প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউরের ও টিবিএসের বক্তব্য
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনের পৃথক জবাব দিয়েছেন ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমান। এরমধ্যে একটি 'Supposed to end in 180 days, smuggling case lingers for 18 years' (১৮০ দিনে নিষ্পত্তি হওয়ার চোরাচালানের মামলা বিচারাধীন ১৮ বছর ধরে) — শীর্ষক প্রতিবেদনটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে গত ১৩ জুলাই প্রকাশিত হয়।
টিবিএসের অনুসন্ধানে প্রকাশিত খবরটিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১৭ তে চলমান ১৮ বছরের পুরনো, ৪ কোটি ১২ লাখ টাকার অবৈধ ভারতীয় কাপড় আটকের মামলাটির বিচার ৭ বছর ধরে আটকে রয়েছে মতিউর রহমান সাক্ষ্য না দেওয়ার কারণে।
সম্প্রতি টিবিএসে পাঠানো এক লিখিত প্রতিবাদে মতিউর রহমান দাবি করেছেন, প্রকাশিত এই খবর 'ভিত্তিহীন ও মিথ্যা'। তিন পৃষ্ঠার লিখিত ব্যাখ্যায় মতিউর রহমান, এই প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট তথ্য ছাড়াও আরো কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে এনেছেন।
প্রকাশিত খবরের এক অংশে বলা হয়েছে, "মাত্র এক মাসেরও কম সময়ে এনবিআরের চাকরি খুইয়েছেন তিনি, তার 'অবৈধ' সব সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত, এবং বর্তমানে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর। এর সবকিছুরই শুরু হয় গত মাসে ঈদুল আজহার ঠিক আগে, যখন তার ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত '১৫ লাখ টাকার কুখ্যাত সেই ছাগলটি' কিনতে যান।"
এই অংশের ব্যাখায় মতিউর বলেছেন, "ড. মোঃ মতিউর রহমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে চাকরি হারিয়েছেন— কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমি চাকরি হারাইনি। বরং স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে আমি অবসর নিয়েছি।"
গত ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোরবানির একটি ছাগলের ছবি পোস্ট করেন। ওই পোস্টে দাবি করা হয়, ছাগলটির দাম ১২ লাখ টাকা। এতে মতিউর রহমানের আয় নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা তৈরি হয়।
এরপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানকে তার পদ থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।
পরে আত্মগোপেনে থাকা মতিউর অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে অফিসে যোগদানপত্র জমা দিলেও অফিস করেননি। পরবর্তীতে, ৩১ জুলাই মতিউর রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে মতিউর বলেছেন, "দুর্নীতি দমন কমিশন কেবল মিডিয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমার ও আমার পরিবারের সহায়-সম্পত্তিকে অবৈধ ঘোষণা করেনি, বরং দুদক অনুসন্ধান করছে, যা চলমান। এক্ষেত্রে মিডিয়া যেরকম খুশি সেরকম সংবাদ ছাপিয়ে প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, আমার ও আমার পরিবারের সকলের আয়ের উৎস স্ব-স্ব সদস্যের আয়কর নথিতে যথাযথভাবে প্রদর্শিত রয়েছে।"
ছেলের ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। পরবর্তীতে মতিউর, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পদ আদালতের আদেশে জব্দ করেছে দুদক।
টিবিএসকে দেওয়া বিবৃতিতে মুশফিকুর রহমান ইফাতকে নিজের সন্তান হিসেবে অস্বীকার করে মতিউর রহমান বলেছেন, "সাদেক এগ্রোর মালিক মো. ইমরান হোসেন টার্গেট করেন ১৬ বছরের মুশফিকুর রহমান ইফাত নামক এক সুদর্শন, মেধাবী ছাত্রকে; যে কিনা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ইংলিশ ভার্সনে এস.এস.সি সম্পন্ন করে নটরডেম কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেন। চতুর ইমরান হোসন, ইফাতকে বলেন যে, সে একটি ছাগল বিক্রির জন্য মূল্য ঘোষণা করেছেন ১৫ লাখ টাকা, যা নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আলোড়ন উঠেছে।"
মতিউর বলেন, "বাস্তবিক অর্থে, চতুর ইমরান সরলমনা কিশোর ইফাতকে ব্যবহার করে ৬০০ টাকা কেজি দামে কেনা গরুকে উচ্চ বংশীয় গরু বলে প্রতি গরু ১ কোটি টাকা করে বিভিন্ন লোকের কাছে বিক্রি করেন। প্রকৃতপক্ষে, এখানে ইফাতের সঙ্গে কোনো ছাগল কেনা-বেচাই হয়নি এবং এখানে ড. মোঃ মতিউর রহমানের কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। ১৬ বছরের একটি ছেলের সাথে গার্ডিয়ান ব্যতীত বড় অংকের লেনদেন করার বিষয়টি যৌক্তিকও নয় এবং ষড়যন্ত্র মর্মেই প্রতিয়মান।"
টিবিএসে পাঠানো ব্যাখ্যায় মতিউর রহমান দাবি করেছেন, খবরের একটি অংশে 'উপায়ান্তর না দেখে চলতি বছরের ১৩ জুন, ১৮ বছর ধরে বিচারাধীন ওই চোরাচালানের মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন তিনি'— ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এই অংশের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, "তৎসময় (২০০৬ সালে এই চোরাই কাপড় আটকের সময়) আমি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পরিচালক ছিলাম। পরিচালক হিসেবে এই মামলায় সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকার কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ অবশ্যক নয়।"
"তদুপরি যখন সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য (আদালত) ডেকেছেন, তখনই উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছি, অর্থাৎ আমার সাক্ষ্যগ্রহণ সময় মতো না নেওয়ার কারণে আলোচ্য মামলাটি বিলম্বিত হওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, মানহানিকর ও আপত্তিজনক," দাবি করেন মতিউর।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী, মামলায় ১৫ জন সাক্ষীর মধ্যে মতিউর ছিলেন ৬ নম্বর সাক্ষী। আটক হওয়া ওই চোরাই কাপড় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের হেফাজতে ছিল।
টিবিএসের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৬ সালের এই মামলাটির বিচার ৭ বছর বন্ধ ছিল এনবিআরের আলোচিত কর্মকর্তা মতিউরের কারণে। এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী মতিউরকে ৭ বছরে ৯ বার সমন জারি করেও তাকে আদালতে হাজির করা যায়নি। এ কারণেই বিলম্বিত হয় বিচারকাজ।
আদালতের নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর তারিখ মতিউর রহমানের সাক্ষ্য দেওয়ার দিন ধার্য ছিল। ৯ বার তাকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালত সমন জারি করে কাজ না হওয়ায়, সর্বশেষে চলতি বছরের ২৬ মে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯০ ধারা অনুযায়ী 'নন-বেইলেবল ইউটনেস ওয়ারেন্ট' (এনবিডব্লিউডব্লিউ) ইস্যু করেন আদালত, অর্থাৎ পুলিশের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য বাধ্য করার আদেশ দেওয়া হয়, এরপরেও উপস্থিত না হলে সাজার আদেশ দেবেন আদালত। যেই আদেশের কপি টিবিএসের কাছে সংরক্ষিত আছে।
এরপর ধার্য তারিখ অনুযায়ী গত ১৩ জুন মামলায় সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হন মতিউর।
সাক্ষীকে বার বার সমন জারির পরেও আদালতে হাজির না হলে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯০ ধারায় আদালতের এখতিয়ার নিয়ে বলা হয়েছে—
কোনো আদালত, যেকোনো ক্ষেত্রে এই ধরার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির উপস্থিতির জন্য সমন জারি করার ক্ষমতা রাখেন; একইসঙ্গে লিখিতভাবে কারণ লিপিবদ্ধের পর, উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন।
(A court may, in any case in which it is empowered by this Code to issue a summon for the appearance of any person, issue a warrant for his arrest after recording its reasons in writing.
The subsections say: (a) If, either before the issue of such summons, or after the issue of the same but before the time fixed for his appearance, the court sees reason to believe that he has absconded or will not obey the summons; or
(b) If at such time he fails to appear and the summons is proved to have been duly served in time to admit of his appearing in accordance therewith and no reasonable excuse is offered for such failure.)
টিবিএস প্রকাশিত খবরটির সকল তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রকাশিত হওয়ায় আমরা আমাদের প্রতিবেনের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছি।
ব্যাখার শুরুতেই মতিউর রহমান দাবি করেছেন, "একটি মহল গোয়েন্দা সংস্থা, গণভবন ও সিআরআই ইত্যাদি ব্যবহার করে গত ঈদ-উল আযহার সময় কৌশলে তথাকথিত 'ছাগলকাণ্ড' নাটক সাজিয়ে আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদেরকে মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অতিরঞ্জিত, অপতথ্য, সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে প্রচার করে আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদেরকে 'দুর্নীতিবাজ' আখ্যা দিয়ে সমাজের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে রাখা।"
আরেক প্রতিবেদনের জবাবে মতিউর
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত, 'Goat scandal': Relatives in village shocked at Matiur's wealth revelation' ('ছাগল-কাণ্ডের মতিউরের এত সম্পদ! বিশ্বাস হচ্ছে না এলাকাবাসীর')— শীর্ষক সংবাদটিও মিথ্যা দাবি করেছেন মতিউর রহমান।
প্রতিবাদলিপিতে তিনি বলছেন, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদনে মসজিদের ভুল ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিবেদনে কোনো মসজিদের ছবি ব্যবহার করেনি। নীল রংয়ের দোতলা ভবনের ছবিটি তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার কাজীরচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের।
মতিউর রহমান প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ করে দাবি করেছেন, দাপ্তরিক কাজে এক টাকারও দুর্নীতি করেননি তিনি।
টিবিএসের প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কয়েক দফার অনুসন্ধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আনীত আর্থিক ও রিয়েল এস্টেট সম্পদসহ কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন বলে যে অভিযোগের উল্লেখ রয়েছে, তা দুদকের অনুসদ্ধানে প্রাপ্ত।
প্রতিবাদলিপিতে তিনি বলেছেন, "আমার পরিবারকে বিএনপি 'বানিয়ে' শায়েস্তা করতে চেয়েছিল।"
তবে প্রতিবেদক সরেজমিন ঘুরে কাজীরচর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, নির্বাচন অফিস এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দেওয়া তথ্যে জেনেছেন, মতিউর রহমানের মেজ ভাই কাইয়ূম হাওলাদার ওয়ার্ড বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন। মতিউরের বাবা ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি আব্দুল হাকিমও শিক্ষকতা পেশা থেকে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন এবং বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন।
মতিউর রহমানের অভিযোগ, তার বড় ভাই ও ছোট ভাই তার ব্যবসা দেখভাল করছেন বলে প্রতিবদেনে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও আমাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোথাও তার বড় এবং ছোট ভাই– কারো কথাই বলা হয়নি।
প্রতিবেদনে যে সম্পত্তির কথা উল্লেখ আছে, তা স্থানীয়রা প্রতিবেদকে সরেজমিনে জমি দেখিয়ে জানিয়েছেন, এই সম্পত্তির মালিক মতিউর রহমান।
মতিউর রহমান দাবি করেছেন, প্রতিবেদনে তার ভাই কাইয়ূম হাওলাদাকে অসৎ ব্যবসায়ী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কিন্তু টিবিএসে প্রকাশিত সংবাদে কেবল মতিউর রহমান তার মেজ ভাই কাইয়ূম হাওলাদাকে ঢাকার টঙ্গীতে ব্যাগ ফ্যাক্টরি খুলে দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে; প্রতিবেদনের কোথাও কাইয়ূম হাওলাদারকে অসৎ ব্যবসায়ী বলা হয়নি।
মতিউর রহমান দাবি করেছেন, প্রতিবেদনে তার মালিকানাধীন জুতার কারখানাটি ৩০০ বিঘার উপরে তথ্য সংযুক্ত করে মিথ্যাচার করা হয়েছে। যদিও প্রকাশিত সংবাদে এমন কোনো তথ্যই উল্লেখ করা হয়নি; বরং দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক তদন্তের সূত্র ধরে, গাজীপুরের পুবাইলে ৩০০ বিঘা জমি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
টিবিএসে প্রকাশিত সংবাদটির প্রতিবেদক দুইদিন ধরে কাজীরচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান চালিয়ে, স্থানীয় ও তার স্বজনদের বক্তব্য সংগ্রহ করেই তা সংবাদ–তথ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেসব বক্তব্যের ভিডিও টিবিএসের কাছে সংরক্ষিত আছে। সংবাদের সকল তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রকাশিত হওয়ায় আমরা আমাদের প্রতিবেদনের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছি।