২০২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের চেয়ে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে বেশি ঋণ নেবে সরকার
উচ্চ সুদের কারণে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না নিয়ে এখাতের পুরনো ঋণ পরিশোধ করবে সরকার। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশি সুদবাহী হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকরিজীবীদের বিনিয়োগের মাধ্যম জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ড (জিপিএফ) থেকে সরকার ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উভয় উৎসই সরকারের সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ ঋণের একটি নগণ্য অংশ পূরণ করলেও এটি সাধারণ মানুষের ছোট ছোট সঞ্চয়ের সুযোগ কমিয়ে দেবে এবং উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীর জন্য বেশি সুবিধা বয়ে আনবে। ফলে তারা বলছেন, সুদের হার উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান হওয়া উচিত।
শুধু আগামী অর্থবছরের বাজেটেই নয়, চলতি অর্থবছরের বাজেট সংশোধন করে মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ব্যাংক ও প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অন্যদিকে, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে আনা হয়েছে ঋণাত্মকে।
সঞ্চয়পত্রের সুদহারের চেয়েও অনেক বেশি সুদবাহী প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষমাত্রা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরে আরও ৩০ কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে। ২০১৫ সাল থেকে জিপিএফ থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের সুদের পরিমাণ ১৩ শতাংশ। শুধু সরকারি চাকরিজীবীরাই উচ্চ সুদবাহী জিপিএফ ফান্ডে টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। অর্থাৎ, ২২ লাখ সরকারি চাকরিজীবী এই উচ্চ সুদের সুবিধা ভোগ করছেন।
আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের পুরনো বিনিয়োগ ম্যাচিউরড হওয়ায় সরকার যে পরিমাণ ঋণ ফেরত দেবে, তারচেয়ে ৫০ কোটি টাকার কম সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিকল্পনা করছে সরকার। অর্থাৎ, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষমাত্রা মাইনাস (ঋণাত্মক) ৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, সঞ্চয় স্কিমগুলোর মধ্যে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ বছরান্তে সর্বোচ্চ ১১.৭৬ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ বছরান্তে সর্বোচ্চ ১১.৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ১১.২৮ শতাংশ এবং তিন মাস পর পর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের তিন বছরান্তে সর্বোচ্চ ১১.০৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে সরকার।
সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপের কারণে এতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে সাধারণ মানুষের।
তবে পেনশন সেভিংস সার্টিফিকেটের চাহিদা বেড়েছে। মূলত সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতে বিনিয়োগ করে থাকেন।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন সর্বোচ্চ সীমা আছে, জিপিএফ এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আগে কোনো সীমারেখা ছিল না। ২০১৫ সালের নভেম্বরের আগ পর্যন্ত একজন চাকরিজীবী তার মূল বেতনের শতভাগ জিপিএফ-এ রাখতে পারতেন। ওই বছরের নভেম্বর মাসে জিপিএফে বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করে দেয় অর্থমন্ত্রণালয়।
সে অনুযায়ী, বর্তমানে একজন সরকারি চাকরিজীবী তার মূলবেতনের সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত জিপিএফ তহবিলে বিনিয়োগ করতে পারেন।
সরকারের সুদব্যয় বাড়ার প্রেক্ষাপটে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মত দেন সাবেক অর্থসচিব ড. মাহবুব আহমেদ। তবে প্রভিডেন্ড ফান্ডে চাকরিজীবীদের জমার পরিমাণ ও সুদহার কমানোর ক্ষেত্রে আরও পর্যালোচনা করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
"আইএমএফ যখন সঞ্চয়পত্র বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছিল, তখন সেভিংস বন্ডের সুদহার ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তাই এখন আইএমএফের পরামর্শের কার্যকারিতা হারিয়েছে," বলেন তিনি।
সাবেক অর্থ সচিব আরও বলেন, সাধারণ মানুষ সঞ্চয় প্রকল্পে বিনিয়োগ করা নিরাপদ মনে করেন। "সরকার যদি এখানে বিনিয়োগের অনুমতি না দেয়, তাহলে তারা তাদের সঞ্চয় কোথায় রাখবে?" অনেক ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা উল্লেখ করে তিনি এ প্রশ্ন করেন।
যেহেতু এখন ব্যাংকের সুদহার বেড়েছে, তাই জিপিএফের সুদের হার কমানোর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি মনে করেন।
"আগে একজন সরকারি চাকরিজীবী তার মূলবেতনের শতভাগ জিপিএফ তহবিলে রাখতে পারতো। অনেক চাকরিজীবী তাদের বেতনের পুরোটা এই তহবিলে রাখতেন। আমি অর্থসচিব থাকার সময় সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ সীমা নির্ধারণ করি," জানান মাহবুব আহমেদ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান টিবিএসকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ সংকোচিত করতে সরকার বিভিন্ন পলিসি নিয়েছে। সেসব পলিসি এখন কার্যকর হচ্ছে। ফলে এখন অনেকে সঞ্চয়েপত্রে আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছে না। তাছাড়া, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের হাতে সঞ্চয় নেই। এ কারণেই সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ ঋণাত্মক হচ্ছে।
জিপিএফ এর সুদহার সঞ্চয়পত্রের সমান করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, "বর্তমানে ব্যাংক, এনবিএফআই ও সঞ্চয়পত্রের সুদহার প্রায় কাছাকাছি। সে তুলনায় জিপিএফ এর সুদহার বেশ বেশি। তাই জিপিএফ এর সুদহার কমিয়ে সঞ্চয়পত্রের সমান করা হলে সরকারের সুদ ব্যয় কমবে।"
বাড়ছে ব্যাংক ঋণ ও সুদের বোঝা
আগামী বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ১,৫২,০০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ, যা চলতি বছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা বেশি।
এদিকে, ব্যাংকখাতে তারল্য সংকটের সময়ে এখাতের ওপর সরকারের বাড়তি নির্ভরশীলতায় বেসরকারিখাতে অর্থপ্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। এতে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এমন কর্মকর্তারা জানান, সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি হওয়ার কারণে সরকারের সুদব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক ঋণের সুদহার এরচেয়ে বেশ কম। তাই গত কয়েকবছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নেওয়ার বদলে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে সরকার। আগামী অর্থবছরসহ পরের দুই অর্থবছরও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ ৯৪,৩৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ১,০৫,৩০০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে এখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১,০৮,০০০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হচ্ছে। এরমধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ৯৩,০০০ কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ ১৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আলম সতর্ক করেন, সরকারের উচ্চতর ব্যাংক ঋণের কারণে বেসরকারি খাত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মূলধন সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল বলেন, ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে এবং প্রকল্প ব্যয়কের দিকে নজর দিতে হবে।