শহীদ রুমী স্মৃতি পাঠাগার: কড়াইলের ‘বাতিঘর’
মীনা কার্টুনের মীনার স্বপ্নে দেখা স্কুলের কথা মনে আছে? মীনা-রাজু ভাইবোন হলেও মীনা কন্যা সন্তান হওয়ায় স্কুলে যেতে পারত না। তার ভাই যখন স্কুলে নতুন নতুন রূপকথার গল্প শুনত, তখন মীনার রূপকথারা কেবল স্বপ্নবন্দি। বালিশের পাশে বই আগলে ঘুমানো মীনার স্বপ্নে আসে স্কুল; ফুল-লতা-পাতায় ঘেরা স্কুল যেখানে কেবল স্কুল ছুটির ঘণ্টায় না, ক্লাস শুরুর ঘণ্টায়ও আনন্দ নেমে আসে।
বাংলাদেশে পড়াশোনাটা আনন্দ নিয়ে করার কথা কেউ শেখায় না, অনেকের সে সুযোগটাই হয় না। এ কারণে বই পড়ার অভ্যাস কুক্ষিগত থেকে যায় সমাজের একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে। পাঠাগার হয়ে পড়ে কেবলই নীরব থাকার স্থান যার সঙ্গে গণমানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এক্ষেত্রেই বোধহয় ভিন্ন কড়াইলের শহীদ রুমী স্মৃতি পাঠাগার। ২০১৪ সাল থেকে গত ১০ বছর ধরে কড়াইলের সাধারণ মানুষ ও শিশুদের জন্য সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের শহীদ কমান্ডো শাফী ইমাম রুমীর স্মৃতিধারক পাঠাগারটি।
কড়াইল বস্তি, গুলশান-বনানীর আলোর ঝাঁঝ যেন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বারবার ভয় দেখায়, তবুও সেখানকার মানুষ বেঁচে আছে, জীবন কাটাচ্ছে নিজস্ব রীতিতে। সরু রাস্তা, চারপাশে মানুষের আনাগোনা, টিনের সারি সারি বাড়ি, কেমন একটা হালকা অপরিচিত গন্ধ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে কেমন এক অন্যরকম ঢাকা শহরের দেখা মেলে কড়াইলে।
মহাখালী ওয়্যারলেস গেট পেরিয়ে বউবাজারের শেষ প্রান্তে কড়াইলের নৌকাঘাটের পাশে একটা মাঝারি টিনের ঘর। বাইরে বোর্ডের ওপর লেখা নামটা একটুখানি মলিন হয়েছে বটে। দরজার বাইরের পুরো জায়গাটা অন্ধকার। হালকা করে দরজা খোলা থাকায় ভেসে আসছিল গানের সুর ও কথা:
'আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি
নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।'
পাঠাগারে তখন চলছে দশকপূর্তি উপলক্ষ্যে উদযাপনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। কেউ নাচছে, কেউ গাইছে, কেউ বা মূকাভিনয়ের প্রস্তুতি। ওরা খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নেয়।
টিনের চালার ছোট্ট ঘরটা যেন ওদের সব পেয়েছির দেশ, এক অন্যরকম পৃথিবী। সে সব পেয়েছির দেশে ওরা যেন বাঁচার মত বাঁচে। তাকগুলোতে দেশি-বিদেশি লেখকদের লেখা বইয়ের আনাগোনা। কখনো নজরুল, কখনও সুনীল, কখনও ম্যাক্সিম গোর্কি। মাত্র ৫০টা বই নিয়ে শুরু করা এ লাইব্রেরিতে এখন বইয়ের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি।
পাঠাগারের শুরুর গল্পটা রাফসানুল এহসান সাজ্জাদের হাত ধরে। ইউনিসেফের একটি প্রকল্পে তার কাজ ছিল দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের স্কুলগামী করা। পরবর্তীকালে সে প্রকল্প শেষ হলেও তিনি থেকে যান কড়াইলে। তিনিসহ মাত্র সাতজনের উদ্যোগে যাত্রা শুরু হয় শহীদ রুমী স্মৃতি পাঠাগারের।
বর্তমানে পাঠাগারটির পরিচালনা পর্ষদে আছেন রাফসানুল এহসান সাজ্জাদ, ছায়েদুল হক নিশান, ফারজানা আক্তার মালা, জসিম উদ্দীন। প্রথম থেকে এতদূর আসার পথটা মোটেও সহজ ছিল না নিশানদের। কড়াইলের সাধারণ মানুষদের কাছে ধীরে ধীরে নিজেদের সমর্থন আদায় করতে হয়েছে।
গ্রহণযোগ্যতা ছিল না পাঠাগারের 'ভাইয়া' পরিচয়ে, তাই হয়ে উঠলেন পাঠাগারের 'স্যার'। প্রথমত পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হয়েছে। প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পাঠাগারে আসার বিষয়টা। একসঙ্গে তারা গান গায়, কথা বলে—এসব নিয়ে নানা ইঙ্গিত আর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।
সাধারণ সম্পাদক ছায়েদুল হক নিশান বলেন, 'তখন আমরা শুরু করি পরিবারগুলোর কাছে যাওয়া, তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাদের কথাগুলো শোনা, বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করা। বাচ্চাগুলোর পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য করতে যেতাম। পরিবারগুলো দেখল, আমরা এর বিনিময়ে কোনো অর্থ নেই না। তখন গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে।
'প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ালেও পরে ব্যাচ করে নিয়ে পড়াতাম। আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা নিজেদের সুবিধামত এসে ক্লাস নিয়ে যেত। প্রথম ব্যাচ থেকেই মাধ্যমিকে সবাই পাস করে। এ ফলাফলে পরিবর্তনে পরিবারগুলো আমাদের প্রতি ভরসা পায়।'
নিশান আরও বলেন, 'আমরা আমাদের তরফ থেকে প্রতিটা পরিবারের কাছে ছেলেমেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানোর ব্যাপারে উত্সাহিত করেছি। আমাদের এখানে শালুক নামের একটা মেয়ে, ওকে অষ্টম শ্রেণি থেকে ওর বাবা-মা বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ও বলে, পাঠাগার যা বলে আমি তা-ই করব। এখন ও অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছে।
'এরকম একটা ছেলেকেও পরিবার থেকে জোর করে কাজ করাত অল্প বয়সে। ও পাঠাগারে আসে, পড়াশোনা করে বলে বাবার সঙ্গে কাজ করতে পারে না। ওর পরিবার ওকে ত্যাজ্য করে দিয়ে পিটিয়ে বের করে দেয়। এরপর আমরা ওর দায়িত্ব নেই। আমরা ওকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে পেরেছি।'
নিশানরা প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন, পাঠাগারটা শুধু বই আদান-প্রদানের জায়গা না হয়ে হয়ে উঠবে একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু। তারা প্রতি সপ্তাহে একটা পাঠচক্র করতেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কখনো সেটা নির্দিষ্ট কোনো বইয়ের বিষয়ে মত বিনিময় নিয়ে, কখনো কড়াইলের বিভিন্ন সমস্যাকে কেন্দ্র করে। ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে।
পাঠচক্রগুলোর মাধ্যমে তারা বুঝতে পেরেছেন, কেন কড়াইলের সংকটগুলো তৈরি হয়। নিশান বলেন, 'ওরা জানে কেন ওদের সংকটগুলো তৈরি হয়, ওরা ফিলিস্তিন সম্পর্কে জানে। ওরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের মতামত দিতে জানে এসব পাঠচক্রের মাধ্যমে।'
পাঠাগারটিকে বিভিন্ন রোষানলেও পড়তে হয়েছে অনেকবার। মেয়েদের উত্তক্ত করার পর মেয়েরা সাড়া না দিলে মেয়েদের সম্পর্কে, পাঠাগারের বিরুদ্ধে অপবাদ রটানোর প্রতিবাদে কড়াইলে মিছিলও করেছেন তারা। এভাবে পাঠাগারটিকে তারা সামাজিক, সাংস্কৃতিকের পাশাপাশি রাজনীতি সচেতন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করেছে তারা।
তারই অংশ হিসেবে এ পাঠাগার থেকে রুমীর উত্তরসূরীরা সমাজের গতানুগতিক ধ্যানধারণা ভেঙে কখনো ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করে কড়াইলের পথে পথে। করোনাকালীন সংকটে, বন্যার সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। উচ্ছেদবিরোধী পোস্টার ছড়িয়ে দেয় মানুষের কাছে, কখনো বৃক্ষরোপণ করে।
ধর্ষণের ৪টি ঘটনায় পাঠাগারের তরফ থেকে প্রতিবাদ করে মামলা করতে গেলে থানা থেকে তা নিতে না চাইলেও তাদের প্রচেষ্টায় পুলিশ মামলা নিতে বাধ্য হয়। ওয়ান স্টপ ক্রাইসিসে অধিভুক্তি, ধর্ষণ প্রতিরোধে মিছিল, লিফলেট বিলি করা এ পাঠাগারের ছেলেমেয়েরাই করেছে।
পাঠাগারের সদস্য ও নারী অধিকারকর্মী ফারজানা আক্তার মালা জানান, 'আমরা মূলত যৌন হয়রানি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে ভুক্তভোগী ও অভিভাবকদের সহায়তা করে থাকি নানাভাবে নির্দেশনা দিয়ে। আমরা ঐ পরিবেশ তৈরি করেছি, যেন যেকোনো ভুক্তভোগী তার কথাগুলো আমাদের নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। আমরা ওদের খারাপ স্পর্শ বা এ ধরনের বিষয়গুলো সম্পর্কে সবসময় সচেতন করার চেষ্টা করি। আমাদের ছেলেমেয়েরা এসব বিষয়ে সচেতন।'
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মশাল জ্বলেছিল কড়াইলেও, সে তেজ ছড়িয়ে পড়ার পেছনে পাঠাগারের 'রুমীরাও' ভূমিকা রেখেছে। পাঠাগারের সদস্য রাব্বি জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নিতে গিয়ে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়।
কথা হয় পাঠাগারের অন্যতম পুরোনো সদস্য এবং জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া হাসানের সঙ্গে। হাসান ২০১৫ সাল থেকে এ পাঠাগারে আসে। এ লাইব্রেরি তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষে পরিণত করেছে বলেই মনে করে সে। লাইব্রেরির পক্ষ থেকে কড়াইলে আগুন লাগার সময় কাজ করা, করোনার সময় কাজ করাসহ নানা কাজে অংশ নিয়েছে হাসান।
নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে সে বলছিল, 'আমরা মহাখালী, বাড্ডা এবং আশেপাশের এলাকায় নিয়মিত অংশ নিতাম অনেকেই। কড়াইলের সাধারণ মানুষও অনেকেই আন্দোলনে যেতেন। আমাদের মধ্যে থেকে রাব্বি গুলি খেয়েছে, আমাদের আরেকজন রাবার বুলেটে আহত হয়। আমি বা আমরা কোনো স্বীকৃতি বা কিছুর জন্যই এগুলো করি নাই। আমি যা পাওয়ার ৫ তারিখেই পেয়ে গেছি। ঐদিনের মতো শান্তি আমি আর পাই নাই।'
পাঠাগারের অর্থায়ন সম্পূর্ণ এর সদস্য এবং কড়াইলের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাওয়া গণ-তহবিল ও শুভানুধ্যায়ীদের থেকে পাওয়া অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। অর্থ সংকটে পড়লে এর সদস্যরাই কড়াইলের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে পাঠাগারের জন্য।
২০২১ সালে সরকারি নিবন্ধন পাওয়ার পর থেকে পাঠাগারটি মাত্র একবার বার্ষিক ৪৬ হাজার টাকা পায়। যার মধ্যে ২৩ হাজার টাকার বই আর বাকি ২৩ হাজার টাকা নগদ। তবে সদস্যদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তারা কোনো এনজিও থেকে অনুদান নেয়নি। শুধু করোনা-পরবর্তী সময়ে ঘরভাড়া বাবদ কিছু টাকা তারা পেয়েছে। তারা চাইছে কড়াইলের ভেতরে পাঠাগারের জন্য একটা স্থায়ী জায়গা নিতে।
কথা হলো পাঠাগারের কচিকাঁচা সদস্যদের সঙ্গে। একদম ছোট্টদের থেকে শুরু করে একটু বড়, সবাই আসে। পাঠাগার ওদের মন ভালো করার জায়গা, একটুখানি ইচ্ছেমতো বাঁচার জায়গা। ওরা বই পড়ে, চ্যাপলিনের সিনেমা দেখে।
সদস্যদের আছে নিজেদের টিম। টিমের নামগুলো শুনলেই বোঝা যায়, শহীদ রুমী পাঠাগার ওদের কতটা আলোকিত করছে। হেনরি লুই, ভিভিয়ান ডি রোজিও, ভগত সিং, নজরুল, রোকেয়া, নেতাজি, প্রীতিলতাদের নামে রয়েছে একেকটি দল।
লাইব্রেরির নিয়মিত সদস্য মেহেদি হাসান সানি বলে, 'লাইব্রেরি আমাদের কাছে আমাদের মন ভালো করার জায়গা। আমরা আমাদের মন খারাপ থাকলেও সে কথা ভুলে যাই। আমাদের সঙ্গে ওনারা কখনও খারাপ ব্যবহার করেন না। দিনে একবার হলেও আমরা আসি, বই পড়ি, গান গাই, আমাদের নিজেদের জগত এটা। এখানকার অনেক বই-ই আমাদের পড়া।'
আরেক সদস্য হনুফা জানায়, 'লাইব্রেরি থেকে আমি আমার আশপাশের মেয়েদের থেকে চিন্তাভাবনার দিক থেকে অনেক এগিয়ে যেতে পেরেছি। আমাদের এখানে মনে করা হয়, মেয়েরা সবসময় ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ শিখবে, বাইরে যাবে না। আমি এখন প্রশ্ন করতে পারি যে কেন মেয়েদের ঘরেই থাকতে হবে, কেন মেয়েরা বাইরে যেতে পারবে না, মেয়েদের তো সে অধিকার আছে। আমি অনেকটাই নিজের প্রতি যেকোনো হয়রানি প্রতিরোধে সচেতন।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাটমণ্ডল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় শহীদ রুমী স্মৃতি পাঠাগারের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান 'দশক'। যেন নিজেদের ১০ বছরের অন্যায় অনচারের বিরুদ্ধে বাতিঘর হয়ে ওঠার যাত্রাকেই তারা তুলে ধরলেন এ আয়োজনে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা শহরের অন্যান্য অনেক পাঠাগারের সম্পাদকেরাসহ অনেক সুধীজন।
মঞ্চে চলছিল মূকাভিনয়। কোনো শব্দ নেই, কোনো কথা নেই, কিন্তু উপস্থিত সবাই যেন জানে কী ঘটছে। মঞ্চে ফুটে উঠেছে চেনা জুলাইয়ের কাহিনি—স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গল্প। চরিত্রে জীবন্ত হয়ে ওঠেন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, এবং রিয়া গোপ। একক অভিনয়ে তুলে ধরা হয়েছিল এক শহীদের বাবার দুঃখগাথা।
যদিও অনুষ্ঠানজুড়ে ছিল নাচ, গান, ও আবৃত্তি, তবুও মূকাভিনয় আর একক অভিনয়ই ছিল প্রধান আকর্ষণ। এ অংশে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না, প্রস্তুতির যথাযথ সুযোগও ছিল না, তবুও প্রতিটি উপস্থাপনাই ছিল নিখুঁত ও শক্তিশালী।
মূকাভিনয় ও একক অভিনয়ে প্রধান চরিত্রে ছিলেন আহসান হাবীব। দাবা খেলার সাথী খুঁজতে এসে পাঠাগারে তার প্রথম আগমন। সেখান থেকেই নিজের অভিনেতা সত্ত্বাকে আবিষ্কার করেন আহসান।
এখন তার স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এবং একজন অভিনেতা বা চিত্রশিল্পী হওয়ার। আন্দোলনের অংশীদার আহসান জানায়, 'আমরা এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, যেখানে শোষণ ও বৈষম্যের স্থান নেই। কিন্তু আমরা কতটা সে আদর্শ ধারণ করতে পেরেছি, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। নতুন কিছু আনতে হলে প্রয়োজন পুরোনো ধ্যানধারণার সংস্কার।'
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পাঠাগার সুহৃদ মানজুর আল মতিন। তিনি বলেন, 'যারা গোপনে থেকে মানুষ তৈরি করেন, তারা হলেন এ শহীদ রুমী স্মৃতি পাঠাগারের মানুষগুলো। ওরা গত ১০ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে গেছে, সমাজে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা এ সংগ্রাম অব্যাহত রাখবেন।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প 'তোতাকাহিনী' অবলম্বনে তৈরি নাটক দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। নাটকের নির্দেশক মো. রিয়াদ শহীদ রুমী স্মৃতি পাঠাগারের পুরোনো সদস্য। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে প্রথম স্থান পেয়েও র্যাগিং বিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি সেচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন।
রিয়াদ জানান, 'ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল। তবে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়া একজন ছেলের পক্ষে বই কেনা সম্ভব ছিল না। একদিন বন্ধুদের মধ্যে একজনের কাছে শুনলাম কড়াইলে একটি পাঠাগার আছে, যেখানে অনেক গল্পের বই রয়েছে। সত্যিকার অর্থে গল্পের বই!
'অনেক আগ্রহ নিয়ে হাজির হলাম শহীদ রুমী স্মৃতি পাঠাগারে। এটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। দীর্ঘ আট বছরে আমি অনেক কিছু শিখেছি, এখনও শিখছি। আজ আমি যা কিছু অর্জন করেছি, তার বারো আনাই পাঠাগারের বদৌলতে, বাকি চার আনা আমার মায়ের। পাঠাগার আমাকে শিখিয়েছে ভালোবাসতে—মানুষকে, দেশকে, পৃথিবীকে।'
নিজের নাটকের থিম সম্পর্কে রিয়াদ বলেন, 'আমি সহজ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের মূল থিমটিকে উপস্থাপন করেছি। তবে আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের দেখানো পরিসমাপ্তির ধ্বংসাবশেষ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন সৃষ্টির উদ্ভাস দেখাননি। আমি সে সৃষ্টির উন্মেষ দেখাতে চেয়েছি; দেখাতে চেয়েছি, এক পাখির মৃত্যুতে সব শেষ হয়ে যায় না, বরং আরও পাখিরা জেগে ওঠে, তারা প্রশ্ন করে—স্বাধীনতা ছাড়া শিক্ষা কেমন হয়?'
'এমন যদি হতো- আমি একটা পাখি!/ পাখির চোখে দেখি– আকাশ-মাঠ/ আধাঁর কেটে ভোর/ সূর্য উঠে রাঙা–/ বন্ধু, আমি পাখি হলেও/ আমার একটা ডানা ভাঙা... আহারে...'
নাটকের শেষদিকে গানের এ কথাগুলো শুনতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো, বাংলাদেশের বহু মানুষ ভুলে যায় কড়াইলের মানুষের দিকে চোখ মেলে তাকানোর কথা, অথবা যেন তাকাতে চাইছে না।
কড়াইলে কোনো সরকারি উদ্যোগে স্কুল, পাঠাগার নেই। ওরা যেন চিৎকার করে জানান দিচ্ছে, ওদের একটা ডানা ভাঙা, আর আমরা যেন আহারে বলেই দায় সারছি। তবুও শহীদ রুমী স্মৃতি পাঠাগারের মতো উদ্যোগ যেন আগুনপাখি হয়ে বারবার ওদের জীবন্ত করার লড়াই করে যাচ্ছে।