ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে ১৫ বছর ধরে পড়ে আছে সারিবদ্ধ চারটি সেতু
চারটি কংক্রিটের সেতু দাঁড়িয়ে রয়েছে এক বিলের মাঝখানে। নির্মাণের পর ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সেতুগুলোর সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়নি। ফলে কোন কাজেই আসছে না সেতুগুলো। বর্ষায় চারপাশে থাকে পানি। আর শুকনো মৌসুমে মই দিয়ে উঠতে হয় সেতুতে। দিনের পর দিন এভাবে পড়ে থাকায় সেতুগুলো পরিচিতি পেয়েছে 'এতিম সেতু' নামে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার নড়াইল ইউনিয়নের শিবধরা বিলে পূর্ব নড়াইল থেকে কাওয়ালিজানের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করার জন্য ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে নির্মিত হয় এসব সেতু। তবে সংযোগ সড়ক না থাকায় এই নির্মাণ কোন কাজে আসছেনা স্থানীয়দের।
দূর থেকে দেখে মনে হবে সেতুগুলোর সংযোগ সড়ক ডুবে গেছে বর্ষার জলে। তবে কাছে গেলে বোঝা যাবে এখানে কোন রাস্তাই নেই। স্থানীয় বাসিন্দা গফুর মিয়া বলেন, "আমি যখন কিশোর বয়সে তখন এই সেতুগুলো নির্মাণ করা হয়। এখন আমি বিয়ে করেছি, একটি বাচ্চাও হয়েছে তবে এই রাস্তা হয়নি এখনো। আমরা রাস্তার আশা ছেড়ে দিয়েছি"।
কৃষক আবুল কালাম বলেন, "এই বিল এলাকায় প্রচুর ধান হয়। এই সড়কটি থাকলে হালুয়াঘাট বাজারে যেতে আমাদের সুবিধা হতো। এখন অনেকটা ঘুরে বাজারে যেতে হয়। পরিবহন খরচও অনেক বেড়ে যায়"।
হাসেম মিয়া নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, "এলাকায় বছরে ২০-২৫টা বিয়ে ভেঙ্গে যায়; যখন পাত্র বা পাত্রীপক্ষ খোঁজ নিতে আসে বাড়িঘরের, তখন যোগাযোগের এই দুরবস্থা দেখে। এলাকাবাসী নিজেদের জীবদ্দশায় এই সেতুর সাথে সড়ক দেখে যাওয়ার স্বপ্ন বাদই দিয়েছেন। এখন দাবি অন্তত তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে সড়কটি ব্যবহার করতে পারে সেই উদ্যোগ নেয়া হোক"।
কাদের মুন্সি নামে একজন পৌঢ় বলেন, নিজের জীবদ্দশায় এই ব্রিজ দেখে যেতে পারবেন কিনা তিনি জানেন না। তিনিও বলেন, অন্তত তার নাতিরা যেন এই রাস্তা ব্যবহার করতে পারে সেই উদ্যোগ নেয়া হোক।
দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে, ওয়ার্ল্ড ভিশনের নির্মিত এসব সেতুর একটি ৬৩ ফুট দীর্ঘ। বাকি তিনটির প্রতিটিই ৪৫ ফুট দীর্ঘ। ১৫ বছর আগে ওয়ার্ল্ড ভিশন সেতুগুলো নির্মাণ করলেও বাকি কাজ করার কথা ছিলো স্থানীয় সরকারী সংস্থাগুলোর।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের ময়মনসিংহ জেলার এরিয়া ম্যানেজার রাজু উইলিয়াম রোজারিও বলেন, এলাকার মানুষের সুবিধার জন্য বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাতায়াত ও কৃষিপণ্য সহজে পরিবহনের জন্য বিলের মধ্য দিয়ে একটি যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে সেতুগুলো দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে নির্মাণ করেছিল ওয়ার্ল্ড ভিশন। কাজ শেষে স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। কথা ছিলো সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা প্রায় দুই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করবে, কিন্তু সেটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
কত টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন যে কোন নথি প্রকল্প শেষ হওয়ার সাত বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করে। তাই বর্তমানে এই বিষয়ে কোন নথি তাদের কাছে নেই।
হালুয়াঘাটের স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী দপ্তরের দেয়া তথ্য বলছে মোট ৯৮৭ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে উপজেলাটিতে। গত ৫ বছরে কাজ হয়েছে ৬২ কিলোমিটার সড়কে। তবে সেতুগুলো যে সড়কে সেই সড়কের বিষয়ে কোন তথ্য নেই হালুয়াঘাটের স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী দপ্তরে।
উপজেলা প্রকৌশলী সান্তুনু ঘোষ সরকার বলেন, "আমি শুনেছি এরকম চারটি সেতু পড়ে আছে। যারা এটি নির্মাণ করেছেন পরবর্তীতে আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করেননি। এই বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া যায় আমরা দেখবো"।
হালুয়াঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আলাল উদ্দিন জানান, গত বছর ওই এলাকার কিছু অংশে তারা কর্মসৃজন প্রকল্প থেকে কিছু মাটি ভরাট কাজ করেছিলেন।
এদিকে হালুয়াঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক সায়েম বলেন, "এই সড়কটি খুবই প্রয়োজনীয় একটি সড়ক। নড়াইল ইউনিয়নের কালিয়ানিকান্দা, চরবাঙ্গাইল্যা, গোপীনগর, থৈইল্যাপাড়া, পূর্ব নড়াইল, মাছাইল, কুমুরিয়া, খালপাড় ও আশপাশের এলাকার হাজারো মানুষ এসব সেতু নির্মাণের খবরে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। কেননা নৌকা দিয়ে বিল পারাপারে তাদের অনেক সময় লাগে। কিন্তু সেতু হলেও তা বাস্তবে মানুষের কোনো কাজে আসেনি। চেষ্টা করছি এই সমস্যার সমাধান করতে"।
এ প্রসঙ্গে হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, "বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে সংযোগ সড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে"।