দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিকালে জোসেফিন বেকারের দ্বৈত জীবন
১৯৩৯ সালে ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে না উঠতেই ফ্রান্সের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা নতুন এক গুপ্তচর নিয়োগ করে। তবে, নতুন এই গুপ্তচর অন্যদের মতো সাধারণ কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন তৎকালীন ফ্রান্সের সবথেকে জনপ্রিয় আবেদনময়ী নারী জোসেফিন বেকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে জ্যাক অ্যাবটে জার্মান নাৎসি এবং অন্যান্য অক্ষ শক্তির কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গুপ্তচর নিয়োগ করা শুরু করেন। গোয়েন্দা সার্ভিসের এই প্রধান সাধারণত ছদ্মবেশ ধারণের উপযোগী পুরুষদের গুপ্তচর হিসেবে বেছে নিতেন। আমেরিকায় জন্ম নেওয়া গায়িকা এবং নৃত্যশিল্পী জোসেফিনকে গুপ্তচর বৃত্তিতে নিয়োগ করা সচরাচর কোনও ঘটনা ছিল না বললেই চলে।
বেকারের জন্ম হয়েছিল ১৯০৬ সালে সেইন্ট লুইসে। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা বেকার ছিলেন পিতৃহারা। ইঁদুরে ভর্তি এক খুপড়ি ঘরে থাকতেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও ঠিকমতো লাভ করেননি। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই প্রথমবারের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেন বেকার। জিম ক্রো আইনের কারণে আমেরিকায় বেকারকে বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হতে হয়। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বার্লেস্ক নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্যারিসে কাজ শুরু করেন। প্যারিসের মিউজিক হলগুলোতে তিনি মুক্তোর ছড়া আর রাবার ব্যানানা স্কার্ট পরে নাচতেন। স্বল্পবসনা এই নৃত্যশিল্পী কয়েকদিনের মাঝেই জ্যাজ যুগের আবেদনময়ী নারীতে পরিণত হন। এরপর চলচ্চিত্রে গান এবং অভিনয়ের মধ্য তিনি ইউরোপের বিনোদন অঙ্গনের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত শিল্পীতে পরিণত হন।
তবে বেকারের তারকা খ্যাতিই তার গোয়েন্দা-বৃত্তিতে বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারত। তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে সন্তর্পণে তার কিছু করার উপায় ছিল না। তবে এই বিষয়টিই তার জন্য লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খ্যাতির আড়ালে তিনি গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেন। অ্যাবটে আশা করেছিলেন, বেকার তার রূপ আর তারকাখ্যাতির সম্মোহনে দূতাবাসের পার্টিগুলোতে কূটনীতিকদের কাছ থেকে গোপন বার্তা আদায় করতে পারবেন।
আমেরিকায় যে স্বাধীনতা কাগজে কলমে লেখা ছিল, বেকার তা ফ্রান্সে এসে প্রকৃত অর্থেই খুঁজে পেয়েছিলেন। বেকার তার নব জন্মদানকারী আশ্রিত দেশটির জন্যই গুপ্তচরবৃত্তি বেছে নিলেন। অ্যাবটেকে তিনি বলেন, "আজ আমি যেখানে আছি, সেখানে আমাকে নিয়ে এসেছে ফ্রান্স। ফরাসিরা আমাকে তাদের হৃদয় দিয়েছে, আমি তাদের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত"।
ইউরোপে পারফর্ম করাকালীন বেকারকে বহুবার 'আফ্রিকা চলে যাও!'- এ ধরনের বর্ণবাদী মন্তব্য শুনতে হয়। এই বিষয়টিও তাকে গুপ্তচর হতে উদ্যত করেছিল। প্রায় এক যুগ পরে ইবোনি ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, "আমি অবশ্যই ফ্রান্সকে যতটুকু পারি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, আমার আশ্রয়দাতা দেশ ছিল ফ্রান্স। তবে দেশপ্রেমের বাইরেও যে বিষয়টি আমাকে দৃঢ়ভাবে পরিচালিত করেছিল, তা ছিল যেকোনো বৈষম্যের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা।"
গোপন তথ্য উদ্ধারে তারকাখ্যাতি ব্যবহার করতেন বেকার
বেকার ইতালিয়ান এবং জাপানিজ কূটনৈতিক পার্টিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেন। সেখানে তিনি যুদ্ধে অংশ নিতে পারে এ ধরনের অক্ষ শক্তিগুলো সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতেন। অনভিজ্ঞ হয়েও কোনো ভীতি বা উদ্বেগ ছাড়াই তিনি যা শুনতেন তাই হাতের তালুতে কিংবা জামার হাতার নিচে গায়ে লিখে রাখতেন। অ্যাবটে এ বিষয়ে বেকারকে সতর্ক করলে হাসতে হাসতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "ধুরু, কেউ আমাকে গুপ্তচর ভাববে না"।
জার্মান সৈন্যরা ফ্রান্স আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ পর বেকার প্যারিসে রাত্রিকালীন পারফর্ম শুরু করেন। তিনি সম্মুখযুদ্ধের সৈন্যদের জন্য রেডিওতে গান করতেন। পাশাপাশি শরণার্থী শিবিরে গৃহহীনদের জন্যও কাজ করতেন। ১৯৪০ সালের জুন মাসের শুরুর দিকে, আক্রমণকারী জার্মানরা প্যারিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে বেকারকে সরে যেতে বলেন অ্যাবটে। সোনার একটি পিয়ানো, রানি মেরি অ্যানটয়নেটের পালঙ্ক ও অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে প্যারিসের দক্ষিণ-পশ্চিমে ৩০০ মেইল দূরবর্তী এক দুর্গে উঠেন তিনি।
১৯৪০ সালের নভেম্বরে অ্যাবটে এবং বেকার মিলিতভাবে লন্ডনে আশ্রিত স্বাধীন ফরাসি সরকার এবং জেনারেল শার্ল দ্য গোলের কাছে নথিপত্র পাচার করেন। দক্ষিণ আমেরিকা সফরের আড়ালে বেকার গোপন কিছু চিত্র তার পোশাকের নিচে লুকিয়ে নিয়েছিলেন। এছাড়া, ফ্রান্সে জার্মান সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কিত তথ্য অদৃশ্য কালিতে লিখে মিউজিক শিটে করে পরিবহন করেন তিনি। পর্তুগালে যাবার পথে স্পেনের বর্ডার পার করবার সময় সবগুলো চোখ বেকারের উপরই ছিল। ফ্রেঞ্চ গোয়েন্দা প্রধান অ্যাবটে ছিলেন বেকারের সহকারীর ছদ্মবেশে। জার্মান কর্মকর্তারা তার দিকে তেমন নজর দেননি। বেকারের তারকাখ্যাতির ছত্রছায়ায় অ্যাবটে নির্বিঘ্নে পাড়ি জমান।
পর্তুগাল এবং স্পেনে বেকার অক্ষ শক্তির সৈন্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে আবারও দূতাবাসে পার্টিগুলোতে যাতায়াত শুরু করেন। বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে নোট লিখে তিনি সেফটি পিনের সাহায্যে অন্তর্বাসে আটকে রাখতেন। পরবর্তী কালে এক লেখায় তিনি বলেন, "ধরা পড়লে আমার নোটগুলো ভীষণ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু জোসেফিন বেকারের শরীর তল্লাশি করবে এমন সাহস কার ছিল? তারা যখন আমার কাছে কাগজ চাইত, সাধারণত সেটা অটোগ্রাফই বোঝাত।"
অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বিরতি নেননি বেকার
১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে কাসাব্লাঙ্কায় লিঁয়াজো এবং সম্প্রচার কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে মরক্কো পাড়ি জমান বেকার এবং অ্যাবটে। বেকার ২৮টি ব্যাগের সাথে একদল পোষা বানর, ইঁদুর আর গ্রেট ডেন একটি কুকুর সাথে নিয়েছিলেন। বেকারের যাত্রা যত আড়ম্বরপূর্ণ ছিল, তিনি ঠিক ততো কম সন্দেহের সৃষ্টি করেছিলেন।
১৯৪১ সালের জুনে পেরিটোনাইটিসের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন বেকার। তার আগ পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকায় তিনি ফ্রেঞ্চ রেজিজট্যান্স নেটওয়ার্কের সাথে কাজ করতেন। নিজের পরিচিতি ব্যবহার করে তিনি নাৎসিদের হাত থেকে ইহুদিদের বাঁচাতে তাদের পাসপোর্টের সুরক্ষা দিতেন। ১৮ মাস হাসপাতালে থাকাকালীন বেকারকে একাধিক অস্ত্রপাচার করাতে হয়। বেকার এতোটাই অসুস্থ ছিলেন যে শিকাগো ডিফেন্ডার পত্রিকায় ল্যাংসটন হিউ ভুল্ক্রমে বেকারের জন্য একটি শোকবার্তা লিখেন। তিনি লিখেছিলেন, "হিটলারের সাথে লড়াই করে যেসব সৈন্য আজ আফ্রিকায় আছেন, বেকারও তাদের মতোই একজন ভিক্টিম। আর্যরা জোসেফিনকে তার প্রিয় প্যারিস থেকে দূর করে দিয়েছে।" তবে, বেকার দ্রুত তা সংশোধন করেন। আফ্রো-আমেরিকানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "এখানে একটু ভুল হয়েছে, আমি এত ব্যস্ত যে আমার হাতে মরার সময় নেই।"
তবে বিশ্রামরত থাকা অবস্থাতেও গুপ্তচরদের সাথে যুক্ত ছিলেন বেকার। তাকে দেখতে এসে সমবেত হতেন আমেরিকান কূটনীতিবিদ এবং ফ্রেঞ্চ রেজিসস্ট্যান্সের সদস্যরা। ১৯৪২ সালের নভেম্বরে অপারেশন টর্চ পরিচালনা করতে মরক্কোতে আসেন আমেরিকান সৈন্যরা। বারান্দা থেকেই বেকার তাদের পর্যবেক্ষণ করতেন। তবে শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বেকার আলজিয়ার্স থেকে জেরুজালেমে মিত্র বাহিনীর সামরিক ঘাঁটিগুলোতে ভ্রমণ করেন। দিনের বেলায় বেকার জিপে করে উত্তর আফ্রিকার তপ্ত মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াতেন। রাতের বেলা ল্যান্ড মাইন এড়াতে গাড়ির পাশেই শুয়ে পড়তেন তিনি।
প্যারিস মুক্ত হলে ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে চার বছরের ব্যবধানে তিনি প্রিয় নগরী প্যারিসে ফিরে যান। নীল রঙের এয়ার অক্সিলারি লেফট্যানেন্টের পোশাকে সোনার এপোলেট জড়িয়ে তিনি গাড়ির পেছনে উঠেন। রাস্তার ধারে ভিড় থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা পান তিনি। তখন তিনি কেবল গ্ল্যামার জগতের তারকাই নন, বরং দেশপ্রেমী এক নায়িকা।
১৯৬১ সালে বেকার পুনরায় সেই ইউনিফর্মটি পরিধান করেন। সেবার তিনি ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা ক্রস অব ওয়ার এবং লিজন অব অনার পান। এই আয়োজনটির মাধ্যমেই বেকারের গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়টি উন্মোচিত হয়। অশ্রুসিক্ত চোখে বেকার দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, "আমি ফ্রেঞ্চ হিসেবে গর্বিত কেননা, বিশ্বে এই একটি মাত্র স্থানেই আমি আমার স্বপ্নকে অনুধাবন করতে পারি"।
- সূত্র: হিস্ট্রি ডট কম