ট্রেজারি বিল, বন্ডের সুদহার বৃদ্ধিতে সরকারের ব্যাংক ঋণের খরচ বেড়েছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। পলিসি রেট হলো, একটি বেঞ্চমার্ক হার; এই হারে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এ সপ্তাহে ট্রেজারি বিলের সুদহার সর্বোচ্চ ৫০ বেসিস পয়েন্ট এবং বন্ডের সুদহার ৩০ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে— উভয় টুলই সরকার ব্যাংক খাত থেকে থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে।
রোববার বাড়তি সুদহারে সরকার ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ৩,১৯৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্যাংকগুলোর ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১১.৬০ শতাংশ, ১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ৪০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১১.৮০ শতাংশ এবং ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
এর আগে, সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে সব ধরনের ট্রেজারি বিলের সুদহার ২০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর বাইরে ৫ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ডের সুদের হারও গতকাল মঙ্গলবার (১৪ মে) ৩০ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে। ৩,৫০০ কোটি টাকার এই বন্ডের সুদের হার দাঁড়িয়েছে ১২.৪০ শতাংশে। এর আগে, এ ধরনের বন্ড কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১২.১০ শতাংশ সুদ পেতো।
ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার কেন বেড়েছে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা বলেন, "প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সপ্তাহে পলিসি রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ল্যান্ডিং ও ডিপোজিট রেট বাড়াতে হচ্ছে। এসব কারণে এর রিফ্লেকশন দেখা যাচ্ছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহারে।"
"দ্বিতীয়ত, ব্যাংক খাতে এখন লিকুইডিটি স্ট্রেস (তারল্য সংকট) চলছে। ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ টাকার পরিমাণ কমে গেছে। ফলে তাদের হাতে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই। এসব কারণে ব্যাংকগুলো এখন আর কম সুদে বিনিয়োগ করতে চাইছে না, যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ইন্টারেস্ট রেটে।"
"তৃতীয়ত, ব্যাংকগুলোকে ১৫ তারিখে ৪ শতাংশ ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) রাখতে হবে। ফলে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করার আগে তারা তাদের ক্যাশ ফ্লো মেন্টেইন করছে। তাই সুদের হার বেড়েছে," বলেন তিনি।
সিআরআর হল কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত পাবলিক ডিপোজিটের ন্যূনতম পরিমাণ, যা প্রত্যেক বাণিজ্যিক ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ হিসেবে জমা রাখতে হয়।
সরকারের ঋণ নেওয়ার সুদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ডলারের রেটের প্রভাব রয়েছে মন্তব্য করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংকগুলোকে এখন অনুষ্ঠানিকভাবে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। রেমিট্যান্সের ডলার কেনার দামে তেমন পার্থক্য না হলেও রপ্তানির জন্য ডলার কেনার ক্ষেত্রে ডলারপ্রতি ৭ থেকে সাড়ে ৭ টাকার বেশি খরচ করতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোকে ডলার কেনার জন্য বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, যেটা টাকার তারল্য সংকট বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এর প্রভাবও গিয়ে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহারে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সরকারের সুদ পরিশোধ বাড়বে
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ, ট্রেজারি বিল এবং বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায়, ব্যাংকগুলোকে এখন আমানতের হার বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে, আগামী দিনের জন্যেও সরকারকে সুদ পরিশোধে আরও বরাদ্দ রাখতে হবে।
তারা বলছেন, এর ফলে ঋণের সুদহার বাড়ানোর জন্য নতুন করে চাপ তৈরি হতে পারে, যা সাধারণ মানুষের ঋণ নেওয়ার সুযোগকে আরও সীমিত করতে পারে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "ট্রেজারি বিল এবং বন্ডের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোকে তাদের আমানতের হার পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কারণ যদি সরকারি ঋণের এই টুলগুলোতে সুদের হার আমানতের ওপর সুদহারের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ তাদের টাকা ব্যাংকে রাখার পরিবর্তে বিল এবং বন্ডেই বিনিয়োগ করতে বেশি পছন্দ করবে।"
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সরকার চাহিদা অনুযায়ী রাজস্ব বাড়াতে পারছে না, তাই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
উপরন্তু, সরকার বিদেশ থেকেও ঋণ চাইছে, যদিও এই ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। ফলে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের উপর নির্ভর করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে যা ৬৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছেছে।
গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ঋণ নিয়েছিল। অর্থাৎ, সরকারের ঋণের পরিমাণ প্রায় ১২ গুণ বেড়েছে।