পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রচলিত অস্ত্র হয়ে উঠছে চীনের তৈরি ড্রোন
কট্টরপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারামের বিরুদ্ধে এক যুগের বেশি সময় লড়াই চালানোর পর, অবশেষে এই সন্ত্রাসীদের দমনে নতুন অস্ত্র- চীনের তৈরি উইং লুং-২ ড্রোন পাচ্ছে নাইজেরিয়া। বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম কমব্যাট ড্রোনটির নির্মাতা চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা- এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি কর্প অব চায়না (এভিক)। সাম্প্রতিক সময়ে নানান দেশের কাছে মনুষ্যহীন আকাশযানটি বিক্রি করছে সংস্থাটি। নাইজেরিয়ার সঙ্গে করা চুক্তিটিও ছিল তাদের ক্রমবর্ধমান বাজার দখলের অংশ।
সমরাস্ত্র বাজারের নতুন খাত হলো সশস্ত্র ড্রোনের বাজার। সেখানে চীনা সংস্থাটির রমরমা চোখে পড়ে সহজেই। এই যেমন; লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে এভিকের তৈরি বিভিন্ন রকম ড্রোন ব্যবহার করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সিনাই উপত্যকায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে মিশর। ইয়েমেনে সৌদি সেনারাও উইং লুং-২ ব্যবহার করেছে হুথিদের বিরুদ্ধে।
অস্ত্র বাজারে কোনো দেশের তৈরি যুদ্ধাস্ত্রের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো; সেটি 'কমব্যাট টেস্টেড' বা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহা্রের মাধ্যমে উন্নয়ন করা হয়েছে কিনা- সেই ছাড়পত্র। "যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে এভিক তাদের ভুলত্রুটি থেকে শিখেছে এবং সেই অভিজ্ঞতা উৎপাদন চক্রে যোগ করে অস্ত্রের ত্রুটি দূর করার সুযোগ পেয়েছে"- বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের আর্লিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মিশেল ইনস্টিটিউট অব অ্যারোস্পেস স্টাডিজের গবেষণা ফেলো হিথার পেনি।
যুদ্ধ-পরীক্ষিত সেই দ্বিতীয় প্রজন্মের উইং লুং ড্রোনই কিনেছে নাইজেরিয়া। চীনা ভাষায় নামটির অর্থ প্রাগৈতিহাসিক উড়ন্ত প্রাণী 'পিটেরোডেকটাইল', ডাইনোসর গোত্রীয় হিংস্র এই প্রাণী আধুনিক পাখির পূর্বপুরুষ। উইং লুং-২ তেমনই ক্ষিপ্র ও প্রাণঘাতী। ৩০ হাজার ফিট উচ্চতায় এটি উড়তে পারে ঘণ্টায় ২৩০ মাইল বেগে। বহন করতে পারে নানান রকমের এক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র।
২০১৫ সালে নতুন মডেলটি আনে এভিক। তারপর থেকে ৫০টি বিক্রি করেছে রপ্তানি বাজারে, চীনা সেনাবাহিনী- গণমুক্তি ফৌজও কিনেছে অজ্ঞাতসংখ্যক পরিমাণে। এভিক এখন আরও অত্যাধুনিক মনুষ্যহীন আকাশযান তৈরির চেষ্টা করছে। যেমন; যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বি-২ বোমারু বিমানের 'উড়ন্ত ডানা' সদৃশ ডিজাইনের আদলে রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম একটি ড্রোন তৈরির কাজ করছে সংস্থাটি।
এভাবে ড্রোন নির্মাণের কর্মসূচিসহ প্রচলিত যুদ্ধবিমান, প্রশিক্ষণ বিমান, পরিবহন বিমান এবং অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার সরবরাহের সুবাদে বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের প্রথম সাড়ির সংস্থাগুলোর কাতারে স্থান করে নিয়েছে এভিক।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) এর মতে, ২০১৯ সালে সংস্থাটি ২২.৫ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে। সেবছর যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাঁচটি অস্ত্র রপ্তানিকারক কোম্পানির পর এভিক ষষ্ঠস্থান দখল করে।
আন্তর্জাতিক বাজারে এভিকের তৈরি ড্রোনের প্রতি ক্রেতা আকর্ষণের মূল কারণ দুটি: প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের তৈরি আকাশযানের তুলনায় এগুলোর দাম বেশ কম। দ্বিতীয়ত, তাদের অস্ত্র কোথায় ব্যবহার করা হবে- তা নিয়ে চীনের কোনো মাথাব্যথা নেই। অর্থাৎ, তারা বিক্রেতা হিসেবে কোনো শর্তারোপ করে না। একথা জানান ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স- এর পলিসি ফেলো উলরিক ফ্রাঙ্কে। তিনি বলেন, "যে কেউ চাইলেই চীনের তৈরি ড্রোন কিনতে পারে। প্রায় সবার কাছে বিক্রিতে আপত্তিও নেই দেশটির।" এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে এভিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্লুমবার্গ। কিন্তু, তারা সেই অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
সিপ্রির মতে, গত এক দশকে ১৬টি দেশে ২২০টি ড্রোন রপ্তানি করেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনিসিলভানিয়ার রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল হোরোউইৎজ বলেন, এই অস্ত্রের বলেই রণাঙ্গনে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ পায় অনেক দেশ। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং বেলারুশের মতো দেশ এখন নিজেদের ড্রোন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাচ্ছে।
ড্রোন প্রযুক্তির কৌশলগত ও ব্যবহারিক সুবিধা সাম্প্রতিক সময়ে স্পষ্ট হয় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে গত বছরের শেষে সংগঠিত নগরনো-কারাবাখ যুদ্ধে। এ যুদ্ধে আজারবাইজানের জয় নিশ্চিত করে তুরস্কের সরবরাহ করা অত্যাধুনিক ড্রোন। গত জানুয়ারিতে মিয়ানমারের কাছে ড্রোন সরবরাহের চুক্তি করে রাশিয়া। দেশটি দূরপাল্লার ড্রোন নির্মাণের চেষ্টাও করছে। অন্যদিকে, চীনা প্রযুক্তি কিনে নিজস্ব ড্রোন কর্মসূচিতে গতি আনার কথা জানিয়েছে পাকিস্তান ও সার্বিয়া। হোরোউইৎজ বলেন, "চীনের বেহিসেবী বিক্রয়ের কারণেই এখন ড্রোন রপ্তানির আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।"
তবে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতার দৌড়ে ইন্ধন দেওয়ার এ অভিযোগ অস্বীকার করে চীন সরকার জানিয়েছে, তারা শুধু ক্রেতা দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং গত ফেব্রুয়ারিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "অস্ত্র রপ্তানির বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সতর্ক এবং দায়িত্বশীল। তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।"
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিচ্ছিন্ন পররাষ্ট্রনীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরে আনতে চান দেশটির বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন। তবে বিশ্ববাজারে চীনের ড্রোন সরবরাহের কারণে তিনি সেবিষয়ে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। গেল বছরের শরতে এভিক এবং এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চীনা সামরিক বাহিনীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তাদের কাছে মার্কিন প্রযুক্তি বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প। কিন্তু, তারপরই তিনি ৩০টি দেশের স্বাক্ষরিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ চুক্তির নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করান। ওই চুক্তির আদলেই এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ড্রোন রপ্তানি সীমিত ছিল, সেই অবস্থান পরিবর্তনের ফলে মনুষ্যবিহীন এসব আকাশযান বিক্রির বাধা অপসারণ হয়েছে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘনের এ ঘটনা নিঃসন্দেহে চীনসহ অন্যান্য দেশের সামনে একটি নেতিবাচক উদারহরণ তৈরি করে ফেলেছে।
ইয়েমেন যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনে ভূমিকা রাখায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রির বিরুদ্ধেই ছিল ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত মার্কিন কংগ্রেস। তারপরও, নির্বাহী ক্ষমতাবলে দেশটির কাছে জেনারেল ডায়নামিক্সের তৈরি ১৮টি এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন বিক্রিতে সম্মতি দেন ট্রাম্প। নভেম্বরে ৬০ কোটি ডলারে তাইওয়ানের কাছে আরও ৪টি রিপার ড্রোন বিক্রির চুক্তি অনুমোদন করেন তিনি। তারপরের মাসে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পুরষ্কার হিসেবে মরোক্কোর কাছেও চারটি ড্রোন বিক্রির প্রস্তাব কংগ্রেসকে জানায় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আগের প্রশাসনের এসব উদ্যোগের মধ্যে আরব আমিরাতের কাছে বিক্রির চুক্তিটি পুনঃপর্যালোচনা করে দেখার কথা জানিয়েছেন বাইডেন। যদিও, তিনটি চুক্তিই চূড়ান্ত হওয়ার পথে।
বিশ্বের শীর্ষ সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক যুক্তরাষ্ট্র যে অস্ত্র বাণিজ্যের এই লড়াইয়ে কোনো অংশেই চীনের থেকে পিছিয়ে থাকতে চায় না, সেই বিষয়টিও এসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে উঠে আসে।
সামরিক এবং বেসামরিক উভয় ধরনের উড়োজাহাজ শিল্পে চীনের বৃহত্তর উন্নয়ন অর্জনের কেন্দ্রে আছে এভিক। সংস্থাটি মিশর, সৌদি আরব, ইরাক ও সার্বিয়ায় ড্রোন বিক্রি করে। সার্বিয়াই প্রথম ইউরোপিয় দেশ যারা চীনের তৈরি মনুষ্যহীন যান কেনে। গেল নভেম্বরে চায়না নর্থ ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপ, তাদের গোল্ডেন ঈগল হেলিকপ্টার ড্রোন তৈরির কাজ সম্পন্ন করে। রাষ্ট্রায়ত্ত দৈনিক গ্লোবাল টাইমস জানায়, "অস্ত্র বাণিজ্যের চাহিদা মাথায় রেখেই এটি তৈরি করা হয়েছে।"
আরেকটি কোম্পানি কমার্শিয়াল এয়ারক্রাফট কর্প অব চায়নার ১২ শতাংশ মালিকানা আছে এভিকের। কোম্পানিটি বোয়িং ৭৩৭ এবং এয়ারবাস এ৩২০-র মতো বহুল বিক্রিত বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমানের মতো নিজস্ব জেটলাইনার তৈরির লক্ষ্য কাজ করছে। চীনে ব্যবসা করা অন্তত এক ডজন বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গেও যন্ত্রাংশ সরবরাহের চুক্তি রয়েছে এভিকের। উড়োজাহাজ শিল্পে চীনের এই অগ্রগতি পশ্চিমা বিশ্বের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ।
পোল্যান্ডের ওয়ারশ ইনস্টিটিউট- এর পরিচালক পাওয়েল পাসজাক বলেন, "সময়ের সাথে সাথে এভিকের দক্ষতা বাড়ার ফলে তাদের পণ্যের মানও উন্নত হচ্ছে।" তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মতো ড্রোন বাজারের প্রধান বিক্রেতাদের সমকক্ষ মানের না হলেও- তাদের সঙ্গে চীনা ড্রোনের দামের ব্যবধান বিশাল; এভিকের সর্বাধুনিক ড্রোনের দাম ১০-২০ লাখ ডলার, যার বিপরীতে একই ধরনের মার্কিন মডেলের দাম দেড় কোটি ডলারেরও বেশি। পাসজাকের মতে, "চীনা ড্রোন হয়তো এখনও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ড্রোনের মতো উন্নত নয়, তবে একটির দামে ১৫টি ড্রোন কেনার সুযোগ পাচ্ছে ক্রেতা দেশগুলো। পাশপাশি এগুলো ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না- এমন শর্তের ঝামেলাও নেই। এজন্যই চীন থেকে কেনাটা শ্রেষ্ঠ বিকল্প।"
- সূত্র: ব্লুমবার্গ