১২ লাখ বছরের প্রাচীন বরফ তুলে আনা হলো অ্যান্টার্কটিকা খুঁড়ে; বরফ যুগের রহস্যভেদের আশা
সম্প্রতি অ্যান্টার্কটিকার গভীর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে ১২ লাখ বছর বয়সি বরফ। এটিই সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম বরফ।
মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাজ করে বিজ্ঞানীরা ২.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি বরফের সিলিন্ডার বা 'শাঁস' সংগ্রহ করেছেন। বরফের এই সিলিন্ডার দৈর্ঘ্যে আটটি আইফেল টাওয়ারের সমান।
এই বরফের ভেতরে জমাটবদ্ধ অবস্থায় প্রাচীন বায়ুর ছোট ছোট বুদ্বুদ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই বুদ্বুদগুলো আমাদের গ্রহের জলবায়ু ইতিহাসের এক জটিল রহস্য সমাধানে সাহায্য করবে।
ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা চারটি অ্যান্টার্কটিক গ্রীষ্মজুড়ে কাজ করে এই বরফ খুঁড়ে বের করেছেন। জমাট বরফের নিচের পাথরস্তরে পৌঁছানোর জন্য তাদের প্রতিযোগী ছিল আরও সাতটি দেশ।
৯ লাখ থেকে ১২ লাখ বছর আগে বরফ যুগের হিমবাহ চক্রে ব্যাঘাত ঘটার সময় ঠিক কী ঘটেছিল, এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ সেই রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করতে পারে। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, বরফ যুগের সেই ঘটনায় মানুষের পূর্বপুরুষরা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
এই গবেষণার সমন্বয়ক অধ্যাপক কার্লো বারবান্তে বলেন, 'এটা এক অসাধারণ অর্জন। আপনার হাতে মিলিয়ন বছরের প্রাচীন এক বরফখণ্ড ধরা। কখনও কখনও এর মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ছাইয়ের স্তর দেখা যায়। দেখা যায় ছোট ছোট বুদ্বুদ। এক মিলিয়ন বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরদের নিশ্বাসের বুদ্বুদ এগুলো।'
ইতালির পোলার সায়েন্স ইনস্টিটিউটের নেতৃত্বে ইউরোপের ১০টি দেশ এই প্রকল্পে অংশ নেয়।
নিকটস্থ গবেষণা কেন্দ্র থেকে ড্রিলিং যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি ও ক্যাম্প প্রায় ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্নোমোবিলে পরিবহন করতে হতো দলটিকে।
তাদের ড্রিলিং সাইট 'লিটল ডোম সি' অ্যান্টার্কটিকা মালভূমির পূর্ব প্রান্তে, প্রায় ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
বিজ্ঞানীদের জলবায়ু পরিবর্তন বোঝার জন্য বরফের 'শাঁস' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বরফের এসব সিলিন্ডার বাতাসের বুদ্বুদ ও কণা ধরে রাখে। এসব দেখে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ও তাপমাত্রার পরিবর্তনের রেকর্ড জানা যায়। এ থেকে সময়ের সঙ্গে জলবায়ুর অবস্থা কীভাবে বদলেছে, তা বিশ্লেষণ করতে পারেন বিজ্ঞানীরা।
অন্যান্য বরফ শাঁস কোর—যেমন এপিকা—থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, বর্তমানে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ফলে তাপমাত্রার যেভাবে বাড়ছে, তার কারণ মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো।
তবে বিজ্ঞানীরা আরও অতীতের রহস্য উদঘাটনে আগ্রহী ছিলেন।
'বিয়ন্ড এপিকা: ওল্ডেস্ট আইস' নামক বর্তমান প্রকল্পটির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সম্ভবত অতীতের আরও ৪ লাখ বছরের ইতিহাস পেয়ে গেছেন।
অধ্যাপক কার্লো বারবান্তে বলেন, আমাদের ভবিষ্যতের অনেকটা লুকিয়ে আছে অতীতে। জলবায়ুর কার্যপ্রণালী ভালোমতো বুঝতে এবং ভবিষ্যতের জলবায়ু কেমন হবে, তার পূর্বাভাস দিতে অতীত বিশ্লেষণ করেন বিজ্ঞানীরা।
ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের বিজ্ঞানী ড. রবার্ট মুলভ্যানি জানান, আগের রাডার ডেটার চেয়ে আরও গভীরে খনন করতে সক্ষম হন তারা।
শাঁসটি ধীরে ধীরে ড্রিল মেশিন ব্যবহার বরফের আচ্ছাদন থেকে উত্তোলন করা হয়। বিজ্ঞানীরা কাপড় ব্যবহার করে বরফটি সাবধানে পরিষ্কার করেন।
মাইনাস ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় অ্যান্টার্কটিকা থেকে জাহাজে পরিবহন করর জন্য বরফটি এক মিটার লম্বা অংশে টুকরো টুকরো করে কাটা হচ্ছে।
বরফের টুকরোগুলোর স্থান হবে ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফ্রিজারে। বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ শুরু হবে কেমব্রিজের ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে-তে।
বিজ্ঞানীরা মূলত ৯ লাখ থেকে ১২ লাখ বছর আগের গুরুত্বপূর্ণ সময় 'মধ্য-প্লাইস্টোসিন রূপান্তর' নিয়ে গবেষণা করছেন।
এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত না থাকা ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক জোয়েরি রোজেলজ বলেন,
'তারা কী খুঁজে পাবেন, তা ধারণা করা কঠিন। তবে তাদের প্রাপ্ত তথ্য যে আমাদের গ্রহের অতীত সম্পর্কে জানার পরিধি আরও বাড়াবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।'