নিজের সিনেমা দেখেন না, খ্যাতিকে এড়িয়ে চলেন, জিতেছেন দুটি অস্কার, কে এ অভিনেতা!
"আমি মনে করি আমি একজন ভালো মানুষ। আমি সবসময় সঠিক কাজ করার চেষ্টা করি।" এভাবেই নিজের পরিচয় দেন । নিউ ইয়র্কের মাউন্ট ভার্ননে জন্ম নেওয়া এই অভিনেতা সম্প্রতি তার ৭০তম জন্মদিন পালন করেছেন। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় চালিয়ে যাওয়া এই তারকা তার প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পরিচিত। দশক পরিবর্তনের সাথে সাথে ওয়াশিংটন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছেন। সিনেমা ও ব্রডওয়েতে তার ঐতিহ্য আরও বিস্তৃত করতে তিনি তার পঞ্চম নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য প্রস্তুত।
ওয়াশিংটন তার 'গ্ল্যাডিয়েটর ২' সিনেমার আবারো খবরের শিরোনামে এসেছেন। এটি ২০০০ সালের 'গ্ল্যাডিয়েটর' সিনেমার সিক্যুয়েল। সিনেমায় তার সাথে পল মেস্কাল এবং পেদ্রো পাসকেলও অভিনয় করেছেন। ছবিটির প্রচারে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে দর্শকরা তার চরিত্রের পেছনের মানুষটি সম্পর্কে নতুন ধারণা পেয়েছেন এবং তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নতুন দিক জানতে পারছেন।
নভেম্বরে 'এসকোয়ার' ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক খোলামেলা প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন তার অতীতের মদ্যপানের সমস্যার কথা বলেন। তিনি বলেন, "ওয়াইন আমার পছন্দ ছিল। আর এখন আমি ৪ হাজার ডলারের দামি বোতল খুললাম, কারণ আর কিছু ছিল না।"
তিনি জানান, গত ১০ বছর ধরে তিনি মদ্যপান থেকে বিরত আছেন এবং ৬০ বছর বয়সে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। "আমি শরীরের অনেক ক্ষতি করেছি," তিনি বলেন। তবে এখন তিনি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী। ডেনজেল বলেন, "এটা শেষ অধ্যায়। যদি আরও ৩০ বছর পাই, আমি কী করতে চাই? আমার মা ৯৭ বছর বেঁচেছেন। আমি আমার সেরাটা দিচ্ছি।"
নিজের সফলতার অনেকটা কৃতিত্ব ডেনজেল তার মা লেনিস ওয়াশিংটনকে দিয়েছেন। তিনি নিউইয়র্কের মাউন্ট ভার্নন শহরে বড় হয়েছেন। সেখানে তিনি প্রায়ই খারাপ বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতেন। তার মা তার পথ পরিবর্তনের জন্য একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। লেনিস তার ছেলেকে একটি কঠোর সামরিক অ্যাকাডেমিতে পাঠিয়েছিলেন, যাতে ডেনজেলকে খারাপ বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে রাখা যায়।
তিনি বলেন, "আমি স্কুলে ভালো ফল করতাম, কিন্তু এক পা ছিল রাস্তায়। আমি ঠিক মনে করতে পারি না, তখন আমি মাদক বিক্রি করতাম কি না।" গ্রীষ্মকালে তিনি তার মায়ের আইসক্রিম পার্লারে কাজ করতেন। এটি তাকে অবৈধ কাজ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করত।
সামরিক অ্যাকাডেমিতে পড়ার সময়ই তিনি অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ খুঁজে পান। সেখানেই প্রথম থিয়েটার ও অভিনয়ের পাঠ নেন। তার বড় সুযোগ আসে টিভি সিরিজ 'সেন্ট এলসওয়ার'-এ (১৯৮২-১৯৮৮)। সেখানে তিনি একজন প্রিয় ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সিরিজের মাধ্যমেই হলিউডে তার যাত্রা শুরু হয়।
পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে ওয়াশিংটন একদিকে অ্যাকশন ছবি করেছেন। অন্যদিকে এমন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যা তাকে বড় বড় পুরস্কার এনে দিয়েছে। তিনি কখনো একই ধরনের চরিত্রে আটকে থাকেননি। তার কাজ তাকে যেমন আর্থিক সাফল্য দিয়েছে, তেমনই তার অভিনয়ের বৈচিত্র্য প্রমাণ করেছে। তিনি দুটি অস্কার জিতেছেন— 'গ্লোরি' (১৯৮৯) সিনেমার জন্য সেরা সহকারী অভিনেতার পুরস্কার এবং 'ট্রেইনিং ডে' (২০০১) সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার।
সবাই বলে, ডেনজেল ওয়াশিংটনের সব ছবি সফল। কিন্তু তিনি নিজে তা মনে করেন না। তিনি বলেন, "ম্যালকম এক্স-এর পর আমি কিছু খারাপ ছবি করেছি। নাম বলব না, তবে এগুলো ১৯৯০-এর দশকে। তখন শুধু রোজগারের দিকে মন দিয়েছিলাম। আমার অনেক দায়িত্ব ছিল।"
ওয়াশিংটন ব্যাখ্যা করেন, ১৯৯০-এর দশকে তার প্রধান লক্ষ্য ছিল পরিবার চালানোর জন্য টাকা উপার্জন করা। তিনি বলেন, "জীবন যদি ৯০ বছরের হয়, তবে ৩০ পর্যন্ত শেখা, আর ৩০ থেকে ৬০ পর্যন্ত রোজগার। সেই সময়টা ছিল রোজগারের। আমার একজন দারুণ এজেন্ট ছিল, যার সাহায্যে আমি টাকা উপার্জনে মনোযোগ দিয়েছিলাম।"
ভাল বা খারাপ হোক, সেই ছবিগুলোই তাকে বিশ্বের অন্যতম ধনী অভিনেতায় পরিণত করেছে। সেলিব্রিটি নেট ওর্থ অনুযায়ী, তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
ডেনজেল ওয়াশিংটন কখনো এক ধরনের চরিত্রে আটকে থাকেননি। তিনি সবসময় এমন কাজ খুঁজেছেন, যা তাকে নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ করে। তবে তার অভিনয়ে একটি ব্যক্তিগত নিয়ম রয়েছে— তিনি ঘনিষ্ঠ দৃশ্য বা অতি কম পোশাকের দৃশ্য এড়িয়ে চলেন। তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে গোপন রাখেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেও দূরে থাকেন। তার ইচ্ছে, মানুষ তাকে শুধু তার কাজের জন্য চিনুক।
সম্প্রতি ব্যক্তিগত জীবনের কারণে তার নাম আবার শিরোনামে এসেছে। ২১ ডিসেম্বর তার ৭০তম জন্মদিনের এক সপ্তাহ আগে তিনি একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নেন। ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে তিনি নিজের ধর্মীয় জীবনে নতুন করে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, "এতে সময় লেগেছে, কিন্তু আমি এখন এখানে।" এই অনুষ্ঠানে তার পরিবারের সদস্যরা তার পাশে ছিলেন।
ওয়াশিংটন তার জীবনের ভালোবাসা পাওলেটা পিয়ারসনকে প্রথম অভিনয়ের সময়ই দেখেন। ১৯৭৭ সালে 'উইলমা' সিনেমায় তাদের পরিচয় হলেও তাদের প্রেম শুরু হয় কিছু পরে। এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা আবার একত্রিত হন। তিনবার প্রস্তাবের পর তারা ১৯৮৩ সালে বিয়ে করেন। তাদের চার সন্তান—জন ডেভিড (৪০), কাতিয়া (৩৭), ম্যালকম (৩৩) এবং অলিভিয়া (৩৩)। তাদের মধ্যে জন ডেভিড ওয়াশিংটন সবচেয়ে পরিচিত, যিনি ২০২০ সালের 'টেনেট' সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
ওয়াশিংটন সবসময় সন্তানদের অভিনয়ের জন্য মঞ্চকেই সেরা স্থান মনে করেন। তিনি বলেন, "তোমাকে মঞ্চে নামতেই হবে, কারণ অভিনয় শেখা শুরু হয় সেখান থেকে। টিভি বা সিনেমায় অভিনয় শেখা যায় না।"
২০২২ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে যখন উইল স্মিথ ক্রিস রককে চড় মারেন, তখন ডেনজেল স্মিথকে প্রথম শান্ত করেন। তিনি স্মিথকে পরামর্শ দেন, "তোমার জীবনের সবচেয়ে উঁচু মুহূর্তে সাবধান থাকো, কারণ তখনই শয়তান তোমার দিকে আসবে।"
পরে এই ঘটনা নিয়ে ডেনজেল বলেন, "আমরা কিছু প্রার্থনা করেছিলাম। আমি আর কিছু বলতে চাই না। আমি জানি না পুরো বিষয়টি কীভাবে হয়েছিল। কিন্তু আমার মতে, একমাত্র সমাধান ছিল প্রার্থনা।"
এ বছরটি ডেনজেল ওয়াশিংটনের জন্য বেশ আশা জাগানো। আগামী ফেব্রুয়ারিতে তিনি ব্রডওয়েতে উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ট্র্যাজেডি 'ওথেলো'-তে অভিনয় করবেন, যেখানে তার সঙ্গে থাকবেন জেক ইলেনহল। ওয়াশিংটন আবার তার শিকড়ে ফিরছেন, কারণ ২২ বছর বয়সে তিনি প্রথম ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এখনও নাটক শুরু হতে কয়েক সপ্তাহ বাকি। তবু প্রায় সব টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গেছে, যদিও কিছু টিকিটের দাম এক হাজার ডলার পর্যন্ত।
আগামী দিনগুলো নিয়ে ডেনজেল ওয়াশিংটনের ভাবনা পরিষ্কার। পরিবারকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি কাজের মাধ্যমে আলোচনায় থাকতে চান তিনি, যতক্ষণ না বিদায় নেওয়ার সময় চলে আসে। আগস্টে এম্পায়ার-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "আমার আগ্রহ আছে এমন ছবি করার জন্য খুব বেশি সময় আর বাকি নেই।"