মালিকদের অর্থ বের করে নেওয়ার সুযোগ দিতে আর্থিক প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ ওয়ান ব্যাংকের
ব্যাংকের ক্ষেত্রে আর্থিক সূচক সংক্রান্ত সংখ্যাকে এক ধরনের রক্ষাকবচ বলা চলে; শুধু গ্রাহকদেরও জন্যই নয়, বিনিয়োগকারীদের জন্যও।
তবে ওয়ান ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের লাভের জন্য সব আর্থিক সূচকের সংখ্যার গড়মিল করে হিসাব প্রকাশ করেছে। এর ফলে ব্যাংকটির ৩০ শতাংশেরও বেশি শেয়ারধারী পরিচালকরা ক্যাশ ডিভিডেন্ট হিসেবে ব্যাংক থেকে আরও বেশি নগদ অর্থ নিতে পারবেন।
বাস্তবে ওয়ান ব্যাংকের নিট লাভ এর প্রদর্শিত নিট লাভের চেয়েও কম, কারণ ব্যাংকটি নিজেদের প্রভিশন ঘাটতির সমন্বয় করেনি। নিট লাভ ঘোষণার আগে মন্দ ঋণের বিপরীতে এই অর্থ জমা রাখতে হয়। কিন্তু ব্যাংক তা না রেখে একে লাভ হিসেবেই প্রদর্শন করেছে।
এর ফলাফল কী দাঁড়িয়েছে? ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ট ঘোষণা করায়, এর অধিকাংশ শেয়ারধারী পরিচালকরা ব্যাংক থেকে আরও বেশি অর্থ নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পেরেছে, এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর সব মৌলিক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে ব্যাংকটি।
তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকটি নিট লাভ, অবন্টিত মুনাফা, মূলধন, শেয়ারপ্রতি আয়, নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) সহ অন্যান্য সূচকের সব সংখ্যায় গড়মিল করে ২০২০ সালের ব্যালেন্স শিট প্রকাশ করেছে।
এসব মিথ্যা তথ্য শনাক্তের পর ব্যাংকটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৫ জুলাই এ নোটিশ পাঠিয়েছে। প্রভিশন ঘাটতির সমন্বয় করে ব্যালেন্স শিট সংশোধনের এবং নোটিশ পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে অন্তত দুটি জাতীয় দৈনিকে সংশোধিত সংখ্যা প্রকাশের জন্য ব্যাংকটিকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যালেন্স শিট সংশোধনের জন্য ব্যাংকটিকে একটি বিশেষ সাধারণ সভা ডাকতে হবে। ব্যাংকটি ব্যালেন্স শিট সংশোধনে ব্যর্থ হলে আইনানুযায়ী এর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আর্থিক জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে।
কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এ শাস্তি দেওয়া হলে ব্যাংকিং আইনানুযায়ী তাকে এই পদ থেকে অপসারণ করা হবে এবং ভবিষ্যতে তাকে কখনো আর অন্য কোনো ব্যাংকের একই পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘনের জন্য ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কেনো কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, কারণ দর্শানোর নোটিশে ব্যাংকটিকে চিঠি পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
ব্যাংকিং আইনের ১০৯ নং ধারা অনুযায়ী, এ ধরনের নিয়ম ভঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যাংককে ন্যূনতম ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার জরিমানা গুণতে হতে পারে।
কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে ব্যাংকটি ইতোমধ্যেই একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সেই ব্যাখ্যা মনঃপুত হয়নি।
ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংককে অন্ধকারে রেখেই ব্যালেন্স শিটে প্রতিটি সূচকের গড়মিল করা হয়, নির্দেশনা অমান্য করা হয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই।
উদাহরণস্বরূপ, গত বছরের লভ্যাংশ ঘোষণার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতি নেয়নি ব্যাংকটি, যা লভ্যাংশ নীতিমালা বিরোধী।
দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রভিশন ঘাটতি থাকলে ব্যাংক কোম্পানি আইনানুযায়ী, নগদ লভ্যাংশ ঘোষণার অনুমতি নেই। একারণে ব্যাংকটিকে রিটেইন্ড আয় থেকে ৮০ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি সমন্বয় করতে বলা হয়।
কিন্তু ব্যাংকটি ব্যালেন্স শিট প্রকাশের সময় এ নির্দেশনাও মানেনি, ফলে এক্ষেত্রেও ব্যাংকিং আইন লঙ্ঘন করেছে ওয়ান ব্যাংক।
নির্দেশনা অনুসরণ করা হলে ব্যাংকের নিট লাভ ও রিটেইন্ড আয় উভয়ই কমে আসতো, একইসঙ্গে অন্যান্য আর্থিক সূচকেও পরিবর্তন আসতো।
খেলাপি ঋণের কারণে ইতোমধ্যেই ব্যাংকের যে ক্ষতি হয়েছে সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রভিশন নির্ধারণ করা হয়, অন্যদিকে প্রত্যাশিত ক্ষতির বিপরীতে সাধারণ প্রভিশন নির্ধারণ করা হয়।
সাধারণ প্রভিশন বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অব্যাহতি নিতে হয়, কিন্তু ব্যাংক কোম্পানি আইনানুযায়ী, ক্যাশ ডিভিডেন্ট ঘোষণার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রভিশন বজায় রাখা বাধ্যতামূলক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ বলছে, ব্যাংকটির ব্যালেন্স শিটে আর্থিক সূচকে এমন গড়মিল আনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকের সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও পরিচালকরা যাতে নগদ লভ্যাংশের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করতে পারেন।
ব্যালেন্স শিট প্রকাশিত হওয়ার তিন মাস পর এ গড়মিল খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
যোগাযোগ করা হলে ওয়ান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফখরুল আলম স্বীকার করেন যে নতুন ডিভিডেন্ট নীতিমালা অনুযায়ী লভ্যাংশ ঘোষণার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতি নেয়নি ব্যাংকটি।
"এর আগে ডিভিডেন্ট ঘোষণার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। সে অনুযায়ীই আমাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি," বলেন তিনি।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই নীতিমালা জারি করে, ব্যাংকটি ডিভিডেন্ট ঘোষণা করে এরও পর, মার্চে।
তিনি বলেন, ব্যাংকটিকে রিটেইন্ড আয় থেকে ৮০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি সমন্বয়ের নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু, এর আগেই ব্যালেন্স শিট তৈরি হয়ে যায় এবং মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ হয়ে যায়।
তিনি দাবি করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৯ সালে এ পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় তারা প্রভিশন ঘাটতি সমন্বয় করেননি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সঙ্গে তার বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়নি।
রিটেইন্ড আয় থেকে প্রভিশন ঘাটতি সমন্বয় করার নির্দেশ দিয়ে এ বছরের ১২ এপ্রিল ব্যাংকটিকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
"ব্যালেন্স শিট পরিবর্তন নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু ইতোমধ্যে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় অডিটর তা করতে চাননি। একারণে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন প্রয়োজন ছিল,"
"বিএসইসি'র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা আমাদের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য পরিবর্তনের অনুমতি দেয়নি," বলেন তিনি।