন তা প্রকাশ করা হয় না।
তবে দেশটির নিরপেক্ষ কিছু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ হার কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
- তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ডব্লিউএইচও, ডায়াবেটিক ডট কো ইউকে