জিপের সামনে বেঁধে নিয়ে যাওয়া আরও আহত ফিলিস্তিনির খোঁজ পেল বিবিসি
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একটি জিপের সামনে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আহত এক ব্যক্তিকে— গত সপ্তাহে (২২ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দা এবং ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক প্রোটোকল ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে।
২৩ বছর বয়সী মুজাহিদ আবাদি বালাসকে জিপের বেঁধে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিতও করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
গত শনিবার জেনিনের নিকটবর্তী জাবারিয়াতে অভিযানের সময় একই ধরনের বর্বরতার শিকার হওয়া আরও দুই ব্যক্তির খোঁজ পেয়েছে বিবিসি। ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ইসরায়েলি সেনারা তাদের গুলি করে এবং পরে জোর করে সেনাবাহিনীর জিপের বনেটে তুলে গ্রামের রাস্তা দিয়ে নিয়ে যায়। আহত এই দুই ফিলিস্তিনির নাম সামির দাবায়া ও হেশাম ইসলেইত।
জেনিনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২৫ বছর বয়সী সামির দাবায়া বলেন, অভিযানের সময় ইসরায়েলি বাহিনী তাকে পিঠে গুলি করে। সৈন্যরা তাকে পরীক্ষা করতে না আসা পর্যন্ত তিনি কয়েক ঘণ্টা ধরে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন এবং রক্তাক্ত অবস্থায় ছিলেন। তাকে জীবিত আবিষ্কার করার পর বন্দুক দিয়ে পেটানো হয় এবং তারপরে সেনাবাহিনীর জিপে বেঁধে ফেলা হয়।
সামির বলেন, 'ওরা আমার প্যান্ট খুলে ফেলল। আমি গাড়িটি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু একজন সৈনিক আমার মুখে আঘাত করে এবং আমাকে ধরতে মানা করে। এরপর গাড়ি চলতে শুরু করে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম'।
সামির একটি সিকিউরিটি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখান, যাতে দেখা যায়— তিনি অর্ধনগ্ন অবস্থায় দ্রুত চলতে থাকা একটি জিপে শুয়ে আছেন, আর সে জিপের গায়ে '১' নম্বর লেখা।
হেশাম ইসলেইত নামে আরেক ফিলিস্তিনি বিবিসিকে জানান, জাবারিয়াতে অভিযানের সময় তাকে দুইবার গুলি করা হয় এবং '১' নম্বর লেখা একই সামরিক জিপে জোর করে তোলা হয়।
চারিদিক থেকেই গুলি চলছিল বলে জানান তিনি, পালানোর চেষ্টা করলেও তার পায়ে এসে গুলি লাগে। সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট তাকে নিতে আসার পর প্রথমে তার পোশাক খুলে নেয় এবং জিপের সামনের অংশে উঠতে বলে।
হেশাম বলেন, 'জিপটি এতটাই গরম ছিল যে মনে হচ্ছিল 'আগুনের মতো'। আমি খালি পায়ে ছিলাম এবং বিবস্ত্র ছিলাম। আমি জিপে হাত রাখার চেষ্টা করলাম, পারলাম না, প্রচণ্ড গরম। আমি তাদের বলেছিলাম যে এটি খুব গরম, তারপরও তারা আমাকে জোর করে উঠতে বাধ্য করেছিল। আমাকে বলেছিল যে আমি যদি মরতে না চাই তবে আমার এটি করতে হবে।'
হেশাম আরও বলেন, 'আমরা এসব অভিযোগ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে রেখেছি; মামলাগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা'।
মুজাহিদ আবাদি বালাসের মূল ভিডিওর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বিবৃতিতে বলেছে, তাকে অর্ডার ও স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং নীতি লঙ্ঘন করে জিপের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং তার মামলাটি তদন্ত করা হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'ঘটনার ভিডিওতে বাহিনীর আচরণ আইডিএফের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়'।
আহত মুজাহিদের পরিবার বলেছে, তারা অ্যাম্বুলেন্স চাইলেও সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের জিপের বনেটের সাথে বেঁধে গাড়ি চালানো শুরু করে। যদিও ওই ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য রেড ক্রিসেন্টে স্থানান্তর করা হয়।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা মুজাহিদ বলেন, তিনি বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং চলন্ত গাড়িতে শুয়ে শেষ নামাজ আদায় করেন।
তিনি জানান, সৈন্যরা যখন নিশ্চিত হয় যে তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই, তখন তারা জিপ থেকে নেমে আসে এবং তার মুখে, মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। 'সৈন্যরা আমাকে আমার কব্জি ও গোড়ালি ধরে ডানে-বামে ঘুরিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলে', বলেন তিনি।
এরপরে তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং তাকে জিপে তুলে পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
হেশাম বলেন, তিনি ও মুজাহিদ যে বাড়িতে ছিলেন সেটি তাদের প্রতিবেশী ও বন্ধু মাজদ আল-আজমির, যাকে অভিযানের সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনি এখনও ইসরায়েলি হেফাজতে রয়েছেন। তারা তিনজনই নিরস্ত্র ছিলেন এবং পরিচয় যাচাইয়ের পরে সেনাবাহিনী তাদের দ্রুত ছেড়ে দেয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, সন্দেহভাজন আসামিদের গ্রেপ্তার করতে জাবারিয়াতে অভিযান চালায় তারা। তাদের সৈন্যদের ওপর গুলি চালানো হলে, তারাও পালটা আক্রমণ করে। মুজাহিদ আবাদি বালাসকে জিপে বেঁধে রাখার ফুটেজ আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার ঝড় তোলার পর তারা ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করার কথা স্বীকার করেছেন।