আরাকান আর্মির উত্থানে কোন পথে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি
আরাকানে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব প্রশ্ন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিপর্যস্ত সমরনীতি ও রাজনৈতিক কৌশল এবং আরাকান আর্মির উত্থান মিলিয়ে পুরো অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন সয়ে আসা রোহিঙ্গারা আজ বড় এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছেন।
অন্যদিকে, আরাকান আর্মি (এএ) যেমন রাখাইন জনগণের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে অস্ত্র ধরেছে, তেমনি স্থানীয় ক্ষমতা দখলে নিয়ে গড়ে তুলছে বিকল্প প্রশাসনিক কাঠামো। বাংলাদেশও এ সংকটে সরাসরি জড়িত, কারণ কমপক্ষে ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে এবং তাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে ঢাকা সরকার বহুমুখী চাপে রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রসঙ্গের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ কীভাবে সম্পর্ক গড়তে পারে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গা নাগরিকত্বের বিষয়টি ইতিহাসের উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িত। ঔপনিবেশিক যুগের শেষাংশে ও স্বাধীন মিয়ানমারের শুরুর দিনগুলোতে রোহিঙ্গারা অন্তত কাগজে-কলমে নাগরিকের স্বীকৃতি পেয়েছিল। ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে তাদের অধিকার সংকুচিত হতে থাকে; ১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বঞ্চনার পথ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এভাবে তারা রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
অথচ বহু বিশেষজ্ঞের মতে, রোহিঙ্গারা ঐতিহাসিকভাবেই মিয়ানমারের নাগরিক। সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফেরতের ইঙ্গিত দিলেও এটি কতটা আন্তরিকতা বা বাস্তবতার ছোঁয়া পাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। বিশেষত, আরাকান আর্মির অগ্রযাত্রা ঠেকাতে বা তাদের ক্ষমতার পরিসর কমাতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কৌশলগত বোঝাপড়া স্বল্প-মেয়াদি একটি পথ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অতীতে এমন বহু প্রতিশ্রুতি গড়ে উঠলেও শেষমেশ তা বাস্তবায়িত হয়নি।
অন্যদিকে, আরাকান আর্মি দাবি করে, তারা রাখাইন জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়ে যাচ্ছে। তবে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আরাকান আর্মির পতাকায় রাখাইনের ৭টি জনগোষ্ঠীর প্রতীকী তারকা থাকলেও সেখানে রোহিঙ্গাদের উল্লেখ নেই। সাম্প্রতিক অপারেশন ১০২৭-এর সময় তারা রোহিঙ্গা এলাকায় চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুটের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মির ওপর আস্থাহীন হয়ে পড়েছে; বরং কোণঠাসা সামরিক জান্তার কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পেয়ে রোহিঙ্গাদের একাংশ এখন আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে সেখানে শুধুই 'রোহিঙ্গা বনাম জান্তা' বা 'রোহিঙ্গা বনাম রাখাইন' সংঘাত নেই; বরং রোহিঙ্গা বনাম আরাকান আর্মির দ্বৈরথ আরও গভীর হয়ে উঠেছে— যা মিয়ানমার সামরিক কর্তৃপক্ষের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' কৌশলেরই একটি অংশ বলে অনেকে মনে করছেন।
অবশ্য আরাকানে সামরিক শক্তির এই পালাবদলে আরাকান আর্মি মাঠপর্যায়ের বাস্তব নিয়ন্ত্রণকারীতে পরিণত হচ্ছে বলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সূত্র জানিয়েছে। তারা পলেটও (পলেটও শহর), মংডু, বুতি ডাং, ইয়াথেথং, পুণন্যাক্যুন, কিয়কতাও, মিনবিয়া, এমেইবুন, পকতো, ইয়ানবেউ, রামব্রি, থান্টউই, গওয়া, পাউকতওসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নগর ও শহরতলি দখলে নিয়ে 'আরাকান পিপলস্ রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্ট' বা ইউএলএ গঠন করেছে। ইতোমধ্যে তারা সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি স্বাস্থ্য, প্রশাসন, শিক্ষা ও পুনর্গঠন ইত্যাদি নানান কাজে হাত দিয়েছে।
বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বা গোষ্ঠীতে তারা ওষুধ ও চিকিৎসা প্রদান করছে, স্থানীয় জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছে, এমনকি বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ি পুনর্নির্মাণেও সাহায্য করছে। এ অবস্থায় বোঝা যায়, রাখাইন জনপদের বড় অংশ এখন কার্যত আরাকান আর্মির দখলে।
এই প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বাংলাদেশের সীমান্ত-সংলগ্ন স্থানে রোহিঙ্গা পরিচয়ে গড়ে ওঠা একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কিছু রোহিঙ্গা চরমপন্থী গোষ্ঠী (যেমন এআরএসএ, আরএসও, এআরএ) সীমান্ত পেরিয়ে আরাকানের অভ্যন্তরে হামলা, অপহরণ ও বিভিন্ন সহিংস কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর ফলে সাধারণ রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (যেমন— প্রান্তিক ম্রো, খুমি বা অন্যান্য নৃগোষ্ঠী) আরও বিপাকে পড়ছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে অনেক রোহিঙ্গাই রাখাইনে ফিরে যেতে দুশ্চিন্তা করছে, কারণ সশস্ত্র সংঘাত ও সহিংসতা এখন বহুমুখী রূপ নিয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আরাকান আর্মি এখনো আনুষ্ঠানিক অবস্থান নিতে নারাজ। তারা স্পষ্ট বলছে, এটি সামরিক নয়—রাজনৈতিক বিষয়। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরই তারা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তাদের ধারণা, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দূরে আরাকানের পূর্বাঞ্চলে সরিয়ে নিয়ে সেখানে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা হবে, যেখানে রোহিঙ্গারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করবেন। তবে যারা জান্তাপন্থী সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠী হিসেবে শনাক্ত হবেন, তাদের নির্মূল বা বিচারের আওতায় আনা হবে।
এদিকে স্বাধীনতা ঘোষণার পথেও তারা এগোতে চান, তবে ভারত বা চীনের স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গভীর জটিলতা বাড়ানোর ঝুঁকি তারা এড়াতে চান। তাই প্রথম পছন্দ হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হয়েছে, যদিও এখনও তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের 'মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে' বলে আরাকান আর্মি দাবি করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অর্ধেকের বেশি সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্য পালিয়ে এসে আরাকান আর্মিতে যোগ দিয়েছেন। টঙ্গু ও ইরাওয়াদী অঞ্চলে বড় দুটো অস্ত্র কারখানা আর থান্ডওয়ে নৌঘাঁটি থেকে জাহাজ ও গোলাবারুদ দখলে নেওয়ার মাধ্যমে আরাকান আর্মি কোস্ট গার্ড পর্যন্ত গঠন করেছে। এখন সীমান্ত রক্ষায় তারা স্থলভিত্তিক বর্ডার গার্ড ফোর্স গঠনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে— যেখানে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রাখাইন তরুণদের কাছ থেকে হাজার হাজার সিভি জমা পড়েছে। মূলত ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষায় এ বাহিনী মোতায়েন করা হবে, আর বাকি সীমান্ত পাহারা দেবে নিয়মিত বাহিনী।
বাংলাদেশের জন্য এই প্রেক্ষাপটে বড় প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরাকান আর্মির কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা আপাতত পাওয়া যাবে না। তাদের অবস্থান হলো, রাখাইনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হাতে এলে তারা নিজেরাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নিয়ম-কানুন ঠিক করবে। অথচ বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে।
বাস্তবতা হলো, সামরিক সরকার হয়তো কথায় কথায় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে রাখাইনের বড় অঞ্চলে এখন তাদের ক্ষমতা সীমিত। সুতরাং পরিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে গেলে বাংলাদেশকে আরাকান আর্মির সঙ্গেও একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। কারণ সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ও মাদক-চোরাচালান ঠেকানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে এখন আরাকান আর্মিই প্রভাবশালী শক্তি।
এদিকে, আঞ্চলিক পরাশক্তি চীন ও ভারতের নানা স্বার্থ রাখাইনে জড়িয়ে আছে। চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, পাইপলাইন ও অন্য বিনিয়োগ আর ভারতের 'কালাদান প্রজেক্ট' রাখাইন দিয়ে বিস্তৃত হওয়ায় পরাশক্তিগুলোও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, বাংলাদেশ যদি শুধু সামরিক সরকারের ওপর নির্ভর করে থাকে, তাহলে হয়তো দীর্ঘমেয়াদে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনা হচ্ছে যে, রাখাইনে গড়ে ওঠা নতুন প্রশাসনিক কাঠামো বা 'আরাকান পিপলস্ রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্ট' ভবিষ্যতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে উঠতে পারে। তখন তাদের স্বীকৃতি ও স্বার্থ নিয়ে বড় ধরনের কূটনৈতিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
সব মিলিয়ে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললেও এ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। রোহিঙ্গা-রাখাইন দ্বন্দ্বের সঙ্গে এখন আরাকান আর্মির বিকাশ, সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর অপতৎপরতা এবং পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ মিলে এক দুঃসহ চক্র তৈরি করেছে। বাংলাদেশকে তাই একতরফা কোনো প্রত্যাশায় না থেকে বাস্তব মাঠপর্যায়ের শক্তিগুলোর সঙ্গে (বিশেষ করে আরাকান আর্মি) যোগাযোগ স্থাপন ও সম্পর্কের নতুন বলয় গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে। রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব প্রশ্নে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ ও সমন্বয় বাড়ানো যেমন দরকার, তেমনি আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে আপাতত রোহিঙ্গা ইস্যু কিছুটা পাশ কাটিয়ে হলেও কার্যকর যোগাযোগ বজায় রাখতে হবে। আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক অবস্থানে দেখা গেছে, তারা আরও বিস্তৃত অঞ্চল ও প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে মরিয়া, পাশাপাশি ভারত-চীনের মতো শক্তির বিরাগভাজন না হয়ে বাংলাদেশকেও গুরুত্ব দিতে চায়। এই বাস্তবতায়, সীমান্ত ও নিরাপত্তা-সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-আরাকান আর্মির মধ্যে একধরনের গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠলে উভয় পক্ষই উপকৃত হতে পারে।
সর্বোপরি, আরাকান আর্মির উত্থান রাখাইনে গতি-প্রকৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং সামরিক জান্তাও এখন চাপে পড়েছে। কোথাও রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি আস্থা রেখে তাদের ব্যবহার করছে, আবার কোথাও রোহিঙ্গা তথা সাধারণ মানুষকেও দমন করছে। বিপরীতে, আরাকান আর্মি এই চাপ ও দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে এবং মানুষের আস্থা অর্জনে স্বাস্থ্যসেবা, পুনর্গঠন, নিরাপত্তার মতো কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ সামগ্রিক সংকট সমাধান দীর্ঘসূত্রতার দিকে যেতে পারে। বাংলাদেশকে অবশ্যই এই জটিল সমীকরণে সংযম, দূরদৃষ্টি ও বাস্তবমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমারে তাদের নাগরিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত লক্ষ্য ঠিক রেখেও, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আরাকান আর্মির সঙ্গে একটি সাময়িক সুসম্পর্কই আঞ্চলিক অস্থিরতা হ্রাসে কার্যকর হতে পারে। ভবিষ্যতে শক্তি ও ক্ষমতার ভারসাম্যের আর কোনো বড় রদবদল হলে বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই অপ্রস্তুত না থাকে, সেটাই এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।