পরীক্ষা কমায় কমেছে শনাক্তও
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ১৩ মাসে একটি ল্যাবের পরিবর্তে বর্তমানে দুইশোর বেশি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু তারপরও করোনা পরীক্ষার হার এখনো কম। টেস্ট করতে মানুষের ভোগান্তি ও অপেক্ষা আগের মতোই আছে।
টেকনোলজিস্ট সংকট ও ল্যাবরেটরিতে কর্মরত জনবলকে কাজে উদ্বুদ্ধ করতে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে টেস্টের হার বাড়ানো যাচ্ছেনা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বেশি বেশি টেস্ট করতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেট করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "এখন টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে দ্রুত অধিক মানুষকে শনাক্ত করে আইসোলেটেড করতে পারলে লকডাউনের সুফল পাওয়া যাবে। ঢাকার সব হাসপাতালে অ্যান্টিজেন টেস্ট চালু করা গেলে রোগীদের ভোগান্তি কমবে।"
বর্তমানে দেশে ২৫৭টি ল্যাবে করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১২১টি ল্যাবে আরটি–পিসিআর পদ্ধতিতে টেস্ট হচ্ছে। আর যক্ষ্মা শনাক্তে ব্যবহৃত জিন এক্সপার্ট পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হচ্ছে ৩৪টি কেন্দ্রে। আর ১০২ টি স্থানে অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হচ্ছে। তবে এর মধ্যে ৩০টির বেশি ল্যাবে প্রতিদিন টেস্ট হয়না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "আরটি-পিসিআর ল্যাবগুলো এখন সক্ষমতার সর্বোচ্চ টেস্ট করছে। টেকনোলজিস্ট সংকট ও ব্যবস্থাপনা সংকটের কারণে টেস্টের সংখা বাড়বে না বরং কমবে। এক বছরের বেশি সময় ধরে পিসিআর ল্যাবে যারা কাজ করছেন তারা কোন ধরণের প্রণোদনা, যাতায়াত সুবিধা বা এক বেলার খাবারের সুবিধাও পাচ্ছেননা। জনবল নেই, কয়েকজনকেই অনেক কাজ করতে হয়, তাই সবাই ক্লান্ত হয়ে গেছে। টেস্ট বাড়াতে হলে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে ও যারা এখন কাজ করছেন তাদের যাতায়াত-খাওয়ার ব্যবস্থা বা প্রণোদনা দিতে হবে।"
ডা জাহিদুর রহমান বলেন, "করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট অনেক সংক্রামক। আমরা দেখছি একজন শনাক্ত হওয়ার পরদিনই পরিবারের তিন-চারজন কোভিড পজিটিভ হচ্ছেন। তাই বেশি বেশি টেস্ট করে সংক্রমিত ব্যক্তিকে আইসোলেট করতে হবে। এখন অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এতে অল্প সময়ে রিপোর্ট পাওয়া যাবে।"
দেশের ৩৪টি জেলায় করোনার আরটি-পিসিআর ল্যাব নেই। এখন যে ১২১টি আরটি-পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা চলমান, এর ৬৯টি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। সারা দেশে সরকারিভাবে আরটি-পিসিআর ল্যাব রয়েছে ৫২টি।
এখনো টেকনোলজিস্ট সংকট দূর হয়নি
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কোভিড ল্যাবে আট জন টেকনোলজিস্ট আছেন। গত ১৩ মাস ধরে একটানা তারাই কাজ করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোহরাওয়ার্দী ল্যাবের এক টেকনোলজিস্ট দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "ডিপার্টমেন্টের কাজের বাইরে আমাদের ল্যাবে কাজ করতে হয়। লোকবল সংকটের কারণে আমরা কোয়ারেন্টিন মেনে চলতে পারিনা। এমনকি কাজের চাপ বাড়ায় সাপ্তাহিক ছুটিও পাচ্ছিনা। টেস্ট বাড়াতে হলে মেশিন বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষ টেকনোলজিস্ট বাড়াতে হবে।"
করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ ও টেস্টের জন্য ১২০০ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং ১৮০০ মেডিকেল টেকনিশিয়ান পদ সৃষ্টি করে জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য গত বছরের জুনে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের ১০ মাসেও সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হয়নি।
গত বছরের ২৯ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ৮৮৯টি পদ এবং মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের ১৮০০টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। এ দুই পদের বিপরীতে প্রায় ৭৪ হাজার চাকরিপ্রার্থী গত ১২, ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর লিখিত পরীক্ষা দেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ১০ মার্চ মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের মৌখিক পরীক্ষা হয়। কিন্তু চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের এখনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মো. সেলিম মোল্লা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "কোভিড-১৯ সেকেন্ড ওয়েভে যে পরিমাণ রোগীর চাপ বাড়ছে তার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করার টেকনোলজিস্ট সরকারি পর্যায়ে নেই। করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ছয় হাজার নার্স ও দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে। আরও দুই হাজার চিকিৎসকের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ না দেয়া হতাশাজনক। কোভিড টেস্ট বাড়াতে দ্রুত পরীক্ষা নেয়া টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ দিতে হবে।"
পাশাপাশি ২৫০০০ বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।
কোভিড টেস্টে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে শুধু আফগানিস্তানে। আর সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হচ্ছে মালদ্বীপ ও ভুটানে। আফগানিস্তানে প্রতি ১০৫ জনের মধ্যে একজনের কোভিড টেস্ট করা হয়। এর পরের স্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে প্রতি ৩২ জনের মধ্যে একজনের টেস্ট করা হয়। ভারতে যা প্রতি ৫ জনে একজন। শ্রীলঙ্কায় প্রতি ৯ জনে একজনের কোভিড টেস্ট করা হয়। মালদ্বীপ ও ভুটানে প্রতি একজনের বিপরীতে একজন টেস্ট করা হচ্ছে।
নমুনা পরীক্ষা বাড়লে শনাক্ত বাড়ে
দেশে নমুনা পরীক্ষা বাড়লেই রোগী বেড়ে যাচ্ছে আবার নমুনা পরীক্ষা কম হলে শনাক্ত কম হচ্ছে। ৭ এপ্রিল সর্বোচ্চ ৩৪,৬৩০ টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭,৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত একদিন সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা। টেস্টের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি হলেই দৈনিক শনাক্ত ৭ হাজারের বেশি হচ্ছে।
আবার টেস্ট কমলে রোগীর সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে। ১৬ এপ্রিল ১৮,৯০৬টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪,৪২৭ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেস্ট কম হওয়ায় দেশে আসলে কত রোগী আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছেনা।
দেশে প্রথমবারের মতো এ বছরের ১৬ মার্চ এক দিনে ২০ হাজারের বেশি করোনা পরীক্ষা হয়। আর ৪ এপ্রিল প্রথমবারের মতো এক দিনে ৩০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা হয়।
লকডাউনে টেস্টের হার আরও কমেছে
লকডাউনে যানবাহন সমস্যা কারণে ও অনেক মানুষ ঢাকা ছাড়ায় টেস্টের সংখ্যা কমেছে। বুধবার ২৪ ঘণ্টায় কোভিড টেস্ট হয়েছে ২৪,৮২৫টি, আগের দিন যার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ১৯৯৫৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আর শুক্রবার সেটি ১৮,৯০৬ নেমে এসেছে। গতকাল রোববার দেশের ৪৫৯টি ল্যাবে ৫,৪৩০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। গতকাল শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৩৬৩।
লকডাউন শেষে ঢাকার বাইরে থেকে যখন সবাই ফিরবে তখন টেস্টের চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করেন ডা. জাহিদুর রহমান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী বলছে?
দেশে দিনে ৫০ হাজার করোনা টেস্ট করার সক্ষমতা আছে বলে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরমহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।
এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, "টেস্টের পরিধি বেড়েছে এবং টেস্ট করার সক্ষমতাও আছে আমাদের। আমাদের কোন কিট সংকট নেই। ঢাকার হাসপাতালগুলোতেও এখন অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হচ্ছে। মানুষ টেস্ট করতে না আসলে তো কিছু করার নেই। যাদের লক্ষন আছে তারা টেস্ট করাচ্ছেন। যাদের প্রয়োজন হবে টেস্ট করাতে আসলেই আমরা টেস্ট করবো।"
টেকনোলজিস্ট নিয়োগ না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, "টেকনোলজিস্ট নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাই আমাকে সেটি তদন্ত করে দেখতে হবে। এই মহামারিতে তিন হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হলে অনেক উপকার হতো। কিন্তু অভিযোগ যেহেতু উঠেছে তাই তদন্ত করতে হবে। সে কারণে নিয়োগে দেরি হচ্ছে।"