কৃষি পণ্যে লোকসান গুণছে কৃষক
আড়াই বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ করেছিলেন ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার আব্দুল করিম মোল্লা। উৎপাদিত পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ৭৫০-৮০০ টাকা মন। একেক কেজির দাম পড়ছে ২০.২৭-২১.৬২ টাকা।
আব্দুল কাদের মোল্লা বলেন, 'বেশি দাম দিয়ে বীজ কেনার কারণে উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। ৭৫০-৮০০ টাকা মন হিসেবে বিক্রি করে কোন লাভ হচ্ছে না'।
কৃষি বিপনন অধিদপ্তর ফরিদপুরসহ মোট ১৯ টি জেলা থেকে পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ হিসেব করে। দেখা গেছে, প্রতি কেজি পেঁয়াজের উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৯.২৪ টাকা। সেখানে কৃষক প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি ২০.২৭-২১.৬২ টাকা। অবশ্য কোন কোন এলাকার কৃষক এর কিছু বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে বলে জানা গেছে।
মানিকগঞ্জ, রংপুর, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার প্রভাব থাকার পরও প্রচুর পরিমাণ সবজির আবাদ হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় ভোক্তারা কম দামে শীতের সবজি খেতে পারছে। শুধু খরচ উঠাতে পারছে না কৃষক।
জানা গেছে, চলতি শীত মৌসুমে একেকটি বাঁধাকপি উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৭.০৭ টাকা। অথচ অঞ্চলভেদে কৃষক বিক্রি করছে ৬-৭ টাকায়। একইভাবে যারা ফুলকপি, সীম, টমেটো ও বেগুণ আবাদ করেছেন তারাও পণ্য বিক্রি করে খরচ উঠাতে হিমশিম খাচ্ছে্ন বলে জানা গেছে।
মনিকগঞ্জের সদর উপজেলার বৈতরা গ্রামরে কৃষক স্বাধীন মিয়া বলেন, 'প্রতি পিস ফুলকপি উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৮ টাকার কাছাকাছি। বিক্রি করে দাম পাচ্ছি ৬-৮ টাকা। খরচ উঠবে কি করে?'
জানা গেছে, ঢাকার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায়। যা মাসখানেক আগেও ৫০ টাকার বেশি ছিল। কিন্তু ভারত ১ জানুয়ারী থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি শুরু করার পর থেকেই বাংলাদেশে দ্রুত দাম কমতে শুরু করে। এর আগে যারা পেঁয়াজ বিক্রি করেছে তারা অবশ্য ১২শ-১৭শ টাকার মধ্যে পেঁয়াজ বিক্রি করেছে।
করোনার মধ্যেও কৃষক ভালো ফসল ফলিয়ে মার খাচ্ছে বলে কৃষি বিপনন অধিদপ্তর ১৬টি কৃষি পণ্যের দাম বেঁধে দিতে কাজ করছে। এজন্য ১৬টি পণ্যের উৎপাদন খরচ বের করা হয়েছে। যাতে করে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়। তারপরও যারা লোকসান করছে তাদেরকে ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েও কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
এই কৃষিপণ্যগুলো হলো - পেঁয়াজ, রসুন, সরিষা, মসুর ডাল, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, টমেটো, কাচা পেঁপে, ঢেঁড়স, শীম, বেগুন, কাঁচামরিচ এবং লাউ।
কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, '১৬ টি কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ যাচাই করেছি। আমরা কাজ করছি পণ্যগুলোর ন্যূনতম দাম বেঁধে দেওয়ার জন্য। যাতে করে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পায়। আবার ভোক্তারাও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।'
যদিও অধিকাংশ পণ্য বিক্রি করেই লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষককে। ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুচরা বাজারগুলোতে সবজির প্রচুর সরবরাহ থাকায় দামও বেশ কম।
ঢাকার মেরুল বাড্ডার বেসরকারী চাকরিজীবি আনিসুর রহমান টিবিএসকে বলেন, '২০ টাকা দরে টমেটো, আলু, ১৫-২০ টাকায় ফুলকপি- বাধাকপি, ২৫-৩০ টাকায় শিম কিনতে পারছি। এটা তো বেশ সস্তা।'
জানা গেছে, করোনার মহামারী ও বন্যার প্রভাবে সবজির উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফল ভোগ করতে হয়েছিল প্রায় ৬ মাসেরও বেশি সময়। ঐ সময়ে ৫০-৬০ টাকার নীচে কোন সবজি পাওয়া যায়নি। কোন কোন সবজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকাতেও। অথচ এখন বেশি উৎপাদন করে কৃষক দামই পাচ্ছে না বলে জানা সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের (ইউজিভি) উপাচার্য ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, 'কৃষক যখন উৎপাদন বেশি করে করে তখনই দাম পায় না। এটা একটা নিয়মিত ঘটনা। এর থেকে কৃষককে বাচাতে আমরা প্রাইস কমিশন করার দাবি জানিয়ে আসছি।'
তিনি বলেন, 'যেসব কৃষি পণ্যের দাম বাজারে বেশি উঠানামা করে সেগুলো উৎপাদন ও অনুৎপাদন মৌসুমে আলাদা আলাদ দাম বেঁধে দেওয়া জরুরি। এর জন্য একটি প্রাইস কমিশন গঠন করতে হবে। দাম বেধে দিতে না পারলে কৃষকরা এক সময় উৎপাদন বিমুখ হয়ে পড়বে।'
উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বরে কৃষিখাতের সংষ্কারের লক্ষ্যে তিনটি আইন পাস করা হয়। যে আইনকে ভারতীয় কৃষকরা 'কালো আইন' বলে আখ্যা দিয়েছে এবং এখনো পর্যন্ত আইন বাতিলে আন্দোলন করছে। ভারতের বেশ কিছু কৃষি পণ্য রয়েছে যেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষকদের আশংকা এই আইনের কারণে কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) বাতিল হয়ে যাবে। এতে করে বাজারে নিয়ন্ত্রণ আসবে মধ্যসত্ত্বভোগীদের। আর নতুন আইনে কৃষিপণ্য বিক্রি, গুদামজাত করা ও মূল্য নির্ধারণ নীতিতে পরিবর্তন হওয়ার কারণে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, সাম্প্রতিক সময়ে পেঁয়াজ, চাল ও আলুর বাজারের অস্থিরতা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই হয়েছে। যেখানে সরকার কোন ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।