ট্রাম্পের দ্বিতীয় বাণিজ্যযুদ্ধ: বাংলাদেশের জন্য অপ্রত্যাশিত আর্থিক সুযোগ?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলে এর প্রভাব শুধু এ তিন দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বিশ্ববাজারেও তা নাড়া দেয়। ইউরোপীয় দেশগুলো ও জাপানও এ আক্রমণাত্মক বাণিজ্য নীতির প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রত্যাশিতভাবেই, শনিবার কানাডা ১০৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন পণ্যের ওপর পর্যায়ক্রমে পালটা ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। মেক্সিকো ও চীনও জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর একই ধরনের শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছে।
তবে এ বৈশ্বিক উত্তেজনার মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে।
সয়াবিন তেলের বাজারের কথা ধরা যাক। চীন যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা। যদি বেইজিং মার্কিন সয়াবিনের ওপর শুল্ক আরোপ করে, তাহলে ওই পণ্যের চাহিদা কমবে এবং স্বাভাবিকভাবেই দাম কমে যাবে। এতে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের জন্য সস্তায় সয়াবিন তেল সংগ্রহের সুযোগ তৈরি হবে। একই পরিস্থিতি কানাডার গম, ভোজ্যতেল ও রাসায়নিক পণ্যের ক্ষেত্রেও হতে পারে, যা বাংলাদেশকে কম দামে এসব পণ্য আমদানির সুবিধা দেবে।
তবে সবচেয়ে বড় সুফল আসতে পারে তৈরি পোশাক খাতে।
১০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চীনা পোশাকের দাম বাড়লে মার্কিন খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্প খুঁজবে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে।
শুল্ক বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে ভোক্তারা আরও কম দামের পোশাকের দিকে ঝুঁকতে পারেন—এ অবস্থায় বাংলাদেশ অন্যতম সেরা বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি, চীনা পোশাক কারখানাগুলো মার্কিন শুল্ক এড়াতে উৎপাদন বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে সরিয়ে নিতে পারে।
খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মার্কিন ক্রেতারা চীনের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও ভারতের দিকে ঝুঁকতে পারেন। এছাড়া, তুলাসহ পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যার বেশিরভাগই তৈরি পোশাক। বর্তমানে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারের ৯ শতাংশ শেয়ার ধরে রেখে চীন ও ভিয়েতনামের পর তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে।
পণ্য আমদানিতে সম্ভাবনা
মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তাসলিম শাহরিয়ার জানান, বিশ্বের ৩০ শতাংশ সয়াবিন উৎপাদন করে যুক্তরাষ্ট্র, যার সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন, তখন বাংলাদেশের জন্য মার্কিন সয়াবিন আরও সহজলভ্য হয়ে ওঠে। সে সময় বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম স্থিতিশীল ছিল এবং প্রতি জাহাজে আমদানির খরচ পড়ত ৮৮০-৯০০ ডলার।
"তবে বাইডেন প্রশাসনের সময় তিন বছরে সয়াবিনের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১,৫০০-১,৬০০ ডলারে পৌঁছায়," বলেন তিনি।
শাহরিয়ার আরও জানান, বাংলাদেশ কানাডা থেকে গম ও ভোজ্যতেল আমদানি করলেও সবসময় এসব পণ্য সহজলভ্য হয় না। "যদি যুক্তরাষ্ট্র কানাডার গম আমদানি কমিয়ে দেয়, তাহলে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। এতে কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা আরও কার্যকর বিকল্প বাজার হয়ে উঠবে।"
বাংলাদেশ মূলত কানাডা থেকে মসুর ডাল, ভোজ্যতেল, তৈলবীজ, সার, যন্ত্রপাতি, পেপারবোর্ড, স্ক্র্যাপ, অপটিক্যাল সামগ্রী, চিকিৎসা ও বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম আমদানি করে।
সিটি গ্রুপের পরিচালক (ব্যবসায়িক উন্নয়ন) লুৎফুল কবির শাহীন মনে করেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরিবর্তনের ফলে এসব পণ্য আরও সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হতে পারে।
পোশাক শিল্পে দুই ধরনের সুবিধা
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বলেছেন, ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্য নীতি বাংলাদেশের জন্য দুটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে।
প্রথমত, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যের পোশাকের দিকে ঝুঁকতে পারেন। ফলে ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে আমদানি বাড়ানোর বিষয়ে আগ্রহী হবে।
"আসলে, মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব ইতোমধ্যেই ইউরোপে বাংলাদেশি পোশাকের রপ্তানি বাড়িয়েছে," বলেন মহিউদ্দিন।
দ্বিতীয়ত, চীনের ওপর বাড়তি শুল্কের কারণে মার্কিন ক্রেতারা বিকল্প উৎস খুঁজতে বাধ্য হবেন। এ পরিস্থিতিতে নিম্ন ও মাঝারি মানের ব্র্যান্ডগুলোর জন্য বাংলাদেশ অন্যতম আদর্শ বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
"এছাড়া, চীনা পোশাক প্রস্তুতকারকেরা শুল্ক এড়াতে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে পারে," বলেন বিজিএমইএ'র সাবেক এ পরিচালক।
তবে মহিউদ্দিন সতর্ক করে বলেন, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ পুরোপুরি এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, পাশাপাশি এগুলোর অনিয়মিত সরবরাহের কারণে শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে, ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই এসব সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্যবিরোধ থেকে বাংলাদেশ সরাসরি কোনো সুবিধা পাবে না।
তবে, যদি চীনের ওপর শুল্ক আরও বাড়ানো হয়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি বাড়তে পারে এবং বিনিয়োগ স্থানান্তরের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক ব্যয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এ সুযোগ কাজে লাগানোর পথে বড় বাধা হতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।
"বৈশ্বিক বাণিজ্যের ব্যয় বেড়ে গেলে বাংলাদেশেও কাঁচামাল ও পণ্য আমদানির খরচ বাড়বে," যোগ করেন হাতেম।
দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি
স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা পেলেও, অর্থনীতিবিদরা সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করেছেন। তারা মনে করেন, যদি অন্যান্য দেশ স্বনির্ভরতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আমদানি কমানোর মার্কিন নীতির অনুসরণ করে, তাহলে রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশ্বায়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুবিধা পাওয়ার কারণেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিকশিত হয়েছে।
তবে ট্রাম্পের নীতিগুলো জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার ভিত্তিতে পরিচালিত, যা বিশ্বায়নের বিপরীত। "যদি এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে চীনের পর বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ওপরও শুল্ক আরোপের ঝুঁকি রয়েছে," বলেন তিনি।
এছাড়া, অন্যান্য দেশও একই ধরনের নীতি গ্রহণ করতে পারে, যা স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হলেও দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
"মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, মেক্সিকো ও কানাডার মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে, যার ফলে এসব অঞ্চলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এর ফলে কম দামের পোশাকের চাহিদাও কমতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে," বলেন মোয়াজ্জেম।
তিনি আরও বলেন, যদি ট্রাম্প তার মিত্র দেশগুলোর জন্য শুল্ক ছাড়ের ব্যবস্থা করেন, তাহলে তা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার কারণ হতে পারে।