কর না বাড়িয়েও ব্যয় বাড়ানোই আগামী বাজেটের লক্ষ্য
করোনা মহামারির কবল থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কর না বাড়িয়ে ঋণ করে সরকারের ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আগামী অর্থবছরের জন্য ৬,০২,৮৮০ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণের মাধ্যমে দারিদ্রের হার বাড়ার ক্ষেত্রে লাগাম টানা এবং চলমান প্রণোদনা কর্মসূচি অব্যাহত রেখে শিল্পখাতে চাঙ্গাভাব বজায় রেখে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষমাত্রা স্থির করা হচ্ছে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে।
এবারই প্রথমবার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে না। বরং জিডিপির অনুপাতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন অর্থবছরের ফলে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নতুন করে বাড়তি করারোপের প্রয়োজন হবে না রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটির।
তবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর বহির্ভূত আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। মূলত স্বশাসিত করপোরেশনগুলোর সঞ্চয় থেকে বাড়তি অর্থ সংগ্রহ করা ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ২জি ও ৪জি স্প্রেকট্রাম নিলাম হওয়ায় সেখান থেকে বাড়তি অর্থ পাওয়ার আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এছাড়া, মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের মনোবল বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে নতুন অর্থবছরের বাজেটে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে রবিবার 'বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটি'র ভার্চুয়াল সভায় প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার।
ওই সভায় উপস্থিত থাকা সরকারের একাধিক নীতি-নির্ধারক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সভায় অর্থসচিব বলেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর কৌশল আগামী অর্থবছরও অব্যাহত রাখা হবে।
"২০২১ সালের মার্চ হতে দেশে করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হওয়ায় চলমান লকডাউনের প্রভাবে অর্থনীতি কিছুটা ব্যাহত হবে। এ প্রেক্ষাপটে বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া হবে। এছাড়া, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ ও প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা হবে। করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন এবং এক্সপানশনারি ফিসক্যাল পলিসি সহায়ক কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকায় সামনের দিনগুলোতে উন্নয়ন ব্যয়সহ সার্বিক সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়তে পারে," সভায় বলেন আব্দুর রউফ তালুকদার।
"করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ মোকাবেলায় বর্তমানে চলমান লকডাউনের কারণে আয়কর ও মূল্য সংযোজন করসহ অন্যান্য উৎস হতে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নতুন করে নিম্নমুখী প্রবণতা তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সার্বিকভাবে রাজস্ব আহরণ শ্লথ হওয়ার পাশাপাশি সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এতে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে। তবে এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে বিশেষ কোন ঝূঁকি নেই। কারণ, দেশের সরকারি ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখনো যথেষ্ঠ অনুকূলে রয়েছে"- যোগ করেন তিনি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এনবিআরের রাজস্ব লক্ষমাত্রা না বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না বাড়লে রাজস্ব বাড়বে না। তাই আগামী বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা না বাড়ানো সুবিবেচনার লক্ষণ বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসান বলেন, পরবর্তী বাজেটে প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিৎ সকলের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা। এর বাইরে, স্বাস্থ্যখাতের বিদ্যমান দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা উচিৎ।
ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, কল-কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য উত্সাহদায়ক উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারটি বাজেটে থাকা উচিৎ। দরিদ্রদের খাদ্য ও নগদ সহায়তা এবং শ্রমঘন ছোট কারখানায় আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি জানান, বাজেটের আকার না বাড়িয়ে শুধু পুনঃগঠনের মাধ্যমেই এসব খাতে অর্থায়ন করা সম্ভব। বাজেটে কিছু ঘাটতি থাকলেও আগে অধিক অগ্রাধিকারের খাতগুলোতে অর্থায়ন নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি।
ঘাটতি বাজেট বাংলাদেশের জন্য সমস্যা নয় উল্লেখ করে তিনি জাহিদ হোসেন বলেন, "ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য বিরাজ করছে। সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাতও বেশ কম। অন্যান্য দেশের পাশাপাশি স্থানীয় উৎস থেকেও ঋণ করার সুযোগ রয়েছে সরকারের। সঠিক প্রোগ্রাম প্রণয়ন করা গেলে বিদেশি সংস্থা থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে," যোগ করেন তিনি।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩.৩০ লাখ কোটি টাকা, যা ছিল জিডিপির ১০.৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে এটি মাত্র ৭৮ কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে, যা জিডিপির ৯.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩,০১,০০২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯.৭ শতাংশ।
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনার কারণে এবছর আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি আদায় সম্ভব হবে না। তাই আগামী বাজেটে কোনভাবেই ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি লক্ষ্য নির্ধারণ করা ঠিক হবে না।
আগামী বাজেটে 'ভ্যাকসিন সাপোর্ট ফান্ড' নামে একটি তহবিল গঠন করবে সরকার, যেখানে বাজেট থেকে বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক উৎস থেকে দুই বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৭,০০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা পাওয়ার আশা করছে সরকার। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে নতুন অর্থবছর দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক সকল নাগরিককে কোভিড ভ্যাকসিন দেওয়ার ঘোষণা থাকছে নতুন বাজেটে। এছাড়া, বাজেট সাপোর্ট হিসেবে উন্নয়ন সহযোগি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সাপোর্ট পাওয়ার প্রত্যাশা থাকছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ২৩,৫০০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রণালয় বলছে, গত বছরের জুলাই থেকে দেশে বিদ্যুতের ব্যবহার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বাড়ছিল, গ্যাসের ব্যবহারও প্রাক মহামারি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। চট্টগ্রাম পোর্টের মাধ্যমে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়েছে। চলতি অর্থবছর শেষে রপ্তানিতে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে অর্থবিভাগকে জানিয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো।
বোরোর বাম্পার ফলন আশা করে নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশ প্রাক্কলন করতে যাচ্ছে অর্থমন্ত্রণালয়। কর্মকর্তারা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেলের মূল্য ৬০-৮৫ ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতির লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৪ শতাংশ, যদিও চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফেব্রুয়ারির শেষে ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৬ শতাংশ।
প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখা বিভিন্ন সূচকের পর্যালোচনা করে অর্থবিভাগ মনে করছে, চাহিদার দিক থেকে প্রবৃদ্ধির সঞ্চালকগুলো ভালো অবস্থায় রয়েছে। প্রবাসী আয়, আমদানি-রপ্তানি, কৃষি ঋণ বিতরণ ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ইতিবাচক অগ্রগতি রয়েছে। ডিসেম্বর শেষে মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের উৎপাদন সূচকের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৮২ শতাংশ। তবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও এডিপি বাস্তবায়নে ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
"আগামী তিন বছর ধরে ধীরগতির প্রবৃদ্ধি আশা করছি। তবে চলতি অর্থবছর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর প্রাক্কলনের চেয়েও বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। সংশোধিত বাজেটে ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। আগামী অর্থবছর এটি বেড়ে ৭.২ শতাংশ এবং পরের দুই বছরে পর্যায়ক্রমে বেড়ে ৭.৬ ও ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে," সভায় বলেন অর্থ সচিব।
চলতি অর্থবছরের এডিপি ব্যয় সন্তোষজনক না হলেও, পরবর্তী বাজেটে ২.২৫ ট্রিলিয়ন টাকা এডিপি বরাদ্দ নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ- সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যা ২৮ কোটি টাকা বেশি।
এই বরাদ্দও জিডিপির ৬.৫ শতাংশ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি।
যদিও চলতি বাজেটে জিডিপির বিপরীতে এডিপি বরাদ্দের সমান অনুপাত রয়েছে। তবে অর্থ বিভাগের আশঙ্কা, বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশ ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত অব্যবহৃত থাকবে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৯৯৮ ট্রিলিয়ন টাকা, যা জিডিপির ৬.৪ শতাংশ।
তবে সভায় অর্থ সচিব বলেন, মহামারি সৃষ্ট সংকট বেশিরভাগ উন্নয়নমূলক কাজকে বাধাগ্রস্থ করেছে যা বছরের শেষ দিকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার কমিয়ে আনতে পারে।
যদিও সরকার ঘাটতি আরও বাড়িয়ে ব্যয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করেছে, চলতি অর্থবছরের তুলনায় আসন্ন বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা সঙ্কুচিত হবে বলে জানা গেছে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৫.৬৮ ট্রিলিয়ন টাকা, যা জিডিপির ১৭.৯ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরে জিডিপির ১৭.৩ শতাংশ ব্যয় করবে সরকার।
অর্থ বিভাগ এবছরের জন্য সংশোধিত বাজেট নির্ধারণ করেছে ৫৩.৩৯ ট্রিলিয়ন টাকা।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, "মহামারিজনিত কারণে গত অর্থবছর থেকে একটি সম্প্রসারণযোগ্য আর্থিক নীতি আশা করা হয়েছিল যা উন্নয়ন ব্যয় বাড়িয়ে তুলবে। প্রয়োজনে বাজেটের ঘাটতিও বাড়বে,"
"সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে অর্থ জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে, একারণে জনগণের বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রবাহকে পুণরায় জোরদার করতে হবে," যোগ করেন তিনি।