ভারতের সামনে আরও কঠিন দুই সপ্তাহ
কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের ভিড়ে ভারতের হাসপাতালগুলোর ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করেছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের "অধিক সংক্রামক এবং সম্ভবত বহুগুণে প্রাণঘাতী" নতুন ধরন বা ভ্যারিয়েন্টের কারণেই উচ্চ হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভারত সরকারের উপদেষ্টা মুম্বাইয়ের চিকিৎসক ডাক্তার জাকির ওদওয়াদিয়া বিবিসির টুডে'র কাছে বলেন, "অন্যান্য চিকিৎসকদের মতো আমার কাছেও একটি বিষয় পরিষ্কার তা হল, প্রথম ওয়েভের তুলনায় খুব সম্ভবত নতুন ভ্যারিয়েন্ট-উদ্ভূত দ্বিতীয় ওয়েভ অধিক সংক্রামক এবং আগের চাইতেও অনেক বেশি প্রাণঘাতী।"
"আমি বয়সে তরুণ রোগীদের ভুগতে দেখছি। মাত্র একদিন আগে আমি ৩৫ বছর বয়সী দুজনকে হারিয়েছি। যুগল এই স্বামী-স্ত্রীকে ভেন্টিলেটর সুবিধা দিয়েও বাঁচাতে পারিনি," বলেন তিনি।
সোমবার করোনায় বিপর্যস্ত দেশটির রাজধানী দিল্লিতে ধারণকৃত একটি ভিডিওতে দেখা যায় যে, দাহের অপেক্ষায় রাস্তার ধারে সারি সারি লাশ সাজানো হয়েছে। হঠাৎ করেই মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় অন্তিম ক্রিয়ায় ব্যস্ত কর্মচারীরা দিনরাত এক করে কাজ করছেন।
উদ্যান, গাড়ি রাখার জন্য বরাদ্দ স্থান, খেলার মাঠ সর্বত্র অস্থায়ী শ্মশান গড়ে তোলা হয়েছে।
এদিকে, চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ হাইকোর্ট স্থানীয় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা ব্যতীত সমাবেশের অনুমতি প্রদানের জন্য হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা উচিত বলে তিরস্কার জানিয়েছেন।
কর্মকর্তাদের ভর্ৎসনা জানিয়ে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব ব্যানার্জি এবং বিচারপতি সেনথিলকুমার রামামূর্তির বেঞ্চ বলেন, "আপনাদের উপর সম্ভবত হত্যা মামলা দায়ের করা উচিত।"
ভারতে নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে বিশ্বের সবথেকে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে, প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা এখনো কাজ করে চলেছেন।
টানা পাঁচদিন ধরে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের উপর ছিল। সোমবার সর্বোচ্চ শনাক্তের পরই তা তিন লাখ ২৩ হাজার ১৪৪ জনে নেমে আসে। তবে, ধারণা করা হচ্ছে শনাক্তকরণ পরীক্ষা কমে যাওয়ার কারণে কাগজে-কলমে সংক্রমণ হার কম পাওয়া গেছে।
প্রায় ১৩০ কোটির বেশি মানুষের দেশটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নিয়েও সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে অক্সিজেন সংকট। অন্তিম ক্রিয়া সেবাদানকারীরা স্থান দিতে না পারায় অস্থায়ী ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে গণকবর এবং শবদাহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশজুড়ে বিভিন্ন শহর এবং অঙ্গরাজ্যে কঠোর লকডাউন আরোপ করা হয়েছে।
মে মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়েছে। এছড়া ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমাবেশের উপরেও আরোপ করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। নিত্যপ্রয়োজনীয় নয় এমন সকল খুচরা দোকানও বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হুট করে লকডাউন আরোপ করায় বিভিন্ন শহরে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মাত্রাতিরিক্ত কেনাকাটা শুরু করেছেন। সামাজিক দূরত্ব না মেনে কিংবা মাস্ক পরিধান ব্যতীতই দোকানে হামলে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
শয্যা সংকটের কারণে ভারত ট্রেনের বগিকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রূপান্তর করেছে।
আকাশপথে বিভিন্ন রাজ্যে অক্সিজেন ট্যাংক সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া, বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমেও রেলপথে দেশের অভ্যন্তরে চলছে অক্সিজেন সরবরাহ।
সংক্রমণ সংখ্যা তীব্র হওয়ায় ভারতের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা হিমশিম খেয়ে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহায্যের জন্য চলছে হাহাকার।
বর্তমানে ভারতে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৫৪১টি। এসব মেডিকেলে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৬ হাজার। ডাক্তারদের সংগঠনের হিসাব অনুসার্ অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে এই শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে নবাগত এই চিকিৎসকরা প্রধান ঢাল হিসেবে কাজ করছেন। তবে এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা নামমাত্র বেতনে অতিরিক্ত চাপের মধ্য দিয়ে সেবা প্রদান করে আসছেন। এমনকি, ভাইরাস সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকির মাঝে থাকছেন এই মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। সেই সাথে উপেক্ষিত হয়ে আসছে তাদের একাডেমিক কার্যক্রম।
করোনায় বিপর্যস্ত ভারতের পাঁচ রাজ্যে আন্দোলন করেছেন এই স্নাতকোত্তর চিকিৎসকরা। প্রশাসনের এই আচরণকে হেঁয়ালিপূর্ণ হিসেবে দেখছেন তারা। এছাড়া, বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি বলেও অভিযোগ তুলেন শিক্ষার্থীরা।
ভারত মোট জিডিপির মাত্র ১.৩ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে থাকে। অন্যান্য বৃহদাকার অর্থনীতির দেশের তুলনায় এই হার সামান্য। প্রাথমিকভাবে ভারতকে মহামারি-প্রবণ করে তোলার পেছনে স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতাকেই প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। যদিও, মহামারি হানা দেওয়ার পরবর্তী মাসগুলোতে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ গৃহীত হয়।
এদিকে, কোভিড ভুক্তভোগীদের পরিবার পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা দানে ব্যর্থতার দায়ে চিকিৎসকদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। ভারতে চিকিৎসকদের উপর হামলার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বুধবার পুনে শহরের প্রাইম হাসপাতালের বাইরে ধারণকৃত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় যে, কোভিড আক্রান্ত রোগীকে বাঁচাতে না পারায় ধাতব দন্ড দিয়ে ২৫ বছর বয়সী চিকিৎসক সিদ্ধান্ত তোতলার উপর আক্রমণ চালায় ভুক্তভোগী পরিবার।
১৫ থেকে ২০ সদস্যের দলটি পরিবারের প্রিয়জনকে হারানোর পর ক্ষুদ্ধ হয়ে নির্মমভাবে তরুণ এই ডাক্তারের উপর আক্রমণ করে।
অপর এক ভিডিওতে দেখা যায়, অক্সিজেন ও ভেন্টিলেটর সংকটে রোগীকে বাঁচাতে হাসপাতালের কর্মচারীরা রোগীর বুকে চাপ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন।
এদিকে, শ্মশানে জায়গা না পেয়ে অনেক পরিবার প্রিয়জনকে নিজ বাড়ির আঙ্গিনাতেই দাহ করছে। শব পোড়ানোর ইলেকট্রিক চুল্লিগুলোও অতিরিক্ত চাপের কারণে অকেজো হতে শুরু করছে।
সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। শীর্ষ ভাইরোলজিস্টরা বলছেন যে, দ্বিতীয় ঢেউ আরও দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বজায় থাকবে। এর মধ্যে দৈনিক সংক্রমণ হার সর্বোচ্চ পাঁচ লাখের উপর পৌঁছাবে বলেও সতর্ক করেছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, শীতের মৌসুমে দৈনিক সংক্রমণ হার ১০ হাজারে নেমে আসায় ভারতীয়দের মধ্যে আত্মপ্রসন্নতার সৃষ্টি হয়। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এ ধারণা থেকেই সচেতনতা হ্রাস পায়। এমনকি কর্তৃপক্ষও নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে গণ-জমায়েতের অনুমোদন দেয়।
ভারতে প্রতি লাখ করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে বর্তমান মৃত্যুহার ১.১৪ শতাংশ। অর্থাৎ, দেশটি যদি অনুমানকৃত সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ডে পৌঁছে, তাহলে দৈনিক মৃতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ হাজার ৭০০ তে গিয়ে দাঁড়াবে।
- সূত্র: ডেইলি মেইল