দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হাতের নাগালে এফ-১৬: ইউক্রেনের আশা আর চ্যালেঞ্জ যেখানে
বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতি ও পাইলট প্রশিক্ষণের পর ন্যাটো সদস্য দেশগুলো থেকে প্রথমবারের মতো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ইউক্রেনে পৌঁছাতে চলেছে। খবর বিবিসি'র।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, এ বিমানগুলো আকাশযুদ্ধে রুশ আধিপত্য কমাতে এবং ইউক্রেনের 'আকাশকে অবমুক্ত' করার জন্য অপরিহার্য।
অন্যদিকে রাশিয়ান বাহিনীও ইউক্রেনের এফ-১৬ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মস্কো ইতোমধ্যে ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি বিমানঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত এফ-১৬ জেট বিমানগুলো ইউক্রেন পৌঁছানোর পরপরই রাশিয়া সেগুলো আক্রমণ করে ধ্বংস করবে।
কেবল জুলাই মাসেই ইউক্রেনের অন্তত তিনটি বিমানঘাঁটি আক্রমণের শিকার হয়েছে। মস্কো দাবি করেছে, এটি একটি রাডার ও দামি প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাসহ ৫টি ইউক্রেনীয় সু-২৭ ও একটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে।
তবে কিয়েভ কর্তৃপক্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করেছে, ধ্বংস হওয়া বিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আদতে ডিকয় [টোপ] ছিল, যেগুলো ধ্বংস করতে রাশিয়া বেশ কয়েকটি ব্যয়বহুল ইস্কান্দার মিসাইল অপচয় করেছে।
ইউক্রেনের মিত্রদের, এবং অনেক ইউক্রেনীয়র আশঙ্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের এয়ার পাওয়ার ও প্রযুক্তি বিষয়ক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো প্রফেসর জাস্টিন ব্রঙ্কের মতে, ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনী এটির যুদ্ধবিমানগুলো যেন ভূমিতে অবস্থানের সময় ধ্বংস না হয় তা নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত মূল 'বিক্ষিপ্ত অপারেশন'-এর ওপর নির্ভর করেছে।
এ জন্য বিমান ও অন্যান্য সরঞ্জামগুলি নিয়মিত এ ঘাঁটি থেকে অন্য ঘাঁটিতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাই 'রাশিয়া বিমান হামলা চালালে শূন্য টারমাক বা ঘাসে আঘাত করার সম্ভাবনা বেশি।'
তবে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র থেকে পশ্চিমা এফ-১৬-এর বহর রক্ষা করতে চায়, তাহলে দেশটিকে কৌশল পরিবর্তন করতে হতে পারে।
এফ-১৬-এর জন্য মসৃণ রানওয়ের দরকার। রানওয়েতে পাথর কিংবা অন্যান্য ছোট কোনো বস্তু থাকলে এটির ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
'ইউক্রেন এর বিমান ঘাঁটিগুলোর অবকাঠামো উন্নত করতে গেলে তা টের পাবে রাশিয়া,' মনে করেন অধ্যাপক ব্রঙ্ক।
কিছুদিন আগ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের বিমানঘাঁটিতে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য নজরদারি ব্যবস্থা বা স্যাটেলাইট ছবির ওপর নির্ভর করত। ফলে এটির মিসাইল সেগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে কি না তা নিশ্চিতভাবে জানা যেত না।
এখন রাশিয়ার কাছে জালা, সুপারক্যাম ও অরলান্সের মতো গুপ্তচর ড্রোন রয়েছে যা ইউক্রেনের ইলেকট্রনিক শনাক্তকরণ ও জ্যামিং ব্যবস্থাকে এড়িয়ে ইউক্রেনের ভূখণ্ডের গভীর থেকে তাৎক্ষণিক ছবি পাঠাতে পারে।
এফ-১৬ ইতোমধ্যে ইউক্রেনে পৌঁছেছে, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। যদিও কিয়েভ-ভিত্তিক এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আনাতোলি খ্রাপচিনস্কি অনুমান করেছেন যে, রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের বিমানঘাঁটির 'খবরাখবর' নিচ্ছে কারণ এটি বিশ্বাস করে, মার্কিন বিমান ইউক্রেনের হাতে চলে এসেছে।
এ মাসেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ড থেকে এফ-১৬ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
ন্যাটো দেশগুলোর কাছে প্রায় ৬৫টি এফ-১৬ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ইউক্রেন।
এফ-১৬ পেলে ইউক্রেনের কাছে থাকা ফাইটার জেটের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। ইউক্রেনের বর্তমান যুদ্ধবিমানগুলো সবই সোভিয়েত যুগের মিগ-২৯ ও সু-২৭।
চলমান যুদ্ধে রাশিয়ার গ্লাইড বোম ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সাধারণ বোমার গায়ে বাড়তি কিছু সরঞ্জাম লাগিয়ে রাশিয়া এ গ্লাইড বোমা তৈরি করেছে।
কেবল মার্চ মাসেই রাশিয়া প্রায় তিন হাজার গ্লাইড বোমা ফেলেছিল ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন লক্ষ্য করে। এর বেশিরভাগই ফেলা হয়েছে সু-৩৪ ফাইটার-বম্বার থেকে।
ভূমিতে রাশিয়ার আক্রমণ থেকে এফ-১৬ রক্ষা করতে পারলে আশা করা যায়, ইউক্রেন রাশিয়ান বিমানবাহিনীর গ্লাইড বোমা হামলা থেকে কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারবে।
এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলতো এইম-১২০ অ্যামর্যাম নামক আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল ব্যবহার করা হয়। নিক্ষেপের পর নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হলে এ মিসাইলগুলো 'স্বয়ংক্রিয়ভাবে' লক্ষ্যবস্তুর দিকে ছুটে যেতে পারে।
বর্তমানে ইউক্রেনের সোভিয়েত-যুগের বিমানগুলো যেসব মিসাইল ব্যবহার করে, সেগুলো নিক্ষেপের পর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা পর্যন্ত বিমান থেকে একটানা 'টার্গেট লক' বজায় রাখতে হয়।
এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মিসাইল নিক্ষেপের পর তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যাগ করতে পারলেও ইউক্রেনের সোভিয়েত আমলের বিমানগুলোর পক্ষে তা সম্ভব নয়।
তবে এফ-১৬ দিয়ে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের শহরগুলোকে রক্ষা করা যাবে বলে মনে করেন না সবাই।
বেশি উঁচু দিয়ে উড়লে রুশ আকাশ প্রতিরক্ষার মুখে পড়ার ঝুঁকিতে থাকবে এফ-১৬। আবার কম উচ্চতা দিয়ে উড়লে মিসাইলকে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর পর্যন্ত পর্যাপ্ত পাল্লা দিতে রাশিয়ার ভূখণ্ডের গভীরে যেতে হবে বিমানগুলোকে। এতে ঝুঁকি আরও বেশি।
তবে প্যাট্রিয়ট মিসাইল রাশিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইল ভূপাতিত করার পাশাপাশি এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলো ক্রুজ মিসাইলগুলো প্রতিহত করতে পারবে বলে মনে করেন আনাতোলি খ্রাপচিনস্কি।
কিন্তু সমস্যা হলো ইউক্রেনের কাছে পর্যাপ্ত প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থা ও মিসাইল নেই। জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেনের আকাশ রক্ষার জন্য কমপক্ষে ২৫টি প্যাট্রিয়ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দরকার কিন্তু কিয়েভের কাছে মাত্র অল্প কয়েকটি রয়েছে।
এফ-১৬ যুদ্ধবিমান চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেবে না বটে, তবে এগুলো স্থল এবং আকাশে আক্রমণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ইউক্রেন পর্যাপ্ত সংখ্যক এফ-১৬ পাবে কি না এবং ভূমিতে থাকা অবস্থায় রুশ আক্রমণ থেকে এগুলোকে সুরক্ষিত করতে পারবে কি না।