করোনায় সংক্রামিত হওয়ার পর দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, শুধু অ্যান্টিবডি নয়
সংক্রমণের পর মানবদেহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে কিনা- বিজ্ঞানীরা সম্ভবত মহামারির গোঁড়া থেকেই চলমান এ অনুসন্ধানী জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়ে গেছেন।
প্রথমদিকের কিছু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি বা রক্তকণিকার আমিষ উপাদান প্রাথমিক সংক্রমণ থেকে দেহকে সুরক্ষিত রাখলেও, তা খুব দ্রুতই আবার বিলীন হয়ে যায়। অর্থাৎ, দ্রুত অ্যান্টিবডি বিলীন হলে পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
শুরুর দিকের গবেষণা ফলাফল নিয়ে তাই বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। শঙ্কা প্রকাশ করেন মহামারি পরিস্থিতিতে এর ভূমিকা নিয়েও। সেই দুশ্চিন্তায় অনেকেই ভুলে যান যে, মানবদেহে আক্রমণকারী ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বহুস্তরের প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে পারে।
অবশ্য এসব অনুসন্ধানে, বাদ দেওয়া হয় প্রতিরোধ ব্যবস্থার শক্তিশালী যোদ্ধা রক্তের শ্বেত কণিকার ভূমিকা। অথচ এটি আমাদের দেহে ভাইরাস সংক্রমণের পর শক্তি সঞ্চয় করে, ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে পুনঃআক্রমণের শক্তি যোগায়। বিশেষ করে, ইতোপূর্বে করোনায় সংক্রমিত কোনো ব্যক্তির দেহে পরবর্তীতে অ্যান্টিবডি না থাকলেও তার দেহে আবার করোনার সংক্রমণ হলে- সেক্ষেত্রে পুনঃপ্রতিরোধ গড়ে তুলবে শ্বেত কণিকার দল।
শ্বেত কণিকাদের যেসব কোষ এই দ্বিতীয় লড়াইয়ের অগ্রভাগে থাকে তাদের- টি মেমোরি সেল বলা হয়। এরা দেহের ভাইরাস সংক্রমিত কোষগুলোকে শনাক্ত করে ধ্বংস করে এবং পরবর্তী সারির যোদ্ধা বি- সেলকে নতুন ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন রণকৌশল কার্যকর হবে- সে সম্পর্কে তথ্য পাঠায়।
গত শুক্রবার জীববিজ্ঞান এবং কোষ গবেষণার বৈজ্ঞানিক সাময়িকী- জার্নাল সেল- এ প্রকাশিত নিবন্ধে এ আবিষ্কার তুলে ধরা হয়।
বৈজ্ঞানিক নিবন্ধটির লেখকরা জানাচ্ছেন, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের প্রায় সকলের দেহেই কোনো না কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এমনকি মৃদু উপসর্গ বা উপসর্গহীন ব্যক্তিদের দেহেও এ প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। মূলত, রক্তের শ্বেত কণিকার টি সেলগুলো দ্বিতীয়বার দেহে ভাইরাস আক্রমণ করলে- তাদের খুঁজে খুঁজে আক্রমণ করে।
গবেষকরা প্রবন্ধে লিখেছেন, ''মেমোরি টি- সেলের এই বিকাশ কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা কবচ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে।''
বিশেষ করে, একবার আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যক্তির ঘন ঘন সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাসে এটি কার্যকর হিসেবে আগামীদিনে প্রমাণিত হতে পারে, বলেও তারা উল্লেখ করেন।
রক্তে নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি অ্যান্টিবডি হওয়া অ্যান্টিবডি সংক্রমণ সেরে ওঠার পর থেকেই কমতে থাকে। সে তুলনায় টি সেল দীর্ঘদিন লড়াই চালানোর জন্য প্রস্তুত থাকায়- দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার এ আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
অ্যান্টিবডি ছাড়াই গড়ে উঠছে করোনা মোকাবিলায় টি-সেল প্রতিরোধ:
লেখক বিজ্ঞানীরা সুইডেনে কোভিড-১৯ এর নানা মাত্রার সংক্রমণে আক্রান্ত ২০৬ জন ব্যক্তির রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে দেখেছেন। এ পরীক্ষায় দেখা গেছে, একজন রোগী মৃদু বা উপসর্গহীন যে ধরনের কোভিড-১৯ রোগেই আক্রান্ত হন না কেন, সবার দেহেই (পুনঃসংক্রমণের বিরুদ্ধে) শক্তিশালী টি মেমোরি-সেল ভিত্তিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে।
গবেষণাটি চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নতুন চাঞ্চল্য তৈরি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ- অ্যান্থনি ফসি টি-সেল নিয়ে এই গবেষণা ফলাফলকে ''শুভ সংবাদ'' বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অ্যালার্জি এবং সংক্রামক ব্যাধি (গবেষণা) কেন্দ্রের (এনআইএআইডি) প্রধান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রধান জনস্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা।
আজ বৃহস্পতিবার (২০ আগস্ট) এনআইএআইডির ফেসবুক লাইভে এসে ফসি বলেন, ''টি সেল গবেষণা নিয়ে এখন অনেক চাঞ্চল্যকর কাজ চলছে। যা প্রমাণ করে, ইতোপূর্বে বা বর্তমানে সংক্রমিত অনেকের দেহেই সন্তোষজনক মানের টি-সেল প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক অতীতের অন্যান্য কয়েকটি গবেষণাও এ তথ্যকে সমর্থন করে।
গত জুলাইয়ে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ৩৬ জন রোগীর একটি গ্রুপে সকলের দেহেই নতুন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টি-মেমোরি সেল গড়ে উঠেছে।
নেচার জার্নালে প্রকাশিত আরেক গবেষণাতেও ১৮ জন জার্মান রোগীর মধ্যে ৮০ শতাংশের দেহে করোনা প্রতিরোধী টি-সেল তৈরি হওয়ার ঘটনা জানানো হয়।
করোনায় আক্রান্ত না হলেও টি-সেল তৈরি হতে পারে:
পূর্বের দুই গবেষণা আরও চাঞ্চল্যকর এক তথ্য দিয়েছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত না হওয়ার পর অনেক ব্যক্তির দেহে এমন টি-সেল সৃষ্টি হয়েছে, যা নাকি করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে সক্ষম।
বিরল এ ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে; ক্রস রিঅ্যাক্টিভিটি। বিজ্ঞানীদের ধারণা; সার্স কোভ-২ এর মতো ইনফ্লুয়েঞ্জা সৃষ্টিকারী করোনাগোত্রের অন্য ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ফলেই এ ধরনের প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে নন-কোভিড ব্যক্তির দেহে। উল্লেখ্য, প্রাণঘাতি নয় এবং সাধারণ সর্দি-কাশির জন্যও দায়ি করোনাগোত্রের কিছু দুর্বল জীবাণু।