সুয়েজ সচল ফের, কিন্তু বৈশ্বিক বাণিজ্যে নয়া চাপের শুরু
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আটকে থাকার পর সুয়েজ খালে কনটেইনারবাহী জাহাজ 'এমভি এভার গিভেন' কে সরানো হয়েছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যিক নৌপথ পুনরায় সচল হয়ে উঠলেও করোনায় আগে থেকেই বিধ্বস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি পুরোদমে শুরু হতে সময় লাগবে।
যুক্তরাজ্যের চেম্বার অফ শিপিংয়ের ডিরেক্টর অফ পলিসি পিটার আইলট বলেছেন, 'এখনি উল্লাসে ফেটে পড়ার মত কিছু হয়নি। পুরো খাল সচল হয়ে উঠতে এখনও অনেকদিন লেগে যাবে"।
সপ্তাহান্তে পুনরায় চালুর ফলে এখন জাহাজ, বন্দর, ট্রাক, ট্রেনের মাধ্যমে গুদাম হতে কারখানা ও বাজারে পণ্য সরবরাহের যে শৃঙ্খল রয়েছে,তার ওপর একযোগে চাপ সৃষ্টি হবে।
ভুলে গেলে চলবে না, বর্তমানে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তার কথা। গ্রাহক অনলাইনে অর্ডারের পর সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে পণ্য পেতে চায়। এটি পরিবহন প্রক্রিয়ার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে, পরিবহন ব্যয়ও ক্ষেত্রবিশেষে বাড়িয়ে তুলেছে।
বিশ্বের প্রায় ৬ হাজারের অধিক কন্টেইনার প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সমুদ্রপথে পাড়ি দিচ্ছে, ফলে সুয়েজের মত প্রধান ধমনীর প্রবাহে ক্ষুদ্র একটি ব্লকের সৃষ্টিও, মহাবিপর্যয় টেনে আনতে সক্ষম।
এসব পরিবাহিত পণ্যের অনেকগুলোই দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পন্ন দেশ হতে রপ্তানি হয়ে থাকে। পরিবহন পথে সৃষ্ট আকস্মিক দুর্যোগে এসব পণ্যকে চাইলেও অন্য কোথাও প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। সমুদ্রযানের গতি বাড়িয়ে কখনো হয়তো সাময়িক প্রশমনের ব্যবস্থা করা যায় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল নয়, এমন দেশ বা প্রতিষ্ঠানের অর্ডার বাতিল করে দেয়া হয়। সুয়েজের ঘটনা এবার এমন অনেক দুর্ঘটনার জন্ম দিতে চলেছে।
কন্টেইনার পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠানের কৃপার ওপর নির্ভর করছে কার্গোর মালিক থেকে শুরু করে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত।
আসন্ন শীত চাহিদার কথা মাথায় রেখে নিকট ভবিষ্যতে সুয়েজে সৃষ্ট এই জাহাজের জট ইউরোপীয় গ্যাসের ক্রেতাদের মজুত যোগাতে বাঁধা দেবে। ইবিডব্লিউ অ্যানালিটিকসের প্রধান নির্বাহী অ্যান্ডি ওয়েসম্যানের ধারণা, এটি মার্কিন গ্যাস রপ্তানিকারকদের বাজারের শেয়ার দখলের সুযোগ নিয়ে উপস্থিত হবার একটা ক্ষেত্র তৈরী করতে পারে।
শস্য ও ধাতব পণ্য বহনে ব্যবহৃত বাল্ক জাহাজের ফ্রেইট রেটও এতে বেড়ে যেতে পারে।
এদিকে, চীনা এক প্রতিষ্ঠানের লজিস্টিক এক্সিকিউটিভ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন যে, ইউরোপের কোন কাজ জমে থাকা মানে হলো বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর এর দীর্ঘতর প্রভাব পড়তে যাচ্ছে।
একটি ৭৪৭
স্পিডাফ লজিস্টিকস লিমিটেডের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ম্যাক্স ওয়েই বলেছেন, মহামারীজনিত কারণে বন্দরগুলো আগে থেকেই জাহাজের জট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল, এবারের এই সমস্যায় তাদের একইসাথে অনেকগুলো বিলম্বিত জলযান সামলাতে হবে"।
তিনি বলেন, সবচেয়ে কম করে হিসেব করলেও অন্তত মাসখানেক লাগবে যানগুলোর স্বাভাবিক চলাচল শুরু হতে।
সমুদ্রপথে চালানের এসব সীমাবদ্ধতা আমলে নিয়ে আমদানি-রপ্তানিকারকেরা ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও এখন আগের চাইতে বেশি মাত্রায় অন্যান্য মাধ্যমের প্রতি ঝুঁকবেন।
হংকং-ভিত্তিক লজিস্টিক এক্সিকিউটিভ ভিভিয়ান লাও বলেছেন, সুয়েজের সমস্যা মিটে যাবার পর বিমানের মাধ্যমে পণ্য চালানের চাহিদা বাড়বে। অনলাইন শপিং এবং সুলভ কন্টেইনারের ঘাটতির কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হুড়োহুড়ির প্রতিযোগিতা লেগেই থাকবে।
প্যাসিফিক এয়ার হোল্ডিংসের ভাইস চেয়ারপারসন এবং সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লাও বলেছেন, "গত সপ্তাহের শেষে আমি পুরোটা সময় কিছু ৭৪৭ (কার্গো এয়ারক্র্যাফট) খোঁজার চেষ্টা করেছি। আমি তা কেবল একটি পেয়েছি, একাধিক নয়"।
ঘটনাক্রমে চাহিদার প্রসঙ্গ ওঠায় আবুধাবির ইতিহাদ এয়ারওয়েজ সাময়িকভাবে একটি পঞ্চম মাত্রার বোয়িং জেটলাইনকে আপাতত কার্গোর দায়িত্বে নিয়োজিত করেছে।
আসলে সুয়েজ খালের অচলতা ছাড়াই বিমানপথে চালানের ওপর আস্তে আস্তে চাপ বাড়ছিল, লাও সেটির পক্ষে যুক্তি স্থাপনের কেবল আরেকটি উপলক্ষ পেলেন আর কী!
তিনি বলেন, "আপনি কেবল দুনিয়ার এক প্রান্তে বসে ভাববেন যে, সব ঘড়ি ধরে নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে, আপনাকে নিজস্ব মজুতের ব্যবস্থা করতে হবে না, সব কিছু যথাসময়ে আপনার দোরগোঁড়ায় এসে পৌঁছে যাবে, তাহলে আপনার ধারণা ভুল"।
"সুয়েজ খালের অবরুদ্ধতা আমাদের আরেকবার সেটিই মনে করিয়ে দিল"।
বিকল্প রেলপথ
ডিবি কার্গো ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সদস্য সিগ্রিড নিকাতা বলেছেন, জলপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে রেল আরেকটি বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
সোমবার ব্লুমবার্গ টেলিভিশনকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "কোভিডের সময় আমরা দেখেছি যে সড়কপথে ব্যারিকেড দেয়া থাকলেও ট্রেন ঠিকই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যেতে পেরেছে। সুতরাং যখন সমুদ্রপথ অবরুদ্ধ, তখনও কিন্তু এই ট্রেনই কাজে আসতে পারে"।
সুয়েজের সাম্প্রতিক এই বিপর্যয়ের প্রভাব ইউরোপ এবং এশিয়া উভয় মহাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।
নর্থ ক্যারোলাইনা ভিত্তিক প্রিমিয়ার ইনকর্পোরেশন শার্লটের চার হাজারেরও অধিক হাসপাতালকে চিকিৎসা পণ্যক্রয় এবং সরবরাহ পরিচালনায় সহায়তা করেছে। গত বছর, মহামারীতে বিপুল চাহিদার ফলে গ্লাভস, গাউন এবং মাস্কের মত সামগ্রীর সংকট দেখা দেয়। সংকট বাড়তে থাকায়, মার্কিন হাসপাতাল এবং চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব পণ্যের মজুতের ব্যাপারে বেশ সতর্ক ছিলেন।
প্রিমিয়ারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড হারগ্রাভস বলেছেন, "অনেক পণ্যের জন্যই সুয়েজ খাল নিরাপদ যোগানের নিশ্চয়তা দিতে অক্ষম। সুয়েজের এবারের ঘটনা সেটিরই ধারাক্রম- মেডিক্যালের প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রীর অন্যতম প্রধান উপাদান রেজিনের সরবরাহ বিলম্বিত হতে যাচ্ছে সুয়েজের জাহাজ জটে আটকা পড়ে। আমাদের সংস্থা তাই ইতিমধ্যে হাসপাতালগুলোকে আসন্ন সঙ্কটের জন্য সতর্কতা গ্রহণ করতে বলেছে"।
(সংক্ষেপিত)