‘সর্বকালের সর্বোচ্চ’ তাপমাত্রায় পুড়ছে ইউরোপ
মহাদেশটির পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙে ইতালির সিসিলিতে ১১৯.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের (৪৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপদাহ রেকর্ড করা হয়েছে কাল (বুধবার)। সেইসঙ্গে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাণঘাতী দাবানল ও খরার তাণ্ডব বেড়ে চলছে।
সাহারা থেকে আসা উত্তপ্ত বাতাস ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোর দিকে প্রবাহিত হওয়ায় ইউরোপজুড়ে তাপদাহ অনুভূত হচ্ছে। অঞ্চলটির কৃষি-আবহাওয়া তথ্য পরিষেবা (এসআইএএস) জানিয়েছে, দেশজুড়ে 'লুসিফার' নামক একটি অ্যান্টিসাইক্লোন প্রবাহিত হওয়ার পর দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত সিরাকিউজ শহরে ১১৯.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
এর আগে ইউরোপীয় মহাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। সে বছর গ্রিসের এথেন্স শহরের তাপমাত্রা ছিল ১১৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
সম্প্রতি আফ্রিকা থেকে আসা লুসিফার নামক একটি অ্যান্টিসাইক্লোন ইতালির মূল ভুখণ্ডের উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সাইক্লোনটি দেশজুড়ে প্রাণঘাতী দাবানলের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
এ অবস্থা চলাকালীন সময়ে সিরাকিউজের মেয়র ফ্রান্সেসকো ইতালিয়া বলেন, সিসিলির তাপ-প্রবাহ তাদেরকে চিন্তিত করে তুলছে। ইতালির সংবাদপত্র লা রিপাবলিকাকে তিনি জানান, 'ইউরোপের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্র বর্তমানে ঝুঁকির মধ্যে আছে। আমরা সম্পূর্ণরূপে জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছি।'
এদিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বেশ বড় একটি অংশে প্রখর তাপমাত্রা চলমান থাকায় ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। সেইসঙ্গে ইতালির অগ্নিনির্বাপককর্মীরা বলেন, তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এটি বায়ুমণ্ডলীয় চাপে মারাত্মক পরিবর্তন নিয়ে আসছে।
এছাড়াও, সিসিলি ও ক্যালাব্রিয়াতে গত ১২ ঘণ্টায় ৩ হাজারেরও বেশি স্থানে তাদের কার্যক্রম চালাতে হয় বলে জানায় অগ্নিনির্বাপককর্মীরা।
গত সপ্তাহে সিসিলি ও পেসকারার ভয়াবহ আগুনের পাশাপাশি দক্ষিণের পুগলিয়ার গ্রাভিনা শহর এবং উত্তরের স্যান গিয়াকোমো ডেগলি শিয়াভোনিতেও আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া শুষ্ক ও ঝড়ো হাওয়া প্রবাহের ফলে দক্ষিণ ফ্রান্সেও সতর্কতা জারি করা হয়।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি স্পেনেও তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। বুধবার স্পেনের কোস্টা দেল সোলে ১১৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে দেশটির আবহাওয়া পরিষেবা এইএমইটি। সেইসঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের তাপমাত্রাও ১১১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এইএমইটি আরও জানায়, 'বছরের এ সময় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় পৌঁছাবে।' সেইসঙ্গে মেইনল্যান্ড স্পেন এবং বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ সাম্ভাব্য তাপদাহের মুখোমুখি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সংস্থাটির একজন মুখপাত্র।
স্পেনের পাশাপাশি গ্রিসেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব দেখা দিয়েছে। দেশটির কিছু প্রান্তে তাপমাত্রা ১১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছানোয় সেখানের জনসাধারণকে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে সতর্ক করা হয়েছে।
সিভিয়ার ওয়েদার ইইউ এর প্রধান পূর্বাভাসকারী মার্কো কোরোসেক বলেছেন, ইউরোপজুড়ে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় এ সপ্তাহের শেষের দিকে স্পেন ও পর্তুগালে আরও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে। সপ্তাহের শেষের দিকে এ তাপদাহ সম্পূর্ণ আইবেরিয়ান উপদ্বীপজুড়ে প্রবাহিত হবে বলে যোগ করেন তিনি।
তাছাড়া, পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও কস্তা এক সতর্কবার্তায় জানান, উষ্ণ এ আবহাওয়া দাবানলের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। তিনি বলেন, বর্তমানে গ্রিস ও তুরস্কের 'ভয়াবহ চিত্র' তাকে ২০১৭ সালের দাবানলে শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করার কথা মনে করিয়ে দেয়। এ পরিস্থিতিতে কস্তা পর্তুগালের মানুষকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন।
যদিও স্পেন ও পর্তুগালের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে তূলনামূলক বেশিই থাকে, তবু জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বর্তমান অবস্থার জন্য পরিবেশ বিপর্যয়কে দায়ী করছেন। তারা বলেন, কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ফলে তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল, বন্যা ও ঝড়ের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি চলছে এখন বিশ্বজুড়ে।
গবেষকেরা বলছেন, এসব বিপর্যয় আমাদের গ্রহে আরও ঘন ঘন ঘটবে বলে ধারণা করা যায়।
ইউরোপে এই তাপদাহের সূচনা হয় অ্যালিকান্তে রিসোর্টে মেটিও সুনামি আঘাত হানার পর। এ সুনামি সেখানকার রাস্তাঘাট, সৈকত, যানবাহন ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া গত বুধবার রাতে সান্তা পোলাও আবহাওয়ার ছোবলের সম্মুখীন হয়। এ অঞ্চলগুলোতে আঘাত হানা সুনামির মতো বিশাল ঢেউ আদতে জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপদাহের ফলেই সৃষ্ট। বিরল আবহাওয়ার কারণে শহরটির নৌবহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় সান্তা পোলার পুলিশ।
এছাড়া, সান্তা পোলার দক্ষিণে গার্ডামারেও গত বুধবার একটি মেটিওসুনামি আঘাত হানে। এ সুনামির ফলে সে অঞ্চলের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৮০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় উঠে আসে।
গত সোমবার প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়, বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ অবস্থা খুব দ্রুতই খারাপের দিকে যাবে।
জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ২০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। ২০৩০ থেকে ২০৫২ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে বলে ভেবেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখন তারা বিশ্বাস করছেন, সেটি এ বছর থেকে শুরু করে ২০৪০ সালের মধ্যেই ঘটবে।
১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে গত ৫০ বছরে বৈশ্বিক পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা গত ২ হাজার বছরের মধ্যে ৫০ বছর ব্যপ্তিতে বৃদ্ধি পাওয়া তাপমাত্রার চেয়েও বেশি। এছাড়া, ১৮৫০ সালের পর বিগত ৫ বছর ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ।
৬০টি দেশের ২০০ বিজ্ঞানী মিলে জাতিসংঘের ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) প্রতিবেদনটি তৈরি করেন। ১৪ হাজারেরও বেশি গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এ রিপোর্টে অতীত ও ভবিষ্যতের উষ্ণতা সম্পর্কে নানা তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। সেইসঙ্গে মানুষ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন করছে এবং কীভাবে এটি চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার সৃষ্টি করছে, সেসবও উঠে আসে এতে।
গবেষকরা বলেছেন, এ শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এছাড়া, বিভিন্ন অঞ্চলে তাপদাহ ঘন ঘন প্রবাহিত হওয়ার ঘটনার বিষয়ও উল্লেখ করেন তারা।
ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক রিসার্চের সিনিয়র জলবায়ু বিজ্ঞানী লিন্ডা মেয়ার্ন্স বলেন, 'বর্তমানে বিশ্বের কোনো অঞ্চলই সুরক্ষিত নয়।' তবে, কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে পারলে এখনো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
মেট অফিস হ্যাডলি সেন্টারের অধ্যাপক এবং এ প্রতিবেদনের লেখক রিচার্ড বেটস বলেন, 'তাপমাত্রা যাতে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে না পারে তার জন্য এখন জরুরিভিত্তিতে কিছু গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে।'
এছাড়া, জাতিংসঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নতুন প্রতিবেদনটিকে 'রেড কোড ফর হিউম্যানিটি' বলে অভিহীত করেন বলেন, 'জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং বন উজাড়ের ফলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস আমাদের গ্রহকে নষ্ট করে ফেলছে এবং কোটি কোটি মানুষকে তাৎক্ষণিক ঝুঁকিতে ফেলছে।'
এদিকে, এই রিপোর্টের উল্লেখ করার সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, আগামী দশকটি এ গ্রহের ভবিষ্যৎ নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় হতে চলেছে। তিনি আরও বলেন, 'বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি রোধ করার জন্য কী করতে হবে, তা আমরা জানি। কয়লা বাদ দিয়ে পরিষ্কার শক্তির উৎস ব্যবহার, প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণ, ফ্রন্টলাইনে থাকা দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন নির্ধারণ- ইত্যাদি কাজ করতে হবে আমাদের।'
ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্থনি ব্লিংকেন এক বিবৃতিতে বলেন, 'আইপিসিসির সিক্সথ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে দেখা গেছে আমরা ইতোমধ্যেই ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট) উষ্ণতা বৃদ্ধির কাছাকাছি চলে এসেছি। ফলে সকল দেশের উচিত এ সংকটপূর্ণ সময়ে যাতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে বিষয়ে এগিয়ে আসা। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা ২০০৫ সালের তুলনায় ২০৩০ সালে গ্যাসের নির্গমন ৫০-৫২ শতাংশ কমিয়ে আনবে। জলবায়ু বিষয়ক কোনো কাজে আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়।'
-
সূত্র: ডেইলি মেইল