রতন টাটার যত বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী টাটা সন্স-এর চেয়ারম্যান ইমিরেটাস রতন টাটা ৮৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। বুধবার রাতে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি ভারতের অন্যতম প্রাচীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটিকে বৈশ্বিকীকরণ ও আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তার সাহসী এবং উচ্চাভিলাষী ব্যবসায়িক ঝুঁকির নীতি একটি উচ্চ-প্রোফাইল অধিগ্রহণ কৌশল তৈরি করেছে, যেটি ১৫৫ বছর আগে তার পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত টাটা গ্রুপকে ১৯৯০-এর দশকে ভারত উদার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের পরও প্রাসঙ্গিক রাখতে সক্ষম হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে টাটা ভারতের ব্যবসায়িক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক ক্রয় সম্পন্ন করে টেটলি চা কিনে নেয়, যেটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম টি ব্যাগ উৎপাদক। এই বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্র্যান্ডটি টাটা কোম্পানির তিন গুণ বড় ছিল।
এর পরবর্তী বছরগুলোতে টাটার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে যায়। তিনি ব্রিটেনের প্রধান প্রধান কোম্পানি যেমন স্টিল প্রস্তুতকারক কোরাস এবং বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভারকে অধিগ্রহণ করেন।
২০০৭ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের ঠিক আগে খুব উচ্চমূল্যে কোরাস অধিগ্রহণ টাটা স্টিলের কার্যকারিতাকে বহু বছর নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করলেও, এটি টাটার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।
ঐতিহাসিক এবং 'টাটা: দ্য গ্লোবাল কর্পোরেশন দ্যাট বিল্ট ইন্ডিয়ান ক্যাপিটালিজম' বইয়ের লেখক মিরসিয়া রায়ানু উল্লেখ করেন, এসব অধিগ্রহণের একটি বড় প্রতীকী গুরুত্ব ছিল। তিনি বলেন, এই অধিগ্রহণগুলো ব্রিটিশ মনোভাবের উল্টো প্রতিনিধিত্ব করেছে কারণ একটি সাবেক উপনিবেশিক ব্যবসা যুক্তরাজ্যের মূল্যবান সম্পদ অধিগ্রহণ করেছে; যেটিকে "সাম্রাজ্য প্রতিশোধ নিচ্ছে" হিসেবে দেখা যায়।
বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
টাটা গ্রুপের দৃষ্টিভঙ্গি শুরু থেকেই "বহির্মুখী" ছিল, এমনটি জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেয়া গোল্ডস্টাইন। তিনি ২০০৮ সালে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিককরণের ওপর একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে বিশেষভাবে টাটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।
১৯৫০-এর দশক থেকেই টাটা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি অংশীদারদের সাথে কাজ করছিল।
তবে রতন টাটা "প্রতীকী, পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপের পরিবর্তে বৃহৎ পদক্ষেপে আন্তর্জাতিককরণ" করতে আগ্রহী ছিলেন, এমনটি উল্লেখ করেছেন গোল্ডস্টাইন।
মিরসিয়া রায়ানু বলেন, স্থাপত্যবিদ্যায় তার অপ্রচলিত শিক্ষা এবং তার পরিবারের গ্রুপ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম দেখে বড় হওয়া তার ব্যবসা সম্প্রসারণের সামগ্রিক চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এটি ছিল "গ্রুপের কাঠামোগত পরিবর্তন" যা তাকে তার বৈশ্বিক উপস্থিতি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছিল।
টাটা ১৯৯১ সালে টাটা সন্সের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় টাটা গ্রুপের সদরদপ্তর বোম্বে হাউজে একটি ব্যতিক্রমী কর্পোরেট যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এই সময় ভারতে উদার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
তিনি টাটা স্টীল, টাটা মোটরস এবং তাজ হোটেল গ্রুপে যে সকল 'সাত্রাপ' (একটি পার্সিয়ান শব্দ, যার অর্থ সাম্রাজ্যপন্থী গভর্নর) কাজ করছিলেন, তাদের অপসারণ করে তিনি ক্রমবর্ধমান বিকেন্দ্রীভূত, ঘরোয়া-কেন্দ্রিক কার্যক্রমকে কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করেন। হোল্ডিং কোম্পানির কাছ থেকে খুব কম কর্পোরেট নজরদারিতে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছিল।
এভাবে তিনি নিজেকে এমন লোকেদের সান্নিধ্যে আনতে সক্ষম হন, যারা তার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে সাহায্য করতে পারেন এবং ভারতের অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দেওয়ার সাথে সাথে টাটা গ্রুপকে বিদেশী প্রতিযোগিতার হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হন।
টাটা সন্সসহ হোল্ডিং কোম্পানি এবং এর অধীনে থাকা পৃথক গ্রুপগুলোতে তিনি বিদেশী, অনিবাসী ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কিং-এ দক্ষ কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনা দলের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন।
তিনি গ্রুপ কর্পোরেট সেন্টার (জিসিসি) প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি গ্রুপ কোম্পানিগুলোকে কৌশলগত দিক নির্দেশনা প্রদান করে। ২০১৬ সালের একটি গবেষণাপত্রে বেঙ্গালুরুর ভারতীয় ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলেন, এটি "মার্জার এবং অ্যাকুইজিশন (এম অ্যান্ড এ) পরামর্শ সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি গ্রুপ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করে এবং টার্গেট প্রতিষ্ঠানটি টাটার মূল্যবোধের সাথে মেলে কি না– তা মূল্যায়ন করে।"
জিসিসি টাটা মোটরসকে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (জেএলআর) এর মতো উচ্চপ্রোফাইল অধিগ্রহণের জন্য অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করেছে, যা মূলত একটি ট্র্যাক্টর প্রস্তুতকারক কোম্পানির বৈশ্বিক পরিচিতি আমুলে পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
রায়ানু বলেন, "জেএলআর অধিগ্রহণটি ব্যাপকভাবে ফোর্ড-এর প্রতি 'প্রতিশোধ' হিসেবে দেখা হয়েছিল কারণ ফোর্ড ৯০-এর দশকের শুরুতে টাটা মোটরসকে অধিগ্রহণ করতে অবজ্ঞা করেছিল এবং তারপর টাটা মোটরসের চুক্তির কাছে হেরে গিয়েছিল। এই অধিগ্রহণগুলো একত্রিত হয়ে প্রমাণ করেছিল, প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে থাকার মধ্যেই ভারতীয় কর্পোরেটরা বৈশ্বিক মঞ্চে 'নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিল' এবং মুক্ত বাজার সংস্কারের সুফল দেখা যাচ্ছিল।"
আজ ১২৮ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের টাটা গ্রুপ ১০০টিরও বেশি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গ্রুপের আয়ের একটি বড় অংশ বাইরের দেশগুলো থেকে আসে।
যেসব সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিল
টাটা গ্রুপ ২০০০ সালের শুরুতে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সাফল্য অর্জন করলেও, ভারতে টাটা ন্যানোর ব্যর্থতার কারণে একটি বড় বাধার সম্মুখীন হয়। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি হিসেবে বাজারে নিয়ে আসা প্রকল্পটি রতন টাটার সবচেয়ে মহৎ উদ্যোগ ছিল। কিন্তু তিনি ভারতীয় ভোক্তাদের সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, অনেক ভারতীয় নিজেদের "সস্তা গাড়ি" নামক ধারণার সঙ্গে যুক্ত করতে চাননি। রতন টাটাও পরে স্বীকার করেছিলেন, "গরিবের গাড়ি" নামকরণটি গ্রাহকদের মধ্যে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল, যেটি আসলে করা ঠিক হয়নি।
টাটা আশা করেছিলেন, ন্যানো প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত হবে। কিন্তু বিক্রি ক্রমাগত কমতে থাকায় প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
টাটা গ্রুপের উত্তরাধিকারের বিষয়টিও একটি বিতর্কিত ইস্যু হয়ে ওঠে। ২০১২ সালে অবসর নেয়ার পরও রতন টাটা কোম্পানির সঙ্গে টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন, যেটি টাটা সন্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের মালিক।
রায়ানু বলেন, "রতন টাটাকে দোষারোপ না করলেও, সাইরাস মিস্ত্রীর সঙ্গে উত্তরাধিকারের বিরোধে তার (রতন টাটা) জড়িত থাকা নিশ্চিতভাবে গ্রুপের ভাবমুর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে।"
সাইরাস মিস্ত্রী ২০২২ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। তাকে ২০১৬ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারন করা হয়। এর ফলে একটি দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হয়, যা শেষমেশ টাটা গ্রুপ জিতে যায়।
টাটা গ্রুপের স্থায়ী উত্তরাধিকার
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও রতন টাটা ২০১২ সালে অবসর নেন এবং তার নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ ভারত ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বড় বড় অধিগ্রহণ এবং আধুনিকায়নের ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন, বিশেষ করে আইটি খাতে; যেটি গ্রুপটির ব্যাপক উপকার করেছে।
যদিও তার কিছু বিনিয়োগ সফল হয়নি, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস) এবং জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (জেএলআর) ভালো ফল করেছে, যা গ্রুপের অন্যান্য দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দিতে সাহায্য করেছে। টিসিএস বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বড় আইটি সেবা কোম্পানি এবং টাটা গ্রুপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস। গ্রুপের মোট আয়ের তিন-চতুর্থাংশ টিসিএস থেকে আসে।
২০২২ সালে টাটা গ্রুপ প্রায় ৬৯ বছর পর সরকারের অধিগ্রহণ থেকে এয়ার ইন্ডিয়াকে পুনরুদ্ধার করে। এটি রতন টাটার একটি ব্যক্তিগত স্বপ্ন ছিল কারণ তিনি নিজেও একজন প্রশিক্ষিত পাইলট ছিলেন। তবে এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল কারণ একটি এয়ারলাইন্স পরিচালনা করতে প্রচুর অর্থ খরচ হয়।
বর্তমানে টাটা গ্রুপ বিভিন্ন খাতে, যেমন এয়ারলাইন্স এবং সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে সাহসীভাবে বিনিয়োগ করার শক্তিশালী পরিকল্পনা করছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত "ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন" তৈরির লক্ষ্য নিয়ে বড় বড় শিল্প গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করছে, যেটি টাটা গ্রুপের পাশাপাশি আদানির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুবিধাজনক।