চীন কি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে? নতুন মানদণ্ড বলছে ‘না’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজ প্রভাব ও প্রতিপত্তির শীর্ষে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য ওই সময় থেকেই বিশ্বসেরার আসন থেকে পতনের ভীতি মার্কিনীদের।
একের পর এক নানা ঘটনার ক্ষেত্রে এমন শঙ্কা দেখা গেছে। যেমন ১৯৫০- এর দশকে সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের স্পুটনিক মহাশূন্য যান নিক্ষেপের পর মহাকাশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভীতি দেখা দিয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয় তা আবারও ফিরিয়ে আনে। ১৯৭০ এর দশকে তেলের মূল্যস্ফীতি বা ১৯৮০'র দশকে জাপানের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও মুকুট হারানোর আতঙ্কে ভুগেছেন ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারক মহল।
এখন আবার বিশ্বমারির মাঝে দেখা দিয়েছে চীনের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রামের লক্ষণ। তাই দেশটির কাছে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিপত্তি হারাচ্ছে কিনা- এমন আলোচনা নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পায়।
এই বিতর্কের সমস্যা হলো; ক্ষমতা যেমন দরকারি ঠিক তেমনি অস্পষ্ট এক সীমারেখায় অবস্থান করে। কোনো বড় যুদ্ধ ছাড়া দুই দেশের ক্ষমতা সরাসরি নির্ধারণ করা সহজ নয়।
যুদ্ধের কথা অবশ্য আলাদা। সেখানে বিজয়ীই বলে দেয় কে বেশি ক্ষমতার অধিকারী। তাই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্ষমতার মানদণ্ড নির্ধারণে নতুন সূচকের প্রয়োজন দেখা দেয়।
ইতোমধ্যেই এমন কিছু পরিমাপক তৈরি করা হয়েছে। যা ক্ষমতা আসলে কী এবং তা কীভাবে মাপা উচিৎ সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়েছে। তবে এসব অনুসন্ধানের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের মতো শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখায় উদগ্রীব পরাশক্তিকে সম্পূর্ণ না হলেও অনেকাংশেই আশ্বস্ত করছে।
ঐতিহ্যগতভাবে ক্ষমতার মাপকাঠি হিসাবে: জনসংখ্যা, শক্তি ব্যবহার, ইস্পাতের উৎপাদন এবং শিল্প ক্ষমতার নির্দেশক অন্যান্য সূচকের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। কিন্তু, তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এসে সেগুলো আর যথেষ্ট নয়। এসব সূচকের ওঠানামা একটি দেশ বৈশ্বিক পর্যায়ে কী প্রভাব ফেলছে তার সম্পর্কে খুব সামান্য ধারনাই দিতে পারে।
তারপরও অবশ্য গড় দেশজ উৎপাদনের ভিত্তিতে মোটা অঙ্কে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নির্ধারণের একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি আছে। এটি মোটেই সূক্ষ্ম নয়। যেসব বিশেষজ্ঞ জিডিপি'র ভিত্তিতে বলেন যে বেইজিং অচিরেই অর্থনীতিতে ওয়াশিংটনের প্রভাবকে ছাড়িয়ে যাবে, তারা আসলে অভ্যাসের বশেই এমন ভুল করে চলেছেন।
কারণ, জিডিপি হলো সার্বিক চিত্রের একটি খণ্ডিত অংশ মাত্র এবং তা মোট সম্পদের অবস্থাও নির্দেশ করে না। আবার সামরিক ব্যয় নিয়েও তুলনামূলক আলোচনা করা হয়। কিন্তু, সেটাও কী সঠিক ধারা! পৃথিবীতে সৌদি আরবের মতো এমন অনেক দেশ আছে যারা এখাতে বিপুল ব্যয় করলেও আসলে 'ঠুঁটো জগন্নাথ' ধরনের সামরিক শক্তির অধিকারী।
আর শক্তি শুধু থাকলে হয় না, তা প্রদর্শনের উপযুক্ত মাধ্যমটাও থাকা চাই। যা বেইজিংয়ের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণেই ওয়াশিংটনের আছে।
এজন্যেই অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি নিয়ে আমাদের প্রচলিত পরিমাপ পদ্ধতির সংশোধন জরুরি হয়ে ওঠে। সেকাজে এগিয়ে আসেন আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের গবেষক মাইকেল বেকলি। এই নীতি- পরামর্শক সংস্থায় আমি নিজেও একজন গবেষণা ফেলো হিসেবে যুক্ত আছি।
সহকর্মী বেকলি এমন একটি পরিমাপ কাঠামো তৈরি করেছেন যা গড় ক্ষমতা নয় বরং মোট ক্ষমতার হিসাব বের করতে পারে। এটা বের করার অনেক সহযোগী উপায় আছে। যেমন, একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার ইঙ্গিত দেওয়া যায়, দেশটি নাগরিকদের নিরাপদ রাখতে পুলিশ বাহিনীর পেছনে কী পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করে তা জানা থাকলে।
নতুন অর্থনৈতিক পরিমাপকে আছে আবার উৎপাদনের ব্যয় নির্ধারণে পরিবেশগত প্রভাব, দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ। এভাবে একটি দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে উৎপাদন বাড়ালেও সেই ব্যবস্থা পরিবেশের কতোটা স্থায়ী ক্ষতি করছে- সেই মূল্য যোগ হবে পণ্যের সাথে। আর প্রকৃতির উপাদান অফুরন্ত না হওয়ায় দূষণের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন দিনশেষে ক্ষতির মাত্রাই বাড়ায়।
নতুন এই পরিমাপ কাঠামোয় প্রত্যাশিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে বলে মাইকেল প্রমাণ পান। কারণ, ওয়াশিংটন পরিবেশ দূষণ করে ব্যাপক উৎপাদনের নীতি নেয়নি। ধারাবাহিক উন্নয়নের চাহিদায় তাকে বিগত কয়েক দশকে ভর্তুকি দিয়ে ক্ষতিকর শিল্প প্রতিপালনও করতে হয়নি। অথচ জিডিপি বিকাশের গতি ধরে রাখতে সেটাই করেছে বা করতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছে বেইজিং।
এজন্যই প্রকৃত অর্থের মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে আমেরিকানরা চীনাদের চাইতে বেশ এগিয়ে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যয়ও তাদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার একটি চিত্র তুলে ধরে।
এর অর্থ দাঁড়ায়, নিজ দেশের চাহিদা পূরণের পর বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতিরিক্ত সম্পদ আছে।
মাইকেলের অন্যকিছু সূচক অনুসারে, চীন যদি মোট জিডিপির আকারে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়েও যায় তারপরও অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রেরই বেশি হবে।
দ্বিতীয় এই সংজ্ঞা শ্রেণিকে 'নেটওয়ার্ক পাওয়ার' নামকরণ করা হয় ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায়। গবেষণাটি করেছিলেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্রাহাম নিউম্যান ও জনস হপকিন্স স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে কর্মরত আমার আরেক সহকর্মী।
নিজেদের গবেষণাপত্রে তারা আন্তর্জাতিক অর্থ প্রবাহের জালে ডলারের কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। বিগত কয়েক দশক ধরে মুদ্রাটির অবস্থান হারানোর গুঞ্জন চললেও এখনও যে ডলারকে প্রতিস্থাপন করা সহজ নয়, সেটাই উঠে আসে গবেষণা নিবন্ধের মূল ব্যাখ্যায়।
এভাবে গবেষকরা একটা বিষয়ে একমত, যুক্তরাষ্ট্র যতটুকু ক্ষমতা বহিঃবিশ্বে প্রয়োগ করে, আসলে তার চাইতেও অনেক বেশি ক্ষমতা তার আছে। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অর্থনৈতিক, সামরিক আর কূটনৈতিক নেটওয়ার্কই তার সেই শক্তির উৎস। সেই হিসাবে চীনের তেমন কিছুই নেই। অর্থাৎ, নেটওয়ার্ক পাওয়ারেও যুক্তরাষ্ট্রই শ্রেষ্ঠ।
- লেখক: ব্লুমবার্গে মতামত কলামিস্ট, জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন কেন্দ্রের হেনরি কিসিঞ্জার পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউডের একজন গবেষক।