রোজিনার গ্রেপ্তার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত এবং তা বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানরত অন্যান্য সাংবাদিককেও একটি ভীতিকর বার্তা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে আনা সকল দমনমূলক অভিযোগ তুলে নেয়ারও দাবি জানিয়েছে।
রোজিনা ইসলামের সহকর্মীদের বিশ্বাস, দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং কোভিড-১৯ মহামারিতে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রতিবেদন করার কারণেই তাকে হেনস্তা এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সরকারের গোপন নথি সংগ্রহের চেষ্টা ও সেগুলোর ছবি তোলার দায়ে রোজিনাকে দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনের ৩ ও ৫ নং ধারা এবং পেনাল কোডের ৩৭৯ ও ৪১১ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত করা হয়েছে।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। সারা দেশের সাংবাদিকরা এই মুহূর্তে রোজিনার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, 'বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত হয় রোজিনা ইসলামের অপরাধ প্রমাণ করা অথবা তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া এবং দেশের সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেয়া। আর যদি তা না হয়, তাহলে তা সরকারের সর্বোচ্চ একটি ত্রুটিকেই তুলে ধরে।'
তিনি আরও বলেন, 'সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে রাখার পরিবর্তে মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কৌশলের অংশ হিসেবেই মুক্ত গণমাধ্যম চর্চা চালু রাখা উচিত।'
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, রোজিনা ইসলাম গত ১৭মে, ২০২১ তারিখে বিকাল ৩ টা ৩০ মিনিটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবের সঙ্গে মিটিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে তাকে ছয় ঘন্টা একটি কক্ষে আটকে রাখা হয় এবং এই সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর তাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, তিনি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কেনা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রোজিনা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
১৮ মে তার শুনানির পর অন্য এক সাংবাদিকের করা ভিডিও রেকর্ডিংয়ে দেখা যায় রোজিনা বলছেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে আমার করা রিপোর্টের জের ধরেই আমার সাথে এখন অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে।'
রোজিনার করা সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়োগে ঘুষ নেয়া, মহামারিকালে জরুরি চিকিৎসা সেবা সামগ্রী ক্রয়ে অনিয়ম, এয়ারপোর্টে বিদেশ থেকে সাহায্য হিসেবে আসা জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী ১০ মাস ধরে আটকে রাখার মত বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
১৮ মে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পুলিশের ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন নাকচ করে দেয় এবং এর পরিবর্তে রোজিনাকে কারাগারে পাঠায়। রোজিনার জামিনের শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে আজ (২০ মে)।
১৫ জুলাইয়ের মধ্যে রোজিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সেই সাথে কারাগার কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, রোজিনা যেন জাতীয় আইন অনুযায়ী কারাগারে সকল ধরনের চিকিৎসা সেবা পান।
বাংলাদেশ এডিটর'স কাউন্সিল জানিয়েছে, ঔপনিবেশিক আমলের একটি আইন দ্বারা রোজিনা ইসলামকে আটক করা আসলে 'সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করার জন্য কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক আচরণ ও হীন মনমানসিকতার পরিচয়'।
দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস রোজিনার মুক্তির দাবি জানিয়েছে এবং তাদের একজন মুখপাত্র জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মহামারিকালে সরকারের নানা কার্যক্রমের সমালোচনা করায় বাংলাদেশে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার মত ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের ২০ মে মহামারিকালীন কার্যক্রম নিয়ে সরকারের সমালোচনা করায় 'ফেসবুকে গুজব ও ভুল তথ্য ছড়ানো'র দায়ে চারজনকে গ্রেপ্তার ও আরো সাত জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন মুশতাক আহমেদ, যিনি বিচারবিহীনভাবে নয় মাস পুলিশের হাতে আটক থাকার পর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায়ই মারা যান। মুশতাককে নির্যাতন করার অভিযোগও উঠেছিল পুলিশের বিরুদ্ধে।
মুশতাকের মৃত্যুকে ঘিরে দেশে জনসাধারণের তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর একই সময়ে গ্রেপ্তারকৃত আরেক কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে জামিন দেয়া হয়। কিশোর জানান, পুলিশ কাস্টডিতে নেয়ার পর তাকে নির্মভাবে নির্যাতন করা হয়। মুশতাকও একই রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বলে তিনি জানান।
এছাড়াও সরকার কোভিড-১৯ মহামারিকালে যেকোনো 'গুজব' ছড়ানোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সবার উপর নজরদারি বৃদ্ধি করেছে এবং মিডিয়া সেন্সরশিপের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।
গত ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আরো আটটি সংগঠন গণমাধ্যমের উপর হামলা, বিধিবহির্ভূত গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং বিচারবিহীন হত্যা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে জাতিসংঘের হাইকমিশনার মাইকেল ব্যাচেলেটের কাছে চিঠি দিয়েছে।