চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যায় কারা জড়িত?
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজনদের মধ্যে ৩ জনকে শনাক্ত করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)।
চট্টগ্রামের আদালতে ইসকন নেতা চিন্ময় প্রভুর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সংঘঠিত এ হত্যাকাণ্ডের কিছু ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে।
আইনজীবী সাইফুলকে যে গলিতে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে সে সময় অন্যান্যদের মধ্যে এই ৩ জনকে দেখা যাচ্ছে— এমন একটি ছবি গতকাল (২৭ নভেম্বর) প্রকাশ করে টিবিএস।
তাদের মধ্যে একজন হলেন, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শুভ কান্তি দাশ। আরেকজনের নাম জিয়া উদ্দিন ফাহিম। তিনি বাকলিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ ও স্থানীয়রা।
এছাড়া, রাজীব ভট্টাচার্য ওরফে সুমন দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের এক নেতার অনুসারী এবং একটি শিপিং কোম্পানির কর্মচারী বলে জানা গেছে।
হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কোতোয়ালী পুলিশ গ্রেপ্তারকৃত ৮ জনের মধ্যে তিনিও রয়েছেন। অন্য ৭ জন হলেন— রুমিত দাশ, সুমিত দাশ, গগন দাশ, নয়ন দাশ, বিশাল দাশ, আমান দাশ ও সনু মেতর।
টিবিএসের প্রকাশিত ছবিতে, রাজীবকে হেলমেট পরা অবস্থায় দেশীয় অস্ত্র হাতে ধরে থাকতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা শাখার একটি দল গতকাল সন্ধ্যায় তাকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে। বিষয়টি এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন সিএমপির উপ-কমিশনার (অপরাধ) মোহাম্মদ রইস উদ্দিন।
গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা জানান, অন্যান্য সন্দেহভাজনদের ধরতে তারা রাজীবকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালাবেন। পরে তাকে কোতোয়ালী থানায় হস্তান্তর করা হবে।
অন্যদিকে, শুভকে একজন ইসকন সমর্থক বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে তাকে বহিষ্কার করে বিবৃতি দিয়েছে বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তবে, আইনজীবী হত্যায় শুভ ও রাজীবের জড়িত থাকার বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত করলেও ফাহিমের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আরও যাচাই-বাছাই প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, ছবিতে চিহ্নিত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন— মেথর পট্টি এলাকার সুমন ডান্ডি, কোতোয়ালীর হাজারী গলির বিকাশ দে, কোতোয়ালীর জলসা মার্কেটের নারায়ণ চক্রবর্তী এবং বন্দর এলাকার নিমতলার মন্টু দে।
তবে, টিবিএস স্বাধীনভাবে তাদের সবার পরিচয় যাচাই করতে পারেনি।
কোতয়ালী এলাকার বাসিন্দা রানা বামন বলেন, যারা হামলায় অংশ নিয়েছে, তাদের অধিকাংশই পাথরঘাটা এলাকার গঙ্গাবাড়ির বাসিন্দা।
কোতোয়ালীর একজন সহকারী উপ-পরিদর্শক জানান, থানার একটি দল বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে শনাক্ত করতে কাজ করছে।
ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের সংগ্রহ করা ভিডিওতে দেখা যায়, ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল আইনজীবী আলিফকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করছে। কেউ তাকে মারছে, আবার কেউ অস্ত্র দিয়ে আঘাত করছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, হেলমেট পরা দুই যুবক সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর আলিফ কোপাচ্ছে। এ সময় ভুক্তভোগী আইনজীবী মাটিতে লুটিয়ে পড়া সত্ত্বেও তারা তাকে নির্মমভাবে মারধর করতে থাকে তারা।
শুভর ছাত্রত্ব সাময়িক বাতিল
এদিকে, চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর শুভ কান্তি দশের ছাত্রত্ব সাময়িকভাবে বাতিল করেছে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. এস এম শোয়াইবের সই করা এক নোটিশে বলা হয়, বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ডেপুটি রেজিস্ট্রার সালাউদ্দিন শাহরিয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গতকাল চট্টগ্রামে একজন আইনজীবী হত্যার ঘটনায় ওই শিক্ষার্থী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ সংক্রান্ত তথ্য–প্রমাণ আবেদন করেন।"
"সেটি বিবেচনা করে আইন বিভাগের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তার ছাত্রত্ব বাতিল করে," বলেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শুভর এক সহপাঠী দাবি করেন, শুভ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে হিন্দু নেতার সমর্থনে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট করতেন।
যদিও গতকাল তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পাওয়া গেছে।
গ্রেপ্তার আরও ২০ জন
ঘটনার ফুটেজ দেখে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি, কোতোয়ালী থানার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটক করা আরও ২০ জনকে পুলিশের ওপর হামলার আভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফজলুল কাদের বলেন, মঙ্গলবার আদালত চত্বর, রঙ্গম সিনেমা হলের গলি ও কোতোয়ালীর মোড়ে তিন দফায় পুলিশের সঙ্গে চিন্ময় প্রভুর সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় রঙ্গম সিনেমা হলের গলিতে সাইফুল ইসলাম আলিফ নামের এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করে কিছু বিক্ষোভকারী।
তিনি বলেন, "পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা, আদালত প্রাঙ্গণে ভাংচুরের ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।"
তিন মামলায় ১,১০০-১,২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
গতকাল রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিহতের স্বজনরা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করেননি।
এদিকে, ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত হওয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৭ আসামিসহ মামলাগুলোতে আটক মোট ২৭ জনকে গতকাল সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
যেভাবে খুন হন আইনজীবী আলিফ
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী আলিফকে বিক্ষোভকারীরা কোপায়। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক আলিফকে মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে, একইদিন দুপুরে জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগে রাষ্টদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় ইসকন সর্মথকরা বাধা দেন।
তারা চিন্ময়কে বহনকারী প্রিজনভ্যানটি ঘেরাও করে আটকে রাখেন। পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে চাইলেও তারা পথ অবরোধ করে রাখেন। প্রিজনভ্যানটির চাকাও পাংচার করে দেন তারা। পরে সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিচার্জ করে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এ সময় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।
হামলা ও ভাংচুরের প্রতিবাদে আলিফসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী মিছিলে অংশ নিয়ে বান্দিল রোডের দিকে চলে যান। এ সময় অস্ত্রধারীরা তাদের ধাওয়া দেয়।
এ সময় অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, আলিফ হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। তখন তাকে মারধর ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী আরও কয়েকজন জানান, আলিফকে আদালতের মূল ফটকের প্রবেশমুখের বিপরীতে রঙ্গম কনভেনশন হলের পাশের গলি থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে তারাও এই গলিতেই অবস্থান নেন। মূলত এই গলি মেথর পট্টি হিসেবে পরিচিত। এখানে পরিচ্ছন্নকর্মীরা বসবাস করেন, যারা বেশিরভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এই গলিতে অবস্থান নেওয়া বিক্ষোভকারীদের হাতে দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র দেখা গেছে।