এক ফলের জন্য পাগল ছিল ইউরোপীয়রা
মধ্যযুগে অদ্ভুত এক ফলের জন্য পাগল ছিল ইউরোপীয়রা। এ ফলটি কেবল পচা অবস্থায় খাওয়া যেত। তারপর সবাই এর কথা বেমালুম ভুলে গেল। কেন এই ফল এত পছন্দ করত ইউরোপীয়রা? কেনই বা ফলটি হারিয়ে গেল?
২০১১ সালে একটি রোমান শৌচাগারে অস্বাভাবিক এক জিনিস পেলেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
দলটি ট্যাসগেটিয়াম (বর্তমানে ইসেঞ্জ, সুইটজারল্যান্ড) নামক এক প্রাচীন গ্রামে খননকাজ চালাচ্ছিল। গ্রামটি শাসন করতেন এক কেল্টিক রাজা। রাইনের তীরে গড়ে ওঠা ট্যাসগেটিয়াম তৎকালে অত্যন্ত সচল বাণিজ্যপথ ছিল। গ্রামটির ধ্বংসাবশেষ এখনও জলা অঞ্চলে রয়ে গেছে। শত বছর আগেই যে ধ্বংসাবশেষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, অক্সিজেনবিহীন জলাময় পরিবেশে থাকার কারণে তা আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।
পরিচিত খাদ্যের মধ্যে পাওয়া গেছে বরই, চেরি, কিশমিশ, পিচ ও আখরোটের অবশেষ। এছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিকরা বেশ বড় বড় ১৯টি অদ্ভুত বীজ পেয়েছেন। প্রায় ২ হাজার বছর রাখা হলেও, বীজগুলো প্রায় তাজা অবস্থায়ই পাওয়া গেছে। কিন্তু ওগুলো যে কীসের বীজ, তা-ই চেনা যাচ্ছিল না।
যাহোক, পরে জানা যায়, এই ফলটি বর্তমানে মেডলার (মেডলার) নামে পরিচিত। কিন্তু ৯০০ বছর আগে এর নাম ছিল 'উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশ' (open-arse)। এই নামকরণের কারণ ফলটির বৃতি বা নিচের অংশের গঠন। ফ্রান্সে এর নানা নাম রয়েছে—'la partie postérieure de ce quadrupede' (চারপেয়ে প্রাণীর পশ্চাদ্দেশ), 'cu d'singe' (বানরের নিতম্ব), 'cul de chie' (কুকুরের পশ্চাদ্দেশ)।
তবু মধ্যযুগে গোটা ইউরোপ এই ফলের জন্য পাগল ছিল।
মেডলারের নাম প্রথম পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীর একটি গ্রিক কবিতায়। ধারণা করা হয়, ফলটি দক্ষিণ ফ্রান্স ও ব্রিটেনে নিয়ে এসেছিল রোমানরা। ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে, শার্লমেন একে রাজার বাগানে যেসব গাছ থাকা বাধ্যতামূলক, সে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। এর প্রায় ২০০ বছর পর, আইনশামের ইংরেজ মোহান্ত এবং লেখক অ্যালফ্রিক ফলটির নাম প্রথম জনসম্মুখে প্রকাশ করেন।
এরপর থেকে ক্রমেই ফলটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। মধ্যযুগীয় মঠ ও রাজকীয় বাড়িগুলোর পাশাপাশি সাধারণ বাড়ির বাগানেরও প্রধান গাছ হয়ে ওঠে এটি।
চসারের 'ক্যান্টারবেরি টেলস', শেকস্পিয়রের 'রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট' এবং রানির সখি ব্রিটানির অ্যানের 'বুক অফ আওয়ারস'-এও এ ফলের উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তম হেনরি হ্যাম্পটন কোর্টে মেডলার লাগিয়েছিলেন। ফ্রান্সের রাজাকেও এ ফল উপহার দিয়েছিলেন তিনি।
সতেরো শতকের প্রথম দশকে ফলটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে। সে সময় ইংল্যান্ডের সর্বত্র এর চাষ হতো। এরপর ক্রমেই এর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। জনপ্রিয়তা কমে গেলেও, ২০ শতকের গোড়ার দিকেও ফলটি ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল।
তারপরে ১০৫০ এর দশকে আচমকা ফলটির কথা বেমালুম ভুলে যায় লোকে।
একসময়ে প্রতি ঘরে যে ফল লাগানো হতো, এখন সেই মেডলার জন্মানো হয় অতীতের বিলুপ্ত ফলের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।
হারিয়ে যাওয়ার কয়েক দশক পর প্রায় সব সবজিওয়ালার কাছেই ফলটি অচেনা হয়ে যায়। ১৯৮৯ সালে, একজন আমেরিকান গবেষক লিখেছেন, একশো জনে একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানীও আজ সম্ভবত মেডলার দেখে চিনতে পারবেন না। ব্রিটিশ সুপারমার্কেটের কোথাও এ ফল বিক্রি করা হয় না। অথচ মধ্যযুগে এই ফলের জন্যই রীতিমতো উন্মাদ ছিল গোটা ইউরোপ। কেন? আর ফলটি হারিয়েই বা গেল কেন?
মেডলারের জন্ম কোথায়, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে কারও কারও বিশ্বাস, প্রায় ৩ হাজার বছর আগে পশ্চিম এশিয়ায় কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে এই ফল ফলত। ওই অঞ্চলে আজও হরেক পদের মেডলার জন্মে।
'মেডলার' এবং 'উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশ' দিয়ে মেডলার ফল এবং ফলটি যে গাছে জন্মায়—মেসপাইলাস জার্মানিকা—দুটোকেই বোঝানো হয়। গাছটি গোলাপ, বুনো আপেল ও নাশপাতির নিকটাত্মীয়। গোড়ায় বাঁকা, মোচড়ানো শাখা এবং শামিয়ানার মতো ছড়ানো লম্বা পাতাওয়ালা গাছটি শুধু ফলের জন্যই বিখ্যাত ছিল না—বিখ্যাত ছিল এর সৌন্দর্যের জন্যও। প্রতি বসন্তে নিয়মিত বিরতিতে এতে তারকাকৃতির ফুল ফোটে। শরতে গাছটি সবুজ, হলুদ, বাদামি ও টকটকে লাল রঙে ছেয়ে যায়।
মেডলার ফল বেশ কয়েকটি কারণে অস্বাভাবিক। প্রথম কারণ, এই ফল গাছ থেকে পাড়া হয় ডিসেম্বরে। মধ্যযুগে শীতকালে চিনির উৎস ছিল খুবই কম। সেই স্বল্প উৎসের একটি ছিল মেডলার। দ্বিতীয় কারণ, এই ফল পচার পরই কেবল খাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে।
সবজেটে বাদামি বর্ণ ধারণ করার পর গাছ থেকে ছেঁড়া হয় মেডলার। তখন একে দেখতে লাগে অদ্ভুত আকারের পেঁয়াজ বা খেজুরের মতো। গাছ থেকে পাড়ার পর সরাসরি এগুলো খেলে আপনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ১৮ শতকের এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, এর ফলে ডায়রিয়া হয়। তবে পাড়ার পর যদি মিহি কাঠের গুঁড়ো বা খড়ের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ রেখে দেয়া হয়, তাহলে মেডলার ধীরে ধীরে কালো ও শক্ত হয়ে যায়। বেক করা আপেলের মতো নরম হয়ে যায় ফলটি।
এ সময় মূলত ফলের এনজাইমগুলো জটিল কার্বোহাইড্রেটকে ফ্রুক্টোজ এবং গ্লুকোজ জাতীয় সরল শর্করা হিসাবে ভেঙে দেয় এবং এতে ম্যালিক অ্যাসিড বেড়ে যায়। এদিকে তিক্ত স্বাদের জন্য দায়ী ট্যানিনগুলোর পরিমাণ কমে যায়। ফলে মেডলার পরিণত হয় অদ্ভুত স্বাদযুক্ত অতি মিষ্টি এক ফলে। ঠিকমতো পাকলে এই ফল অত্যন্ত সুস্বাদু লাগে খেতে।
তবে পচিয়ে খেতে হতো বলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার সময়ও ফলটি নিয়ে নানা বৈরী মতবাদ প্রচলিত ছিল।
১৯৮৯ সালের এক গবেষণা নিবন্ধে লেখা হয়, 'এটি খেতে পচা আপেলের চেয়ে সামান্য ভালো ছিল। ...পাকার আগে মেডলার খাওয়ার উপযুক্ত হতো না। আর তখন এর স্বাদ হয়ে উঠত জঘন্য।'
সাধারণ মানুষ ফলটি হাতে নিয়ে স্রেফ মুখের ওপর চেপে ধরে আঁশ খেয়ে নিত। অভিজাতদের খাবার টেবিলে একে পনিরের সঙ্গে পরিবেশন করা হতো। ফলগুলোতে তখনও কাঠের গুঁড়োর প্রলেপ লেগে থাকত। অভিজাতরা চামচ দিয়ে আইসক্রিমের মতো সেই ফল খেত। মেডলারকে বেক করা যেত, এ থেকে জেলি বা ব্র্যান্ডি বা সুরাও বানানো যেত।
১৯ শতকের শেষভাগ এবং ২০ শতকের গোড়ার দিকেও শীতের সময় ইউরোপের প্রধান ফলগুলোর একটি ছিল মেডলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার জনসাধারণকে মেডলার খেতে উৎসাহিত করে। কিন্তু এর কদিন পরই ফলটি চিরতরে হারিয়ে যায়।
এর একটি সম্ভাব্য কারণ হলো কলা ও আনারসের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফলগুলো সস্তা হয়ে যায় এবং সারা বছর ধরে চাষ হতে শুরু করে। সেজন্য শীতের সময় মেডলারের চাহিদা ফুরিয়ে যায়। আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হলো, প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কেউ কষ্ট করে মেডলার পাড়তে বাইরে যেতে চাইত না।
ইউরোপে আজও ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় মেডলার গাছ পাওয়া যায়। মেডলারের ঝোপ কখনও গ্রামাঞ্চলে বাগানে বেড়ার কাজ করে তো কখনও বাগানের শোভা বাড়ায়। কিন্তু আলাদা করে মেডলার গাছ হিসেবে একে চেনে খুব কম লোকেই।
তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়।
কাস্পিয়ান সাগরের কাছে, জন্মভূমিতে আজও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে এই ফল। এখনও ইরান, আজারবাইজান, কিরগিজস্তান, জর্জিয়া ও তুরস্কে মেডলারের ব্যাপক চাষ হয়। এ অঞ্চলের বাজারে এটি মুসমুলা নামে বিক্রি হয়।
এই অঞ্চলে গ্রাম্য পথ্য হিসেবেও মেডলার গাছের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উত্তর ইরানের গালান প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে ডায়রিয়া, পেট ফুলে যাওয়া এবং অনিয়মিত ঋতুস্রাবসহ আরও নানা রোগের চিকিৎসায় মেডলার পাতা, ছাল, ফল ও কাঠ ব্যবহার করা হয়।
মধ্যযুগে ইউরোপেও মেডলার গাছের এমন ব্যবহার ছিল। ১৭ শতকের উদ্ভিদবিদ ও ডাক্তার নিকোলাস কার্লপপার লিখেছেন, মেয়েদের ঋতুস্রাব নিয়মিত করতে এবং পেটের অসুখ নিরাময়ে মেডলার খুব উপকারী।
এককালের সর্বজনবিদিত মেডলার আজ ইউরোপের সর্বত্র অচেনা এক ফল। দুই হাজার বছর পর এক রোমান ধ্বংসাবশেষের শৌচাগার থেকে বীজ আবিষ্কৃত হওয়ার পর ফলটি নিয়ে ফের আগ্রহ বাড়ছে মানুষের মধ্যে।
সূত্র: বিবিসি