বেঁধে দেওয়ার পরেও বেড়েছে ডিম-মুরগির দাম, সবজিতেও অস্বস্তি
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে ডিম, মুরগি, সবজিসহ বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম।
বাজার স্থিতিশীল রাখতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গত ১৫ সেপ্টেম্বর ডিম, ব্রয়লার ও সোনালী মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয়। যদিও বাজারে সে দাম অনুসরণ করছেন না বিক্রেতারা।
সরকার বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ডিমের দাম ডজনে ২৩-২৮ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
নতুন দর অনুযায়ী, খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা ও সোনালি মুরগি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা দরে বিক্রি হবে। এছাড়া, খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম রাখা হবে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা করে। তাতে প্রতি ডজন ডিমের দাম পড়বে ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, কল্যাণপুর, হাতিরপুল বাজার ঘুরে ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন ১৬৫-১৭০ টাকায়— যা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও ২৩-২৮ টাকা বেশি।
অন্যদিকে, ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৯০-২০০ টাকা করে। আর সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০-২৯০ টাকা করে।
খামারি ও ব্যবসায়ীরা জানান, সম্প্রতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে ফসল, মাছ ও মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাজারে পণ্যের সরবরাহ গেছে। তাছাড়া, অনেক প্রান্তিক খামারি নতুন করে মুরগি খামারে ওঠাচ্ছেন না, আবারও অতিবৃষ্টির শঙ্কায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুরগির খাবারের অতিরিক্ত দাম। সব মিলিয়ে ডিম ও মুরগির দাম বাড়ছে।
রাজধানীর কারওয়ানা বাজারের ডিম বিক্রেতা মোহম্মদ আবুবক্কর সিদ্দিক বলেন, "সরকার নির্ধারিত দামে আমরা কিনতেও পারি না। তার উপর চাহিদার চেয়ে কম পাচ্ছি ডিম। প্রতিদিন ৩,০০০ ডিম চাহিদা দিলে পাইকারি বিক্রেতা আমাদের ২,০০০ ডিম দেন। গত এক মাস ধরে চাহিদার চেয়ে ডিম কম আসছে।"
কল্যাণপুরের আল্লাহর দান ব্রয়লার হাউজের মুরগি বিক্রেতা মাসুদ রানা বলেন, "গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৭৫ টাকা কেজি আজকে ১৯০ টাকা। আসলে বৃষ্টির কারণে মুরগির সরবরাহ কম। তাই দাম বেড়েছে।"
ইব্রাহিম খলিল নামে এক ক্রেতা বলেন, "প্রতিদিন সকালে একটি ডিম খেতাম, এখন সেটা দুই দিনের একটি খাই। তবে চেষ্টা থাকে বাচ্চাকে প্রতিদিন খেতে দেওয়া। আর মুরগি সপ্তাহে একদিন কিনতাম শুক্রবার। আজকে ২০০ টাকা কেজি করে কিনেছি। আগে নিতাম প্রায় দুই কেজি ওজনের, এখন নিয়েছি দেড় কেজি ওজনের। দাম বাড়ায় পরিমাণে কম নিয়েছি।"
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা প্রায় ৪ কোটি পিস, যেখানে উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ৪ কোটি পিস। তবে উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ডিমের দাম বাড়ছে।
পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, "দেশে ফিড উৎপাদনের পণ্য আমদানি নির্ভর না হলেও শতভাগ আমদানির কথা বলে ডলার সংকট ও ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের অজুহাতে অযৌক্তিকভাবে ফিডের দাম দ্বিগুণ করে রাখা হচ্ছে। ডিম এবং মুরগি উৎপাদন করতে ৭৫ শতাংশ খরচ হয় ফিডের জন্য।"
কর্পোরেট সেটিংসে ডিমের উৎপাদন খরচ ৮.৪০ টাকা— যেখানে ছোট খামারিদের এই খরচ পড়ে ১০.২৯ টাকা। সুমন হাওলাদার বলেন, ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ছোট খামারিদের জন্য ১৫৫ থেকে ১৭০ টাকার মধ্যে এবং বড় পরিসরের কর্পোরেট গ্রুপের জন্য ১২০ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে থাকে।
"ফিডের দাম না কমলে, ছোট খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং অনেককে খামার বন্ধ করে দিতে হতে পারে," যোগ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে থাকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সে ক্ষমতাবলে সম্প্রতি ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দিয়েছে সরকারের এই সংস্থা। যদিও কেউ তা না মানলে কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা নেই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের।
কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, তদারকির মাধ্যমে তারা কেবল অভিযোগ দায়ের করতে পারেন তারা। তখন দ্বারস্থ হতে হয় প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। সংস্থাটি থেকে তাই বিভিন্ন সময় কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না।
সরকারের ১১টি সংস্থা মূলত পণ্যের বাজার মনিটরিং করে। সেগুলো হলো— ভোক্তা অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), সিটি করপোরেশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্যারিফ কমিশন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন।
দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে কিংবা রোজার সময় সংস্থাগুলো যে যার মতো উদ্যোগ নেয়। তবে বিচ্ছিন্ন এ কাজে বাজারে তেমন প্রভাব পড়ে না।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম ১০.৬১ শতাংশ বেড়ে ১৭৫-১৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর ডিমের দাম প্রতি হালিতে ৪.৭২ শতাংশ বেড়ে ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান টিবিএসকে বলেন, "আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখা, দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক করা, নিত্যপ্রয়োজনী পণ্যর দাম নিয়ন্ত্রণে এনে মানুষেকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়া— এগুলো সরকারের প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত।"
নিম্ন ও স্বল্প আয়ের পরিবারে প্রাণিজ আমিষের বড় উৎস ডিম ও ফার্মের মুরগি। তবে এখন দাম বাড়ায় এগুলো তারা কম কিনছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাড়ছে সবজির দাম
টানা বৃষ্টির প্রভাবে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে সবজির দাম বেড়ে গেছে কেজিতে ১০-১৫ টাকা। এরজন্য বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা মেহেদি হাসান বলেন, "বৃষ্টির কারণে সবজির ট্রাক বাজারে কম এসেছে। তাই চাহিদা বেশি ও সরবরাহ কম; ফলে সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়েছে সবজির দাম।"
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পেঁপে ছাড়া বাজারে প্রায় সব সবজির দাম ৬০ টাকার ওপরে কেজি।
বাজারে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৩২০-৩৬০ টাকা।
এদিকে, বাজারে উচ্চমূল্য অপরিবর্তিত রয়েছে চাল, আলু, পেঁয়াজ, রসুনের। দেশি পেঁয়াজ কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। আলু ৬০ টাকা, দেশি রসুন ২৩০ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৭৫-৭৮ টাকা, আর মাঝারি মানের বিআর–২৮ চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।